মৃদুল শ্রীমানী
সেই দুঃখীর কথাও মনে পড়ছে, রথের অনুষ্ঠানে শোভাযাত্রা বের হয়েছে বলে, যাকে সবাই একে একে ডাকতে এল। দুঃখী শোভাযাত্রায় যেতে চাইল না। তার বক্তব্য, প্রকৃত রথ তার কুটিরের সামনে দিয়ে যায়। তার প্রমাণ হিসেবে সে তার দুয়ারে ফুটে থাকা সূর্যমুখী ফুল দেখিয়ে দিল। লিপিকা মনে করি।
রথের যে দেবতা, সেই যে অন্ত্যজ শিল্পসাধকের হাতে জন্ম নেবেন। কিন্তু সামাজিকতার প্রশ্নে রাজশাসনে স্রষ্টা শিল্পীর অধিকার নিদারুণ ভাবে খণ্ডিত। তার অধিকার নেই নিজের হাতে গড়া নিভৃত প্রাণের দেবতাকে সে চর্মচক্ষে দেখে। তাই রাজশাসনে শিল্পীর চোখে বাঁধন । দুয়ারে সঙিন উঁচিয়ে পাহারাদার। দেবতার মূর্তি গড়ার কাজ চলে ছোটলোকের দৃষ্টির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। কিন্তু শিল্পসৃষ্টি সম্পন্ন হলে সৃজনের আনন্দে ব্যাকুল মানুষ ভয় পেতে ভুলে গিয়েছে। জাগতিক হিসেব নিকেশের বাইরে সৃজনের আনন্দ। ভয়হারা শিল্পী চোখের বাঁধন খুলে প্রাণের দেবতাকে প্রাণভরে দেখে।
রাজশাসনে মুণ্ড খসে যায়।
তারপর রথের রশি ভাবি। রথ টানার লগ্ন যায়, দড়ি নড়ে না। কার হাতের টানে চলবে রথ?
ভক্তিরসে কাদা করে তোলা অনুগতজনের স্বভাব। যেদিকে পাল্লা ভারি, সেদিকে নজর রেখে ঝুঁকে পড়া এদের অভ্যাস। ক্ষমতাসীন ব্যক্তির স্তাবক হতে ন্যায়বুদ্ধির অভাবটাই যথেষ্ট। এরা নিজেদের ভিড় দেখে নিজেরা অবাক হয়। ওই যে ভক্তিরস, আসলে ভক্তির নামে স্তাবকতা, সুবিধার ছত্রছায়ায় থাকার লোভ, এর বিরুদ্ধে কবিকে মাথা তুলতে হয়। ভক্তিরসের মাতলামির বিপদকে স্পষ্ট করে চিনতে, চেনাতে হয়। যুক্তি বিবর্জিত ভক্তির মুখোশ ধরে টানাটানি করাই কবির কাজ।
টাকার জোর, পুঁজির জোর হাল আমলে রাষ্ট্র পরিচালকদের বিনি সুতোয় নাচায়, এইটি বিজ্ঞ লোকের চোখে পড়ে।
মন্ত্রীর পোশাক গায়ে চাপিয়ে রাষ্ট্র পরিচালককে লোক সাধারণকে ভোলাতে হয়, ভুলিয়ে শান্ত রাখার জন্যে বাগবিস্তার করায় মন্ত্রীর দক্ষতা।
প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক আধুনিক বিশ্বের মানুষ ছিলেন। তাঁকে বিশ্বের আধুনিক লোকেদের সাথে মিশতে হত। প্রৌঢ় বয়সে তাঁর পক্ষে সমসময়ের বাস্তবতা অগ্রাহ্য করে কোনো ধূসর অতীতের দিকে চেয়ে কাল কাটানো সম্ভব ছিল না। ভগবানের তৈরি কোনো ব্যবস্থা নয়, সভ্যতার গতিপথে বিবর্তিত হতে হতে তৈরি সমাজ অর্থনৈতিক কাঠামোই যে বাস্তব জীবনে ক্রিয়াশীল, এটা তিনি বুঝতেন ও বোঝাতেন। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত ছিল সামনের দিকে।
রথের রশি দুর্দান্ত ভাবেই আধুনিক বিশ্বের সংকট ও সংকটক্রান্তির বিষয় সম্পর্কে লেখা। এ লেখা সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যিনি আইনস্টাইনের, রম্যাঁ রলাঁর, বার্ট্রান্ড রাসেলের সমযোগ্য আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ।
বাস্তব রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন প্রেসার গ্রুপের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হয় রাষ্ট্র পরিচালককে। রথের রশিতে তার গায়ে মন্ত্রীর পোশাক। বড়ো খবর গল্পে সে মাঝি। রক্তকরবীতে সে সর্দার। সে নিজের শ্রেণিস্বার্থের তাগিদে জানে ধনপতিকে সাথে নিয়ে চলতে সে বাধ্য। অন্যান্য প্রেসার গ্রুপকে নরমে গরমে রেখে কাজ উদ্ধার করার দায় তার।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন