কোভিডের কান্না : অমিয় কুমার চৌধুরি


কোভিডের কান্না  

অমিয় কুমার চৌধুরি

     করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯কে বাগে আনতে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। চতুর্থ দফার লকডাউন শেষের দিকে। দেশজুড়ে চর্চা হচ্ছে পঞ্চম দফার লকডাউন ঘোষণা হবে কিনা? এই সময় পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক মুম্বাই, দিল্লি, কেরল, বেঙ্গালুরু রাজ্য থেকে ফিরে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। নিকটবর্তী স্টেশনে নেমে যে যার গ্ৰামে ফিরছে ছোট ছোট দল বেঁধে। খবরের কাগজ পড়ে বা টিভিতে এসবই জানতে পেরেছেন ধনীরামবাবু। তাঁর অন্তরাত্মা কাঁদছে কিনা কেউই কোনদিন খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ঈশ্বরও না। তাঁর মনে হচ্ছে কোভিডের মৃত্যুবানে অসহায় বিশ্ববাসী কাঁদছে। এর শেষ কোথায়! কবে! ঈশ্বরও কাঁদছে নাকি?

       জাতীয় সড়কের পাশে ধনীরামবাবুর দোতলা পাকা বাড়ি।  লকডাউনের সতর্কবার্তার জন্য বৃদ্ধদের বাড়ির বাইরে যেতে মানা। তাই স্বভাবসুলভ অভ্যাসমত ভোরে বাড়ির ছাদে হাঁটাহাঁটি করছেন। ছাদ থেকে দেখতে পেলেন পাল মার্কেটের বারান্দায় ৫-৭ জন শ্রমিক ব্যাগপত্র নিয়ে বসে আছে। একজন বড় একটা বাটি নিয়ে তাদের বিল্ডিংয়ের দিকে আসছে। ছাদের দিকে তাকিয়ে বাটি ধনীরামবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শ্রমিকটি বলল, বাবু, একটু জল দিবেন। রামবাবু আতঙ্কিত হলেন। মনে মনে বললেন, তোরাই করোনার ভাইরাস নিয়ে জেলায় ঢুকছিস্। তারপর তা ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে। সাহায্য করতে গিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবো। অতেব দরকার নেই।
      - কি হল বাবু, জল দিন। কাতরসুরে বলল ঐ শ্রমিক।
       রামবাবু ভাবতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। একটু নড়েচড়ে বিব্রতবোধ কাটিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, ভাই, ঐ যে ফলের দোকান দেখছো ( তখনও দোকান খোলেনি) তার পিছনে মাট্টু টিউবওয়েল আছে।
      রামবাবুর কথা শেষ করতে না দিয়েই শ্রমিকটি বলল, টিউবওয়েল খারাপ। জল বের হচ্ছে না। বাবু, জল দিন, দয়া করুন।
     শ্রমিককে দাঁড়াতে বলে রামবাবু দ্রুত নেমে এলেন ঘরে। দুই লিটারের বোতলে জল ভরতে শুরু করলেন।  স্ত্রী দেখতে পেয়ে বললেন, এতো সকালে বোতলে জল ভরছো?

        কোন উত্তর না দিয়ে রামবাবু ছাদে উঠে গেলেন। শ্রমিককে ক্যাচ করতে বললেন। বোতলভর্তি জল পেয়ে ঢক ঢক করে গলায় ভারতে লাগল। ইতিমধ্যে অন্য শ্রমিক ছুটে আসছে। তিনজনে বোতল শেষ করে দিল। অবশিষ্ট তৃষ্ণার্তরা কাতরসুরে বলল, বাবু আমাদের একটু জল দিন। রামবাবু আবার নিচে নেমে এলেন। কোন বোতল খুঁজে পেলেন না। বাধ্য হয়ে ষ্টীলের বড় জগে জল নিয়ে আবার ছুটলেন ছাদে। উপর থেকে বললেন, বাটিটা ধর আমি জল ঢালছি। ছাদ থেকে রামবাবু জল ঢালছেন। যেন স্বর্গ থেকে পড়ছে! শ্রমিকরা স্বর্গসুধা পান করছে। রামবাবু দেখে তৃপ্ত হচ্ছেন। এমন সময় স্ত্রী ছাদে উঠে এসে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, তুমি এভাবে জল নষ্ট করছো? রামবাবু ভ্যাবলাকান্তের মত স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। স্ত্রী ছাদের কিনারে এসে সে দৃশ্য দেখে আঁৎকে উঠলেন। বললেন, এরা সব পরিযায়ী শ্রমিক। ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরছে। আর তুমি এদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে? রামবাবু ভ্যাবলার মত নিরুত্তর। স্ত্রীর এবার দয়া হল। বলল, আহা রে! শুধু জল পান করেই পেট ভরাচ্ছে। ওদের এ ক'দিন খাবারই জোটেনি। শ্রমিক দলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললেন , তোমরা একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি। 

     প্রায় দৌড়েই ছাদ থেকে নেমে গেলেন রামবাবুর স্ত্রী। স্টোররুমে ঢুকে মজুত করা এক প্যাকেট ছিঁড়ে ও ঢেলা গুড় নিয়ে আবার ছুটলেন ছাদে। নিজে হাতে ছুঁড়ে দিলেন শ্রমিকদের দিকে। ওরা বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেল পাল মার্কেটের দিকে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনে ভাবছেন - স্বর্গসুধা পেল, ওরা দীর্ঘজীবী হোক। তবেই তো আমরা বাঁচবো। দেশ বাঁচবে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.