ধনুলস্কর ইবুলস্করের সংলাপ(গল্প) : চাষী সিরাজুল ইসলাম

ধনুলস্কর ইবুলস্করের সংলাপ(গল্প) : চাষী সিরাজুল ইসলাম

ধনু লস্কর : ইবু তোর কী মনে পড়ে যেবার আমরা শেষবারের মতো জামশেদপুর ছেড় চলে এলাম, সেবার বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ছোটদের দৌঁড়ে তুই ফাস্ট হয়েছিলি। ফাস্ট প্রাইজ হিসেবে টিনের ছোট্ট একটি রঙ্গিন বাক্স পেয়েছিলি। বাক্সটার ওপর গোলাপী রঙের ফুল আঁকা ছিল। পরবর্তীতে মা সেটার মধ্যে তার টাকা পয়সা রাখতো। আচ্ছা সেই টিনের বাক্সের খবর কী ?
ইবু লস্কর : অনেক দিনের ব্যবহারে টিনের সেই বাক্সটা জং ধরে মরিচা পরে ভেঙ্গে গিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে পরে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসার সময় মা সেটা ফেলে দিয়েছিল।

ধনু লস্কর : আচ্ছা তোর কী মনে পড়ে যখন আমরা জামশেদ পুর থেকে বিক্রমপুর চলে এলাম, তখন টাটা স্টেশন থেকে ট্রেনে কলকাতার হাওড়াতে ফুফাতো ভাই মাখনদার টালি ওয়ালা ছাদের বাড়িতে উঠেছিলাম। কলকাতায় কয়েকদিন বেড়িয়ে ফের ট্রেনে গোয়ালন্দ এসে নামলাম। তারপর চাঁদনি রাতে স্টিমারে চড়ে সকালে লৌহজং নামলাম। বাড়িতে  যাওয়ার  উদ্দেশ্যে বাবা বড় একটা ছইনৌকা ভাড়া করল। সেনৌকা অনেক পথ পেরিয়ে কাজির পাগলা পৌঁছার পর আমরা চারভাই নৌকা থেকে নেমে শ্রীনগর জেলাবোর্ডের সড়ক ধরে নীলার ভিটা দিয়ে প্যাক কাদার মধ্য দিয়ে আমাদের গ্রাম সমষপুর পৌঁছলাম। তোর কী মনে পরে গ্রামের চতলা পুকুরে একবার মাছ ধরতে নেমেছিলাম। একটা চেকবেগা আমার পায়ে ওর বিষাক্ত কাঁটা ফুটিয়ে দিয়েছিল। ব্যথায় চিৎকার করে মারা যাচ্ছিলাম। মা ক্ষত জায়গাটায় গরম পানির ছ্যাক দিয়েছিল। আরেকবার পায়ে খুব ব্যথা হচ্ছিল। সাঁপুড়ে, ছাগলের সিঁয়ের চোঙ্গা দিয়ে আমার ডান পায়ের উড়ু থেকে দলা দলা রক্ত বেড় করেছিল। আসলে ওসব টোটকা ফাটকা চিকিৎসা ছিল ভোগাছ। 

আরেকবার বৈশাখে প্রবল ঝড় হলো। আমি আর বন্ধু ছালন ঝড় বাদল উপেক্ষা করে দোগাছির প্রতাপ হাজরাদের পরিত্যাক্ত জঙ্গল বাড়িতে গেলাম আম কুড়াতে। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের ভয়ে আমের ছালা ফেলেই রনে ভঙ্গ দিলাম। বাড়িতে আসার পথে মেঘের গুড় গুড় শব্দে পুকুর থেকে কৈ মাছ কাতরিয়ে কাতরিয়ে ডাঙ্গায় উঠে আসছিল।  ছালন আর আমি দু'জনে ছালা ভরা অামের জায়গায়  ছাতায় ভরে সে সব কৈ মাছ নিয়ে ফিরেছিলাম। এখন মেঘ হলে কৈমাছ আর সেই অাগের মতো ডাঙ্গায় ওঠে আসেনা,তাই না ? ইবু তুই ছিলি খুব ছোট্ট,তোর কী সেসব মনে আছে ?

ইবু লস্কর : হ্যাঁ। তুমি যা বললে সেসব আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। বাবা অসুস্থ, মা সংসার চালাতে দিশেহারা। তুমি চাকরির জন্য খুলনা বরিশাল ঢাকা হয়ে বাড়ি ফিরলে। ভাগ্যচক্রে ফোয়ারা আপার সংগে তোমার দেখা হলো গ্রামে। তাকে ধরে ঢাকায় চলে এলে। সে সময় ছায়েদ মামা তোমাকে এজিতে ক্লার্কের  চাকুরি দিয়ে দিল। সেই চাকুরি করতে করতেই তুমি ফিল্মে কেরিয়ার শুরু করলে।

ধনু লস্কর : হ্যাঁ। এর কয়েক বছর পর শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। তার আগে প্রেম করে বিয়ে করেছি তোর ভাবীকে। আলিমার জন্ম হলো সত্তরে। মার্চের শেষদিকে ওদের নিয়ে পালিয়ে গ্রামে গিয়ে উঠলাম। কয়েকদিন পর পাক আর্মির গুলিতে  হামিদুল্লা মামার বৌ গুলিবিদ্ধ হলে তাকে লঞ্চে করে বরিশাল নিয়ে গেলাম। মামী বাঁচলোনা। তাকে নিয়ে ফের দেশে ফিরলাম। তার ছেলে শহীদ টুটুলের কবরের পাশে তাকে কবর দেয়া হল। এর কয়েকদিন পর শশুড় মশাই লোক পাঠালো আমাদের ঢাকা নিয়ে যেতে। 

আমরা যুদ্ধের মধ্যেই গোপীবাগের শশুড় বাড়িতে উঠলাম। দিনে ঘুরি ফিরি রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কাজ করি। এভাবেই ষোলই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। শুরু করলাম মুক্তিযুদ্ধের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ছবি। সারাদেশে মুক্তি পেলো ছবিটি। তার অাগের দিন অভিসার সিনেমা হলে ছবির প্রিমিয়ার হলো। ছবি শেষে বাইরে এসে দেখি অগ্রিম টিকিট না পেয়ে উপস্থিত পাবলিক সিনেমা হলের কলাপসিবাল গেট,হলে ঢোকার কাঁচের গেট,দরজা সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। সে অনেক স্মৃতিরে !

ইবু লস্কর : সব আমার মনে আছে বড়দা। ঐ প্রিমিয়ারে আমি ছিলাম। যখন পর্দায় 'ওরা ১১ জন' নামটা ভেসে উঠলো আর ঠা ঠা গুলির শব্দে এগারো জন মুক্তিযোদ্ধার নাম ফুটে উঠলো। তখন করতালিতে হলটা যেনো ভেঙ্গে পড়তে চাইছিল। সে সব আমার মনে আছে বড়দা। অামি ছোট ছিলাম কিন্তু আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। গর্বও হচ্ছিল তোমার জন্য।
ধনু লস্কর : আরেকটা কথা মনে পড়ছেরে। বাবা মারা যাবার পর মন্টু শ্রীনগর এসে টেলিগ্রাম অফিস থেকে ফোন করে জানালো, বাবা সকালে মারা গেছে। আমি বিকেলে বাড়ি এসে দেখি বাবার দাফন হয়ে গেছে। সে কী দারুন কষ্ট ! ঐ অল্প বয়সেই মন্টুর কী সাহস ছিলো, কল্পনা করা যায়না!  সমষপুর থেকে শ্রীনগর অনেক দূর। সেই অল্প বয়সেই মন্টু বাবা মারা যাওয়ার শোক বুকে নিয়েই একা শ্রীনগর এসে আমাকে ফোন করেছিল। পরবর্তীতে সেই মন্টুও রোড এক্সিডেন্টে অকালে মারা গেল। যেদিন মারা গেল সেদিন অল্প ব্যবধানে আমি পরিচালক সমিতির ভোটে হেরে গেলাম । বাসায় এসে শুনি মন্টু নেই। আসলে আমাদের জীবনটা অনেক চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। জীবনে অনেক পেয়েছিরে ! পরিচালক সমিতির সভাপতি হয়েছি চার চারবার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। একুশে পদক পেয়েছি। পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। শ্রদ্ধা। আবেগ। সব। কিন্তু ক্যান্সার আমাকে তাড়া করে বেড়ালো। 

এই রোগটার কাছে আমি হেরে গেছি। হাসপাতালের দিনগুলিতে তুই অনেক রাত্রি জেগেছিস। পাহাড়া দিয়েছিস। খাসির পায়া খেতে চেয়েছিলাম। এনে  খাইয়েছিস। কলকাতা থেকে রসগোল্লা এনে খাইয়েছিস। স্বাধীন, আসমা নাজমা তুই আমার ভাইবোনেরা খুব ঘিরে থাকতি অামায়। আমিও তোদের দেখতে খুব  মুখিয়ে থাকতাম। কারন তোরাতো আমার ভাইবোন। আমরা যে একবাবা মায়ের সন্তান।

ধনু লস্কর : ইবু তোর মনে অাছে মাকে আমি টাকা দিতে যেতাম মাঝে মাঝে। টাকাটা শার্টের আস্তিনে লুকিয়ে রাখতাম। মার কাছে গিয়ে আস্তিন খুলে পাঁচশ টাকার নোট মার হাতে তুলো দিতাম। টাকা পেয়ে মা খুব খুশী হতেন। তার দোয়াতেই তো আমি এতো বড় হয়েছি। এতো সন্মান পেয়েছিরে। আচ্ছা বলতো, আমি মারা গেলাম। হাসপাতালে আমাকে তোরা দু'দিন রাখলি। কবরে যখন আমাকে নামানো হলো, তুই স্বাধীন কোথায় ছিলি ? তোরাতো আমাকে কবরে নামাসনি । স্বাধীনতো সকালেই গ্রামে গিয়ে বাবা মায়ের কবরের ওপর আমার কবর খুরলো। ঢাকা থেকে আমার শবদেহের সংগে আসা লোকজনদের খাবারের ব্যবস্থা করলো। তোদের মধ্যে একজনতো কবরে নামতে পারতি ভাই ? তোদের মধ্যে এমন কী হলো আমার পঁচাত্তরতম জন্ম বার্ষিকীতেও তোদের কাউকে দেখলাম না। 

আসমা নাজমা তুই কাউকেই দেখলাম না। স্বাধীন না হয় কানাডা গিয়েছে। তুই আসলিনা কেনো ? প্রতিবার জন্মদিনেই  তো তুই  থাকিস। এবার অাসলিনা কেনো ? আমার চেহলামের দিন গাঁদা ফুল দিয়ে কী সুন্দর করেই না আমার কবর সাজালি ! পঁচাত্তরতম জন্মদিনেও সেই গাঁদা ফুল দিয়েই আমার কবরটা  সাজিয়ে ছিলি।  জন্মদিনে অনেকেই এসেছিলো,অনেকেই ফুল দিল আমার কবরে। সবাই ঢাকার। কিন্তু  গ্রামের কেউ নেই কেনো ? ওদের কী তোরা বলিসনি ? কাউকে কী তোরা ডাকিসনি ? তোকেও দেখলাম না। তুই ও আসলিনা কেনো  ভাই ? 

ইবু লস্কর : আমরা পর হয়ে গেছি বড়দা...পর হয়ে গেছি...বলেই ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইবু লস্করের। বিছানায় উঠে বসলো সে। দেখলো স্বপ্ন দেখছিলো।  স্বপ্নটা অনেক বড় । ঘেমে গেছে সে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.