শান্তিনিকেতন : মৃদুল শ্রীমানী

শান্তিনিকেতন : মৃদুল শ্রীমানী
শান্তিনিকেতন : মৃদুল শ্রীমানী

নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে শমিতার। সে বেঁচে আছে না দুঃস্বপ্ন দেখছে সেটাই মাঝে মাঝে ঠাহর পায় না সে। এই ত সেদিন বিয়ে হল তার সায়নের সাথে । কি চমৎকার হাতের লেখা সায়নের। কেমন কবিতা বলে । ওকে দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল খুব। ওদের বারোয়ারি বাড়ি আর সরকারি কলতলা। বিয়ের পর দুটিতে যাতে ভদ্র ভাবে থাকতে পারে সে জন্যে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হল। শমিতা বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়িকেও তাদের সাথেই ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছিল। তাঁরা যেতে চান নি। সায়ন পর্যন্ত নয়। অথচ ফ্ল্যাট সাজাবে বলে সায়ন টাকা চেয়েছিল। আর মাকে লুকিয়ে তাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছিল শমিতা নিজের হাতে। স্বেচ্ছায়। সায়ন বলেছিল – ব্ল্যাঙ্ক চেক? শমিতা বলেছিল  - হ্যাঁ সোনা। পরে ফোন করে অবশ্য বলেছিল একান্ন হাজার টাকা আছে অ্যাকাউন্টে । ওর বেশি তুমি লিখো না । সবটাকাই সায়ন তুলে নিয়েছিল। আর সেই সায়ন বিয়ের পরে তার কাছে আবদার জুড়ে ছিল একটা ভালো ক্যামেরা কিনে দেবার।ততদিনে অবশ্য শমিতা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সায়নের সাথে থাকবে না । অমন লোকের সাথে জাস্ট থাকা যায় না। সায়ন বার বার তাকে চিঠি লিখে  ফিরে আসতে অনুরোধ করতো । প্রথম দিকের তেমন একটা চিঠিতে সায়ন লিখেছিল – “ তুমি এখনো আমাকে একটা ক্যামেরা আজও কিনে দিলে না সোনা !” তখন নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে শমিতার। সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো ? সে আসলে ঘুমের জগতের মধ্যে তলিয়ে নেই তো? সায়ন লিখেছিল ফিরে আসতে । আর তার মনে পড়েছিল কি অদ্ভুত ভাবে সায়ন মিথ্যে কথা বলে চলে। নিজেকে সায়ন বর্ণনা করেছিল সায়েন্টিস্ট হিসেবে। আসলে কলকাতা করপোরেশনে ফুটপাথের গাছ কাটা দেখাশোনা করে । চুক্তির চাকরি ওর। নো ওয়ার্ক , নো পে। নিজের ওপর রাগ করেছিল শমিতা – কেন ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখতে চায় নি? কেন বলে নি  - ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন দেখাও? আশ্চর্য একটা মায়া ঘেরা মুখ, চমৎকার হস্তলিপি আর কবিতা চর্চার দখল শমিতাকে গ্রাস করেছিল, বুঁদ করেছিল। কিন্তু শমিতা দেখল যে বিয়ে হয়ে যাবার পরে ফ্ল্যাটে যাবার নাম করতে চায় না সায়ন। এমন কি মনে করিয়ে দিলে রেগে ওঠে । বিরক্ত স্বরে বলে বাবা মা কে ছেড়ে চলে যাব? আচ্ছা অমন খোলামেলা কলতলায় স্নান করা সাজে কলেজ শিক্ষিকার ? ল্যাট্রিনে রানিং ওয়াটার না থাকলে চলে? তাদের একটা প্রাইভেসি পর্যন্ত নেই। প্রাইভেসির বোধটাই নেই। ওদের সঙ্গে থাকবে না মনস্থ করে বাপের বাড়ি চলে এসেছিল শমিতা। তখন থেকে রোজ ফিরে আসার তাগাদা দিয়ে চিঠি । আচ্ছা চিঠি কেন? নিজে আসতে পারে না শ্বশুর বাড়ি ? এমন কি মা যখন জামাইকে জামাইষষ্ঠীতে আশীর্বাদ করে হাজার টাকার নোটটা দিয়েছিলেন, সেটা সে হারানোর ভান করলো , আর এমন করতে লাগলো যেন তার টাকা শমিতা হাত সাফাই করেছে। এমন অবিশ্বাস অসম্মানের মধ্যে থাকবে না বলেই শমিতা সরে এল । একদিন গেল নিজের গয়না গুলো আনতে। শাশুড়ি খুব বাধা দিলেন । শমিতা নিজের সার্টিফিকেট আর ভোটার কার্ড ছাড়া কিছু ফিরিয়ে আনতে পারে নি। তার পর কোর্টের সমন । সায়নেরা তার বিরুদ্ধে ক্রিমিন্যাল কোর্টে কেস করেছে। অভিযোগ দিয়েছে ডাকাতির । আর বয়স্কা বৃদ্ধা শাশুড়িকে লোক লেলিয়ে ধর্ষণ করানোর চেষ্টা । নিঃসীম ঘৃণায় ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যেতে থাকে । শমিতা সেই চিঠির তাড়া বের করে যেখানে সায়ন লিখেছে – তুমি আর আমি সেই শান্তিনিকেতনে কি চমৎকার ঘুরেছিলাম, সে কথা তোমার মনে আছে সোনা ?
জলভরা চোখে আবছায়ায় একটা শান্তিনিকেতন হাতড়ে মরে একটা বোকা মেয়ে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.