![]() |
শামিমা এহেসানা |
গোপালপুর গ্রামে দুটো জিনিস দেখার মত ছিল। এক, গ্রামের মাঝে এক পুরোনো, জরাজীর্ণ রাজবাড়ি। আর দুই, খ্যাপা মাস্টার। খ্যাপা মাস্টারকে চেনে না এমন মানুষ যদি গ্রামে খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে হয় সে ভিন গাঁয়ের চোর, নয় কোনো ছদ্মবেশী বলে মনে করত গোপালপুরের মানুষজন।
খ্যাপা মাস্টার এর নামের আগে এমন অদ্ভুত বিশেষণ লেগেছে বছর কুড়ি আগে। তার আগে তিনি ছিলেন অপূর্ব মাস্টার। একটি স্কুলে চাকরি করতেন। কিন্তু অল্প সময়ে এত ছাত্রছাত্রীর প্রিয় মাস্টার হয়ে ওঠাটা কেওই ভালো চোখে দেখেনি। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বসে টিফিন খাওয়া, স্কুলের বাইরে গরীব ছেলে মেয়েদের অর্থ সাহায্য, এমনকি একবার এক ছাত্রের মা অসুস্থ শুনে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে শুশ্রূষা করে সেরে ওঠা পর্যন্ত অপূর্ব মাস্টার তাদের মাথার ছাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই ছাত্রের বাবা দেশত্যাগী হয়েছিল। তার মা, লোকের বাড়িতে কাজ করে রোজগার করত। তার টিফিন খরচ সহ বইপত্র এবং বিনা পয়সায় টিউশনির ভার স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন অপুর্ব। একদিন ছাত্রের মায়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে বাড়িতে গিয়েছিলেন। বেচারির শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে দেখে জলপট্টি দেবেন, এমন সময় গ্রামের মাতব্বররা এসে মাস্টারের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। কাল পর্যন্ত অপূর্ব মাস্টারকে যারা ভগবান ভাবতেন, তারাও লোকের মুখে শোনা গল্পকে ইশ্বরের বানী ভেবে, সযত্নে এড়িয়ে যেতে শুরু করল তাকে। তাতেও অপূর্ব মাস্টারের যাই আসেনি। কিন্তু ক্লাসে ছেলেমেয়েরা যখন মাস্টারের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে শুরু করল, তখন আর সময় নষ্ট না করে, অপূর্ব মোটা মাইনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে এলেন।
এরপর কেটেছে প্রায় বছর কুড়ি। মা-বাবার গত হওয়ার পর মাস্টারের আপন বলতে আর কেওই ছিল না। যৌবনের শুরুতেই ঘৃণ্য অপবাদ পাওয়ার পর, অপূর্ব মাস্টার মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। ফলে আর বিয়ের পিঁড়িতেও বসা হল না তার। মানুষকে অবিশ্বাস করলেও তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষেরই অন্য একটা রুপকে। তারাই ছিল মাস্টারের ধ্যান-জ্ঞান। ছাত্র-ছাত্রীরাই মাস্টারের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য ছিল।
গোটা গ্রামে এমন কোনো পড়ুয়া ছিল না, যাকে অপূর্ব মাস্টার পড়ান নি। তাদের অনেকেই সফল হয়ে শহরে পাড়ি দিয়েছে, আবার অনেকেই বখাটে হয়ে থেকে গেছে এখানেই। তারাই এখন মাস্টারকে দেখলে, আড়াল থেকে 'খ্যাপা মাস্টার' বলে ডাক দেয়।
অপূর্ব মাস্টারের যত শত্রুতা, সব বড়লোক বাবা-মা এর সাথে। বিত্তবানদের ছেলে মেয়েদের পড়ানোর জন্য মাস্টার মোটা টাকা মাইনা নিতেন। অথচ, গরীর ছেলে মেয়েদের দিনের পর দিন নিঃস্বার্থভাবে পড়াতেন। এই শত্রুতার কারণ কেও কোনোদিন জানতে পারেনি। তবে গরীব ছেলেমেয়েদের প্রতি এই মায়ার কারণ ছিল, মাস্টারের নিজের ছোটোবেলা। হত দরিদ্র পরিবারে মানুষ হওয়ায়, অর্থাভাবে কেও পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তা মানতে পারতেন না মাস্টার। ফলে গরিবের জন্য তিনি নিঃস্বার্থ, আর বিত্তবানদের চোখে লোভী ছিলেন।
নিজের বলতে তার ছিল, একটা আধ ভাংগা বাড়ি, তার ভিতর কয়েকশো বই। নামমাত্র একটা রান্নাঘর। চুরি করার মত কোনো সামগ্রী ছিল না খ্যাপা মাস্টারের বাড়িতে, ফলে দরজায় তালা লাগানোর রেওয়াজও ছিল না। সকালে বেরোতেন পড়াতে, এভাবেই গোটা দিন কেটে যেত। ঘুম, খাওয়া, স্নান ছাড়া, বাড়ির প্রতিও তার কোনো মায়া ছিল না। যারা বই কিনতে পারত না, তাদের বই,পেন,পেন্সিল কিনে দেওয়ার ভার ছিল মাস্টারের ঘাড়ে। ছাত্র-ছাত্রী অসুস্থ হলে, নিজেই তাদের সেবা করতেন। তাদের সাথেই খেতে বসতেন। যেন তার জীবনে আর অন্য কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না।
গ্রামের পুরোনো রাজবাড়ীর আশে পাশে কোনোদিন কাওকে দেখা যেত না, কারণ লোকে বিশ্বাস করত, সেই বাড়িতে দিনের বেলায়ও ভূতের দেখা পাওয়া যায়। একমাত্র মাস্টার মাঝেমধ্যেই পুরোনো রাজবাড়ীতে যেতেন। কিন্তু পিছু করার সাহস কেও কোনোদিন দেখায়নি।
এমনই জীবনবিমুখ অদ্ভুতুড়ে আচরণের জন্য তিনি অপুর্ব মাস্টার থেকে খ্যাপা মাস্টার হয়ে উঠলেন। মাস্টারকে যারা ভালোবাসতো তারা জিজ্ঞাসা করত, নিজের জন্য সঞ্চয় না করে, এভাবে ছেলে মেয়েদের বিনা পয়সায় পড়িয়ে, উল্টে তাদেরই পিছনে কেন খরচ করেন মাস্টার। তখন মাস্টার বলতেন, তার গুপ্তধন রাখা আছে। সেই গুপ্তধন বৃদ্ধি করার জন্যেই তিনি এত কষ্ট করেন। আর তার গুপ্তধন দেখতে চাইলে বলতেন, "যেদিন আমি মারা যাব, সেদিন গুপ্তধনের খোঁজ পাবে তোমরা।" অনেকে তার কথায় বিশ্বাস করত, তবে বেশির ভাগ মানুষ বলত, "খ্যাপার আবার গুপ্তধন।"
পয়লা বৈশাখের দিন সকালবেলা গ্রামে একের পর এক গাড়ি ঢুকতে শুরু করল। এদের কেওই এই গ্রামে থাকে না। কিন্তু তাদের শিকড় এই গ্রামেই বাঁধা। তারা সবাই এককালে খ্যপা মাস্টারের ছাত্র ছিল। কত মেয়ে তাদের শ্বশুর বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। গ্রামের সব ছেলে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে মাস্টারের বাড়ির সামনে। ছেলেমেয়েদের চোখের জল যেন বাঁধ মানছে না। মানুষের ভারে যেন গোপালপুর গ্রাম ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। মাস্টারের দেহ রাখা হয়েছে তার বাড়ির উঠোনে। রজনীগন্ধার ঘ্রাণে ভরে উঠেছে গোটা এলাকা। মাস্টারের মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গোটা এলাকা সাদা ফুলের মালা আর তোড়ায় ভরে উঠেছে।
ঘাটে নিয়ে যাওয়ার সময় হাজার হাজার মানুষের লাইন। যেন কোনো তারকার শেষ যাত্রা। শব কাঁধে নেওয়ার জন্য একের পর এক ছাত্র এগিয়ে আসছে। সংসারী বাবা-মা এর শেষ কৃত্যেও এত কাঁধ এগিয়ে আসেনা কোনোদিন। খ্যাপা মাস্টার এর মৃত্যুর পর, তার গুপ্তধন সাথে নিয়েই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন