বাংলার দান্তে, বিনয় মজুমদার : তীর্থঙ্কর মৈত্র

বাংলার দান্তে, বিনয় মজুমদার : তীর্থঙ্কর মৈত্র
বাংলার দান্তে, বিনয় মজুমদার : তীর্থঙ্কর মৈত্র
 
ঢাউস একখানা চাঁদ উঠেছে। লম্বু গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে তার শরীর দেখা যাচ্ছে। বেশ কাঁচা সোনায় সামান্য লালের মিশেল। এই রঙের মিশেলটি আরো ভালো করে বুঝতে হলে, আরো কিছুক্ষণ বাইরে থাকতে হবে। মনযোগ দিয়ে দেখতে হবে ঐ চাঁদটিকে। মনে মনে আলাদা করে নিতে হবে সেইসব রঙকে, যাদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে ঐ রঙের সমষ্টি। এরপর তাদের অর্থাৎ প্রতিটি রঙকে, মনে মনে যথাযথ পরিমাপ করে নিতে পারলে, তবেই বলা সম্ভব ঐ চাঁদের রঙটা আসলে কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে। কিংবা ঐ মিশেলটিকে অন্য কোন্ পদ্ধতি দ্বারা পৃথকীকরণ ও পরিমাপ করে নিতে পারলে, তাহলে ঐ মুহূর্তে মনে যে পরিমাণ উপযোগ সৃষ্টি করছে, সেই পরিমাণ উপযোগ সৃষ্টিকারী একটা ফর্মুলা পাওয়া সম্ভব। 

প্রকৃতি এমন এক শিল্পী, সে, মুহূর্তে মুহূর্তে ফর্ম পাল্টে, নিউ ফর্ম সৃষ্টি করে মুগ্ধ করে দিতে পারে। প্রতিটি মুহূর্তে এই যে পরিবর্তন, তা নিশ্চয়ই কোনো না কোন নির্দিষ্ট সূত্রে আবদ্ধ। এই সূত্র যিনি বুঝতে পারেন তাঁর কাছে শিল্প সৃষ্টির কাজ সহজ হয়ে যায়। যায় কি? অন্তত এই মুহূর্তে যে ফর্মুলা তৈরি করল রঙ, আলো, এবং দর্শকের মস্তিস্কে যে পরিমাণ উপযোগ সৃষ্টি করল, সেটুকু হয়তো করা সম্ভব। তেমনি একজন কবির কবিতা পাঠ-কালে যে ভালো লাগার বোধ জন্মে, তাতে বুঁদ হয়ে থাকা একরকমের ভাব। কিন্তু যখন প্রশ্ন জাগে, কেন? তখন ঐ ভালো লাগা সৃষ্টিকারী উপাদানের প্রয়োগ ও তার পরিমাপ করাটা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক ঐ চাঁদের আবেদন বিশ্লেষণ করার মতই। শ্রদ্ধেয় কবি বিনয় মজুমদারের কবিতা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে আমার এমন এক বোধ, হচ্ছে। কিন্তু বোধ হওয়াতে সীমিত থাকলেই হয়তো ভালো হত। কারণ সুন্দরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, সুক্ষ্নাতি-সূক্ষ্ণ বিশ্লষণে যদিও  অন্য এক ভালো-লাগার জন্ম হয়, তবু সেই প্রথম দর্শনের ‘আহা’! এই অপূর্ব অনুভূতি বুকে নিয়ে, না; ভুল বলা হল হয়তো! 

কবি বিনয় মজুমদার আমাদের জানিয়েছেন --- মানুষ সমস্ত শরীর দিয়েই চিন্তা করে। তাহলে কি, মানুষ তার প্রিয় অনুভূতিগুলি সমস্ত শরীর দিয়ে অনুভব করে? এ প্রসঙ্গের বিস্তারে না গিয়ে বরং জানাই--- যখন তার কবিতা সম্পর্কে লিখতে হবে, তখন চাঁদটাকে যেমন ভালো করে লক্ষ্য করা প্রয়োজন, তেমনি ভাবে তাঁর কবিতাকেও দেখে নেওয়া দরকার। কিন্তু আমার সেই দক্ষতা কতটুকু। এ কাজ বিজ্ঞজনের। বরং অনেকগুলো বছর এমন এক কবির সংস্পর্শে থাকার ফলে তিনি যা জানিয়েছেন এবং লিখিত আকারে তিনি যা বলেছেন, এই সবকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগতভাবে আমার যা ধারণা হয়েছে, সেগুলি সৎভাবে প্রকাশের চেষ্টা করা যাক। অর্থাৎ নিজের প্রকৃতির অলিন্দ থেকে উঁকি দিয়ে দেখে নেওয়া যাক ; বিনয়ের প্রকৃতি ও তাঁর কবিতার প্রকৃতিকে। 

শ্রদ্ধেয় কবি বিনয় মজুমদারের বাংলা কাব্য-জগতে পদার্পণের কাল ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ ‘নক্ষত্রের আলোয়’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কাল। এটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়। প্রথম মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কার,  চিন্তাজগতে চিন্তাবিদদের বিশেষ কিছু মতবাদ, যা আধুনিক কবিতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল য়ুরোপে। যার ঢেউ ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এজরা পাউন্ডের আধুনিক কবিতা আন্দোলনের মন্ত্রে দীক্ষিত বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে বাংলা কবিতা আন্দোলনের রূপ নেয়। 

এ আন্দোলনের ফলে জীবনানন্দ দাস, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবির আবির্ভাব ঘটে। এ সময়ে বাংলা কবিতার রক্ত-মাংসে য়ুরোপীয় এই কাব্য আন্দোলনের ঢেউ যতটা লেগেছিল, তা সঞ্চারিত হতে দেখা যায় ৫০শের কবিকুলের মধ্যে। কবি বিনয় মজুমদার এই পঞ্চাশ দশকের একজন। রবীন্দ্র পরবর্তী দীর্ঘ শৈত্যপ্রবাহে যে তাঁবু ফেলেছিলেন আধুনিক আন্দোলনকারী প্রথমার্ধের কবিগণ, সেখানে এই নবীন কবিরা আগুনের ব্যবহার এবং আধুনিকতার যৌবন-প্রাপ্তী  ঘটিয়েছিলেন। কবি বিনয় মজুমদার এ সময়ে অবস্থান করলেও পাউন্ড-মন্ত্র-দীক্ষার কতটুকু মেনেছিলেন? আধুনিক কবিতা আন্দোলনের মূলে ছিল, পুরাতনকে বর্জন। দ্বিতীয়ত, পুরানো ছন্দ পরিহার করা বা মুক্ত ছন্দ গ্রহণ। তৃতীয়ত, সমসাময়িক শব্দের প্রয়োগ। চতুর্থত, রোমান্টিসিজমের ছন্দ ও শব্দপ্রয়োগে অতি তরলীকরণ থেকে মুক্ত হওয়া ইত্যাদি। আমরা বিনয়কে পাই কয়েকটি ক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টোরূপে। 

তাঁর সমসাময়িক বন্ধুরা যখন সমসাময়িক শব্দপয়োগে ব্যস্ত, বিনয়কে তখন ফিরে তাকাতে দেখি তৎসম ঘেঁষা শব্দের দিকে। অর্থাৎ শব্দে তিনি বেছে নিলেন প্রাচীন-রীতি। দ্বিতীয়ত,আধুনিক শব্দ প্রয়োগের পরিবর্তে তাকে গ্রহণ করতে দেখি, প্রচলিত পয়ার ছন্দ। পুরাতন রীতি-নীতি বর্জন না করে ভারতীয় আদি কবিদের অনেকাংশে  অনুসরন করলেন। বরং তাকে পাই বিংশ-শতকের কবি ও নাট্যকারগণের মত করে। যারা এড্গার এলান পো, ইতালীয় মহাকবি দাঁন্তে, সপ্তদশ-শতকের ইংল্যান্ডের কবি ডন প্রভৃতি মেটাফিজিক্যাল কবিগণ ওয়েবস্টার প্রভৃতি ইংরেজ নাট্যকারগণের ভেতর থেকে আধুনিকতার অনেক সূত্র প্রয়োজন মত গ্রহণ করেছিলেন।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.