![]() |
রাত্রির তপস্যা : মৃদুল শ্রীমানী |
১.
সদ্য বিয়ে হয়েছে তনিমার । স্বামী কোমলকে ও খুব ভালবাসে। কেননা , কোমল যে কবিতা লেখে । ওদের বিয়েতে আসতে না পেরে ফোন করে শুভেচ্ছা জানালেন পেটকাটি চাঁদিয়াল এর কবি গায়ক। শুভেচ্ছা জানালেন বেণীমাধবের কবিও । তনিমা তো আপ্লুত । অমন দেবদুতের মত নামী লেখকেরা কোমল কে এত গুরুত্ব দেন? তনিমা কোমলের কাছে আবদার করে - দাও, ওদের সাথে কথা বলিয়ে দাও । কোমল হাসে। বলে – ওরা ব্যস্ত লোক । বিরক্ত করতে নেই ।
তনিমা হঠাৎ খেয়াল করে যতবার ওঁরা ফোন করেছিলেন , প্রতিবার কোনও না কোনও কারণে সে ঘরে ছিল না। সে ঘর থেকে যখনি একটু বের হয়, ঠিক তখনি কবিদের ফোন করার ইচ্ছে জাগে?
তনিমা এখন আর কোমলের সঙ্গে থাকে না।
ডিভোর্সের মামলা চলছে।
২.
কোমলের সাথে তনিমার বিয়ে হয়েছে কয়েকদিন হল । তনিমা কলেজে পড়ায় । বিয়ের আগে ওরা থাকবে বলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেটার অ্যাডভানস এর জন্যে তনিমাও বেশ অনেকটা টাকা দিয়েছিল বিয়ের আগেই । মাকে লুকিয়ে। একটা ফ্ল্যাট এর ভারি শখ তনিমার । আর কোমল দের বাড়িতে হাত পা মেলে থাকার জায়গা নেই বলেই শুধু নয়, ওদের বাড়ির বাথরুমটা একদম খোলামেলা । ল্যাট্রিনে রানিং ওয়াটার নেই । তনিমার খুব সমস্যা হচ্ছিল। তবু কোমল ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাট এ যেতে চায় না। রাগ রাগ করে বলে ' বাবা মা কে ছেড়ে চলে যাবো ?' তনিমা ভেবে পায় না কি বলবে? অতো সুন্দর ফ্ল্যাট তালা বন্ধ ফেলে রাখার জন্যে ভাড়া নিলে? জামা কাপড় রাখা নিয়েও মুশকিল । কোমলের জন্যে যে ছোট্ট ঘরটা বরাদ্দ , সেখানে দেওয়াল আলমারিতে কোমলের পুতুল ভরতি । ছোটো বেলা থেকে যে যা পুতুল দিয়েছে জমিয়ে রেখেছে কোমল । তুলতুলে পুতুলগুলো আহ্লাদী মুখ করে সর্বদা তাকিয়ে থাকে। ওখানে বউকে পোশাক রাখতে দেবে না কোমল । নতুন বউ পোশাক রাখুক অন্য যেখানে খুশি । অন্তর্বাসগুলো নিয়ে সমস্যায় পড়ে তনিমা। মা শিখিয়েছিল ও জিনিস সবার চোখের সামনে মেলে রাখা অভব্যতা । ফ্রিজের আড়ালে অন্তর্বাসগুলো লুকিয়ে রাখে ও । সেদিন ফ্রিজ ডিফ্রস্ট হয়ে অন্তর্বাস গুলো ভিজে গেল। তনিমার চোখে জল এলো । এত বিরুদ্ধতা নিয়ে একটা মেয়ে বাঁচবে কি করে? সে দিন তনিমা কলেজে গেল অন্তর্বাসহীন । কাকলি কি একটা বলবে বলে লাইব্রেরিতে ডেকে নিয়ে গেল । সে অন্তর্বাসহীন কলেজে আসার কথা তুলতেই ক্ষেপে গেল তনিমা । আমার তো বাইরে আবরণ আছে একটা। ভেতরের খবরে পাঁচ জনের দরকার কি? লাইব্রেরি র দেওয়ালে মাও জে দং এর ছবিটা হঠাৎ নড়ে চড়ে উঠলো ।
৩.
কোমলের সাথে বিয়ের দিনটা খুব মনে পড়ে তনিমার। তনিমার বাবা প্রয়াত। বিয়ের আসরে ওঁর একটা ছবি যত্ন করে সাজিয়েছিলেন মা। কোমলের মা আসেন নি । বিয়ে হবে রাতে। বেশ দেরিতে লগ্ন । রেজিস্ট্রিটা আগে হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা এসে রেজিস্ট্রি করে দিলেন। কোমল আর তনিমা দুজনেই সই করলো । কোমলের খুব ভালো লাগছিল। সে বার বার নিজের ক্যামেরায় নতুন বৌয়ের ছবি তুলছিল। আজ কোর্টে বসে থাকতে থাকতে সে সব মনে পড়ে গেল। তনিমার ছোটো দিদার স্কুলের নামকরা ছাত্র কোমল। ছোটো থেকে কোনোদিন কোনও পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন ছাড়া পায় নি । তনিমাও কলেজে পড়ায়। ও জিজ্ঞাসাই করেনি যে কলকাতা কর্পোরেশনে কোমল কি পোস্টে কাজ করে। আর কাজটি স্থায়ী কি না। বিয়ের পরে তনিমা জানতে পারল কোমল ফুটপাথের ধারে গাছ কাটা সুপারভাইজ করে। আর সেটি কন্ট্রাকচুয়াল পোস্ট। মাইনে খুব কম। তবু মানিয়ে নেবে ভাবছিল তনিমা। কিন্তু যেদিন শ্বাশুড়ি মা ওর হয়ে হাত খরচা চাইলেন, সেদিন কি রকম কান্না পেয়ে গিয়েছিল । কেন, কোমল নিজের মুখে চাইতে পারল না? মাকে দিয়ে চাওয়াতে হল কেন? একটা ছেলে বিয়ের আগে মেয়েটিকে নিজের আর্থিক অবস্থা খুলে বলবে না? কোর্ট রুমে এখনও বিচারক এসে পৌঁছন নি । তনিমার কেমন দমবন্ধ লাগছিল ।
৪.
কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল তনিমা । এমন সময় শ্বাশুড়ি মা বললেন - বৌমা , তোমার কাছে হাজারটা টাকা থাকলে দাও তো , ইলেকট্রিকের বিল টা মেটাতে হবে। কোমল বাবার কাছে বসে আনন্দবাজারের শব্দ সন্ধান সমাধান করছিল। গত মাসেও এমনি করে শ্বাশুড়ি মা টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন ইলেকট্রিকের বিল -এর নাম করে। ধার নিচ্ছেন এমন ভান করে টাকা চান; আর শোধ দেবার কথা ভুলে যান । তনিমা শক্ত হয়ে বলল - মা, আমার কাছে এখুনি দেবার মতো টাকা নেই । কোমল মুখ তুলে বলল - তুমি তো মাইনে তুলেছ । তোল নি ? তার কথার কোনও উত্তর না করে তনিমা শ্বাশুড়ি কে বলল - মা, আমি গত মাসেও ইলেকট্রিকের বিল -এর টাকাটা দিয়েছি ।
হ্যাঁ, দিয়েছ । কিন্তু তাতে কি হয়েছে ? ধার নিয়েছি , সুবিধে মতো শোধ করে দেব ।
তিক্ততা এড়াতে তনিমা বলল মা, বিলটা আমায় দিন । আজ আমি কলেজ ফেরতা বাপের বাড়ি যাব । তখন বিল মিটিয়ে দেব।
কোমল বলল - রোজ রোজ তোমার অতো বাপের বাড়ি যাওয়া কিসের? তার কথার কোনও উত্তর না করেই তনিমা শ্বশু্রবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো । বাসে ওঠার সময় মনে পড়লো খেয়ে বেরোনো হয় নি ।
৫.
কোমলের জন্যে যে একচিলতে ছোট্ট ঘরটা বরাদ্দ , সেটি আসলে বাবা মায়ের ঘর থেকে রান্না ঘরে যাবার প্যাসেজ মাত্র। একটি ফ্রিজ আর একটি সিংগল খাট না থাকলে ওটিকে ঘর বলে মনেই হতো না। ওই সিংগল খাটে শুতে হচ্ছে নবদম্পতি কে। ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া স্বত্বেও কোমল সেখানে যাবে না। এদের এই ভেতরের ঘরে দরজা নেই। পরদা দিয়ে আব্রুর কাজ সারা। তনিমা প্রশ্ন তুলেছিল। দরজা না থাকলে চলবে কি করে ? শ্বাশুড়ি মা তনিমার কথায় আকাশ থেকে পড়লেন। কই মা, আমার ত কোনও দিন অসুবিধে হয় নি !
তনিমা ভেবে পায় না একজন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষিকা হয়েও কেন তার শ্বাশুড়ি দাম্পত্য জীবনে শোবার ঘরে দরজার প্রয়োজন বুঝতে পারেন না !
৬.
কোমলকে এখনো শ্বাশুড়ি মা নিজের হাতে খাইয়ে দেন। মায়ের হাতে না খেলে কোমলেরও যেন তৃপ্তি হয় না। এটা ভাল না লাগলেও তনিমা এ নিয়ে কিছু বলে নি। হাজার হোক কোমল তো তাঁরই নাড়ী ছেঁড়া ধন । কিন্তু তনিমার খুব অস্বস্তি হয় যখন মধ্য রাতে ছেলে গরমে কষ্ট পাচ্ছে কি না দেখতে আসেন তিনি। এমন কি মাঝে মাঝে হাওয়া চলবে বলে দু ঘরের মাঝের পরদাটুকুও সরিয়ে দেন তিনি। এখনও কোমলকে তিনি তিন বছরের শিশুটি বলেই মনে করেন। সিঙ্গল খাটে তনিমা ও কোমলের শুয়ে থাকা যেন দুটো পুতুলের পাশাপাশি পড়ে থাকা । কোমলের মধ্যে কোনও হেলদোল দেখতে পায় না তনিমা। বিস্ফোরণটা ঘটে গেল এক রাত্রে। নিজের মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছিল তনিমা। কি করে একটা ছেলেকে বেঁধে রাখতে হয় তাও জানো না? প্রকৃতি মেয়েদের হাতে কত রকম অস্ত্র দিয়েছে তাও জানো না ধাড়ি মেয়ে ? সেদিন তনিমা প্রস্তুতি নিয়েছিল কোমলকে নিজের নারীত্ব দিয়ে বশ করবে। এমন সময় মধ্য রাতে ছেলে গরমে কষ্ট পাচ্ছে কি না দেখতে শ্বাশুড়ি মা ঘরে চলে এলেন। এমন কি ছেলে গরমে ঘামছে কি না দেখবেন বলে আলোটাও জ্বালিয়ে ফেললেন তিনি। ভুলে গেলেন এই ঘরেই একই খাটে তাঁর ছেলের সাথে তার বিবাহিতা স্ত্রীও থাকে । নিঃসীম লজ্জায় দ্রুত হাতে গায়ের কাপড়টা টেনে নিয়ে লজ্জাস্থান আড়াল করে তনিমা। আর দাঁতে নিজের ঠোঁট কামড়ে নিজেকেই ফালাফালা করে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। খানিক বাদে গরম হচ্ছে বলে কোমল পাশের ঘরে বাবা মায়ের কাছে শুতে চলে গেল । তনিমা পড়ে রইল একা।
৭.
কলেজ থেকে ফেরার পথে শ্বশুরবাড়ির স্টপেজে নামলো না তনিমা । বাপের বাড়ি চলে এলো । মা জানতে চাইল - কী হয়েছে ? তনিমা শক্ত মুখে বলল - নিজের বাড়ি থাকতে এসেছি । মা গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন - কী হয়েছে বল মা, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে । এখনও তনিমার মোবাইলের স্ক্রীন এ কোমলের তোলা বিয়ের কনের ছবি । খুব সুন্দর অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ছবিটা । কোমল ফোন করছে। কী ব্যাপার, বাড়ি ঢোকো নি কেন? কোথায় আছ? তনিমা কেটে দিল ফোনটা । পর পর সাতবার ফোন করলো কোমল । প্রতিবার তনিমা ফোন কেটে দিল । এবার ফোন করলেন শ্বশুরমশাই । তিনি চট করে কোনোদিন ফোন করেন নি । তনিমা মোবাইল অফফ করে বালিশে মুখ চেপে চীৎকার করে কেঁদে উঠলো ।
আমি তোমাদের বাড়িতে মানিয়ে নিতে চেয়েছিলাম । তোমরা একটু সুযোগ দিলে না।
পুরনো দিনের ভারি পালঙ্ক বলে তার সমস্ত বুকফাটা কান্না বালিশ বিছানা অক্লেশে সহ্য করল ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন