![]() |
খেপি : শামিমা এহেসানা |
বিষয় - অপেক্ষাতেই থেমে যাওয়ার গল্প।
গাড়িটা শিয়ালদহ স্টেশন ঢুকছে। এই সাদা এম্বাসেডর আর এই চেনা ড্রাইভার এর সাথে অম্লান এর আজ শেষ দিন। কারণ, গাড়িটা অফিস এর, আর আজ অম্লান এর অফিসের শেষ দিন ছিল। অম্লান আজ রিটায়ার করেছে। কাল থেকে আর শিয়ালদহ স্টেশন, ট্রেনের তাড়া, কিছুই থাকবে না। শুধু ছেলেটাকে রাতে টিউশন থেকে বাড়ি আনা, বাজার করে দেওয়া ছাড়া আর কি কি কাজ কাল থেকে অম্লান এর ভাগে জুটবে ভেবে জানলার দিকে তাকিয়েছিল অম্লান। হর্ণ এর চেনা আওয়াজটাই চেতনা ফিরতেই হঠাত একটা মুখ দেখল সে। খুব চেনা মুখ। ভোলা যায়নি কোনোদিন, এমন একটা মুখ। বুকের ভিতরটা চিন-চিন করে উঠল অম্লানের। যা সে দেখছে, তা সে দেখতে চায়না। কিন্তু বারবার চোখ রগড়ে, নিজেকে চিমটি কেটেও সে দেখছে পুরোটাই বাস্তবে ঘটছে। সে যা দেখছে, তা সত্যি। একশো শতাংশ সত্যি। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে নেমে যায় অম্লান। ফেয়ারওয়েল এর ফুলের তোড়া নেওয়ার মানসিকতা আর নেই তার।
বসে আছে মেয়েটা, স্টেশনের ইয়ার্ডে, মেঝেতে। অবশ্য মেয়ে না, মাঝবয়সি খেপি। কালি-ঝুলি মেখে। কালি-ঝুলি, অসভ্য, বর্বর, অযোগ্য, খারাপ, এরকম হাজারো সব শব্দ অম্লানকে সূঁচ ফোটাচ্ছে যেন। ইশ! কি নোংরা। এত নোংরা কেও হয় নাকি? লম্বা ঘন চুল গুলোতে পাক ধরেছে। সোনালী বর্নের উপর কেও জোর করে যেন কালি লেপে দিয়েছে। লাল, ছেঁড়া, ধূলো পড়া বেনারসী ভরে রাখা পাশের একটা মুখ খোলা ঝোলায়। এক হাতে খাতা, অন্য হাতে পেন। হাসছে, কিছু একটা লিখছে। ঝুঁকে দেখতে যায় অম্লান। গায়ের গন্ধে বমি পায় অম্লানের। তবু, দেখতেই হবে কি লিখছে ও।
দেখতে চেয়ে ঝোঁকা মাত্রই, হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে উঠল পাগলটা। 'গো-ব্যাক, গো-ব্যাক, গো-ব্যাক.........' একই লাইন আওড়ে যাচ্ছে। এতক্ষনে চোখে চোখ পড়তেই অম্লানের কাছে সব পুরোনো ছবি যেন চোখের সামনের স্ক্রিনে একের পর এক পেরিয়ে যাচ্ছে। সেই হাসি, সেই চোখ, সেই চাউনি, কিচ্ছুটি বদলায়নি৷ একদম একই রকম। শুধু অম্লানকে দেখে লজ্জা না পেয়ে এমন গো-ব্যাক স্লোগান দেওয়ার মধ্যেই নতুন কিছু দেখা গেল।
ট্রেনের এনাউন্সমেন্ট শুরু হয়েছে। অম্লানকে উঠতে হবে ওই ট্রেনে। পকেটে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করছে। স্ত্রী ফোন করছে, কোনো প্রয়োজনে হয়ত। ফোনটা হাতে ধরার মত ক্ষমতা নেয় অম্লানের। ফ্ল্যাশব্যাক এ দেখতে পাচ্ছে, মেয়েটি ফোন করছে। অম্লান ফোন তুলেই ধমক দিয়েছে। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, "আমি জানি অম্লান, আপনি আমাকে ভালবাসেন না, কিন্তু আমি খুব বাসি। খুব ভাল বাসি অম্লান। বাবা আমার অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে, আমি তা কিছুতেই মানতে পারছিনা। আমি মরে যাব অম্লান। ভোরের আলো ফোটার আগে আমি পালিয়ে যাব বাড়ি থেকে। আপনার অফিসের নিচে অপেক্ষা করব, ঠিক সকাল দশটায়। আমি জানি আপনি ঠিক আসবেন। উত্তরে অম্লান বলেছিল, পাগলামি না করে বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে করুন। আমি আপনাকে ভালবাসিনা রিয়া। প্লিজ। আজ জ্বালাবেন না। ফোনটা রাখছি।" মেয়েটি শেষবার বলেছিল, আমি কিন্তু কাল আপনার অফিসের সামনে ঠিক অপেক্ষা করব। অম্লান অফিস যায়নি সেদিন ইচ্ছা করেই। কারণ অপ্রয়োজনীয় হ্যাপা সে বইতে ইচ্ছুক ছিল না।
একই চেহারা। শুধু কালি-ঝুলি মেখেছে মুখে। পোশাকের ঠিক ঠিকানা নেয়। হাতে পায়ে বড় নখ। হাসিটাও হুবহু। আবার এক কদম সামনে এগিয়ে যায় অম্লান, কথা বলবে ভেবে। খাতার পাতা ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে অম্লানের দিকে ছুঁড়ে মেরে খেপি হিংস্র চিৎকার করে, গো-ব্যাক, গো ব্যাক......। কাগজটা খুলে অম্লান দেখে, সেখানে হাজার রকম নকশা করে লেখা 'অম্লান'.....। গোটা পাতা জুড়ে, কত ফুল পাতার মাঝে সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা, 'অম্লান'।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন