অন্য মা মেয়ের গল্প : সোনালী মুখার্জী |
মনি ..এই মনি ..ডাকতে ডাকতে ঘরে এলেন অনিতা দেবী ..দেখলেন অকাতরে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা ..বড্ডো মায়া হলো ওকে দেখে ..আর ওর শোবার ধরণ দেখে মনে মনে একটু হাসলেন তিনি ..তারপর আবার ডাকলেন ,এবার মনি ধর ম র করে উঠে বসলো ..উঠেই ঘড়িতে দেখলো 7.30 বাজে ..উউফ এত বেলা হয়ে গেলো ..মা তুমি আমায় আর একটু আগে ডাকতে পারলে না ??অনিতাদেবী বললেন তোকে আগেও একবার ডেকেছি ..তাড়াতাড়ি কর মা ..নাহলে 9.05 এর লোকাল টা পাবি না ..ও তাড়াতাড়ি রেডি হতে চলে যায় ..
মনিদিপার রেলের চাকরি ..উঠেই চটজলদি নিজের বেক্তিগত কাজকর্ম গুলো মিটিয়ে একবারে স্নান সেরে জামাকাপড় পরে বেড়িয়ে আসে ..এসে দেখে মা টেবিলের ওপর ভাত বেড়ে রেডি হয়ে বসে আছে অন্য দিনের মতোই ..ও চুল আঁচড়াতে থাকে শাড়ির পিন আপ ঠিক করতে থাকে ...আর মা ভাত মেখে একগাল করে ওর মুখে গুঁজে দিতে থাকে ..এভাবেই ওর খাওয়া শেষ হয় প্রায় দিন ই ..ও অনিতা দেবীর দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকায় ..সত্যি এমন মা কি সবার ভাগ্যে জোটে ???
আজ ও বেরিয়ে দেখতে পায় অরুন কে ..ঠিক ওর যাবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ..ওকে দেখেই অরুন এগিয়ে আসে ..বলে চলো মনি ..কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি ..মনি বলে ..কেন করছেন অরুণদা ??কে বলেছে আপনাকে অপেক্ষা করতে?? যা বলার আমি তো অনেকদিন আগেই বলে দিয়েছি ..আমার পক্ষে বিয়ে করা একদম ই সম্ভব নয় ..মাকে একা ফেলে আমি কোথাও যেতে পারবো না ..তবু অরুন জিজ্ঞাসা করে ..মা তো আমাদের সঙ্গেই থাকবে ..তবু তুমি __অরুন কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মনি একটা অটো তে উঠে বসে ...
যেতে যেতে পুরোনো স্মৃতি গুলো মনের ভিতর নাড়া দিয়ে যায় ..কিছু স্মৃতি আবছা হয়ে সেখানে অরুনের মুখ টা প্রকট হয়ে দেখা যায় ..চমকে ওঠে মনি ..এ কি ভাবছে সে ??এ তো অন্যায় ..এ তো পাপ ..আর মা ???সঙ্গে সঙ্গে মনটা শক্ত করে নেয় ও ..মনকে বোঝায় এটাই ওর জীবনের পরিণতি ...
খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে মনি ..ফিরে দেখে মা ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে ...এই সময় তো মা কখনো শুয়ে থাকে না ??হয় রান্না ঘরে না হয় টিভি নিয়ে বসে .... আজ কি এমন ঘটলো ??তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে যায় মনিদীপা ..মা মাগো
কি হলো তোমার ??অনিতা দেবী উঠে বসেন ..দু চোখের কোনে জল টলটল করছে ..মনি খুব অসহায় হয়ে পড়ে মায়ের চোখে জল দেখে ..বলে কি হয়েছে মা ??মনির মুখটা দুহাতে ধরে অনিতা দেবী বলেন মনি মা ..আজ আমরা দুজন আছি ..কিন্তু আমার তো বয়স হচ্ছে বল ..কদিন ই বা বাঁচবো ??তোর এইটুকু বয়স ..কি করবি তুই জীবনটা ??আমি বলি কি তুই বিয়ে কর ..এই কথায় ছিটকে সরে যায় মনি ..বলে ..মা কি বলছো তুমি ??তুমিও জানো ??আমিও জানি ...এটা কখনো সম্ভব নয় ..আমি পারবো না ..আর তাছাড়া তোমায় ছেড়ে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না ..প্লিজ মা ..এমন অনুরোধ তুমি আর আমায় কখনো কোরো না ..এখন চলো তো খেতে দেবে ??জোর ক্ষিদে পেয়েছে আমার ..ব্যাপার টা হালকা করে দিয়ে মনি নিজের ঘরে চলে যায় ...
কিন্তু মন কি সত্যি হালকা হয় ??রাতে খাওয়া দাওয়া র পর ছাদে এসে দাঁড়ায় মনিদিপা ..ও অন্ধকারে ওর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে ..মনে পড়ে যায় সব ..চোখের সামনে ভেসে ওঠে হারানো সেই দিনগুলো ..
সূর্য হ্যা সূর্যের সাথে পরিচয় ওর কলেজেই ..সেই বছর ই ও 1 year এ ভর্তি হয়েছে আর ওই বছর ই কলেজের একটা অনুষ্ঠানে ওর গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত "এসো এসো আমার ঘরে এসো ..আমার ঘরে ..বাহির হয়ে এসো এসো ..যে আছো অন্তরে "..এই গানটা আর সকলের মতো সূর্যের ও মন কেড়েছিল সেদিন ..অরুন দা আর সূর্য দুজনেই তখন 3year এর ছাত্র ..প্রায় কলেজ ছাড়ার মুখে.. ওরা নিজেরাই এসে পরিচয় করেছিল ওর সাথে ..তারপর আলাপ পরিচয় থেকে সূর্যের সাথে মন দেয়া নেয়া র পালা চলতে বেশি দেরি হয়নি মনির ..দুজনে বাঁধভাঙা জলস্রোতের মতো ভেসে যাচ্ছিলো একে অপর কে নির্ভর করে ..
তিনটে বছর কোথা দিয়ে দেখতে দেখতে পার হয়ে যায় ..এখন সূর্য সদ্য চাকরি তে ঢুকেছে ..এত তাড়াতাড়ি যে সূর্য চাকরি পেয়ে যাবে কেউ ভাবতেই পারে নি ..যাই হোক রেলে চাকরি ..দুজনেই খুব খুশি ..এদিকে মনির ও পড়াশোনা প্রায় শেষ ..আর ও মামারবাড়িতে আশ্রিত ..মা বাবা হীন মামারবাড়িতে আর পড়াশোনার কথা বলাও নিজের আত্মসম্মানে লাগে মনির ..তবে সূর্য কিন্তু বলেই রেখেছে ..মনি ..আমার কাছে এসে তোমায় কিন্তু পড়াশোনা আর গান দুটোই চালিয়ে যেতে হবে ..কোনোটাই ছাড়া যাবে না ..মনি এখন সেই স্বপ্নে বিভোর থাকে ...
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ ই সূর্য তার মাকে নিয়ে হাজির হয় মনির মামার বাড়িতে ..মনির মামারা তো হাতে চাঁদ পেলেন এমন পাত্র পেয়ে ..কথা বার্তা বলে প্রায় নিখরচায় তারা ভাগ্নি কে পাত্রস্থ করলেন এক বৈশাখের গোধূলী লগ্নে ...
বাড়িতে তিনটি মাত্র প্রাণী ..সূর্য সে আর সূর্যের মা ..সূর্য office এ বেরিয়ে যাবার পর ওরা দুটি তে বন্ধুর মতো চারিদিকে ঘুরতে থাকে ..কখনো সিনেমা ,কখনো শপিং ,কখনো রেস্টুরেন্ট ,দুজনে যেন হাতে চাঁদ পায় ..সারাদিন হাঁসি গান আনন্দে কেটে যায় দুটো বছর ...
তার পর হঠাৎ একদিন আসে সেই অভিশপ্ত দিনটা ..অন্যদিনের মতো সেদিন ও সূর্য ওর বাইক টা নিয়ে অফিস এ বেরিয়ে গেলো ..গলিটা পেরিয়ে রাস্তায় বাঁকের মুখটাতে ই একটা লরি যমদূতের মতো এসে সূর্য কে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে ওর মাথার ওপর দিয়ে চাকাটা চলে গেলো ..কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সূর্যের রক্তাক্ত নিথর দেহটা রাস্তায় পড়ে রইলো ..আর পথ চলতি মানুষের ভিড়ে রাস্তার চারিদিক ভরে উঠলো...
এর পর একটা বছর নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সূর্যের চাকরি টা মনি ফিরে পায় .. সে আর তার সূর্যের মা অনিতাদেবী দুজনে শক্ত করে হাত ধরে জীবনের বাকি পথটা হাঁটার কথা ভাবে ..
কিন্তু তাল কেটে যাচ্ছে যে বার বার ??কেন অরুন দা বারেবারে তার সামনে ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে ভরিয়ে দিতে চাইছে তার জীবনটা ??কেন ??তার মনে সূর্যের জায়গা টা সরে গিয়ে অরুনের জায়গা টা দৃঢ় হচ্ছে ??কেন ??মনের মধ্যে এক অসহ্য কষ্ট তোলপাড় করছে ??কেন রাতে দুচোখ বেয়ে অকারণে নামে অস্রুধারা ??কিসের কারণে ??তবে কি মনি নিজেও মনে মনে অরুনের প্রতি ..??না না ..এটা ভাবাও যে পাপ ..এ তো অন্যায় ..তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে ও ......রাত প্রায় তখন 1 টা ..
আগামী পরশু সূর্যের দ্বিতীয় বাৎসরিক কাজ ..নিমন্ত্রিত তেমন কেউই নেই ...অরুন সূর্যের বন্ধু হবার সুবাদে এই বাড়িতে ওর ছোটো থেকেই যাতায়াত ..তাই শুধু তাকেই বলা ..অনিতাদেবী নিজেও অরুনকে ছেলের মতোই স্নেহ করেন ..সূর্য মারা যাবার পর সেই স্নেহ টা যেন একটু বেড়েছে ..অরুন ও এই বাড়িতে খুব ই স্বচ্ছন্দ ..শুধু মনি যেন তার সাথে একটু দূরত্ব বজায় রেখেই চলে ..এটা অনিতাদেবীর ও নজর এড়ায় না ..তবু উনি এ ব্যাপারে কিছুই বলেন নি কাউকে ...
সেদিন ই সন্ধে বেলা মনি নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলো ..অরুন বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করে .. আসবো মনি ??মনি উঠে বসে ..বলে আসুন ..অরুন এসে চেয়ার টা তে বসে ..মনির দিকে তাকায় ..অনেক না বলা কথা ভিড় করে মনের মধ্যে ..কিন্তু কিছুতেই মুখে আসে না ..তবু অরুন আবার জিজ্ঞাসা করে ...কিছু ভাবলে মনি?? আর একবার ভাবো না ??আমাদের জীবনটা নিয়ে ??মনি চোখ তুলে তাকায় অরুনের দিকে ...বলে ..অরুণদা আপনি বার বার এসব কথা বলে আমায় দুর্বল করে দেবেন না ..আমি আর আমার বিয়ের কথা ভাবতে চাই না ..যা একবার আমার ভাগ্য কেড়ে নিয়েছে তা এর দ্বিতীয় বার জড়াতে চাই না ..
অরুন এসে মনির কাছে বসে ..বলে এই ভাবে নিজের জীবন টা শেষ করে দেবে মনি ??একবার ও তোমার আমার কথা ভাববে না ??আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো ...তোমার চোখে আমি আমার প্রতি ভালোবাসা দেখেছি ..যদি না দেখতাম ..কখনো তোমায় বিরক্ত করতাম না ..please...মনি একটু ভাবো ??মনি দৌড়ে বেড়োতে যায় ঘর থেকে ..যেতে যেতে বলে ...না না অরুন দা ..আমায় আপনি এভাবে ডাকবেন না ..আমি যে সব জোর হারিয়ে ফেলছি ...বাইরে বেরিয়েই মনি চমকে ওঠে ..সন্ধ্যার বাতিটা নিয়ে মা যে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ??..মনি দৌড়ে মায়ের পাশ দিয়ে ছাদে চলে যায় ..ধীর পায় অনিতাদেবী ঘরে ঢোকেন ..দেখেন অরুনকে ..মাথা নিচু করে বসে আছে অরুন ..অনিতাদেবী অরুনের মাথায় হাত রাখেন ..চমকে চোখ তুলে তাকায় সে ..অনিতাদেবী বলেন ..তুই বাড়ি যা অরুন ..আমি দেখছি ..এতদিনে একটা সুযোগ পেয়েছি ..এটা আমি কিছুতেই হাত ছাড়া করবো না ...
অরুন চলে যাবার পর অনিতাদেবী আস্তে আস্তে মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ান ..মনির মাথায় হাত রাখেন উনি ..দেখেন বাঁধভাঙা বন্যা র মতো দুচোখ ভাসিয়ে জলের ধারা ঝরে পড়ছে মেয়ের চিবুক গলা ভাসিয়ে ..অনিতাদেবী বলেন এইভাবে শুধু শুধু কষ্ট পাবি মনি? ?নিজেও পাবি ..ছেলেটাকেও দিবি ??মনি দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে ,বলে ..না মা ..আমি কিছুতেই পারবো না ..তোমায় ছেড়ে থাকতে আমি কিছুতেই পারবো না ..অনিতাদেবী মেয়েকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলেন ..দূর পাগলী ??ছেড়ে কোথায় যাবি ??কাছেই তো থাকবি ..
তবু মনি কিছুতেই রাজি হয় না ..শেষে অনিতাদেবী বলেন ..তুই যদি রাজি না হোস তবে আমি আজ থেকে জলস্পর্শ করবো না ..এই বলে রাখলুম ..বলে উনি চলে গেলেন ...মনি কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ..মা কি সত্যি এমনটা করতে পারবে ??
বোঝা গেলো তার পরের দিন থেকেই ..সত্যি মা সমস্ত খাওয়াদাওয়া বন্ধ করেদিয়েছে ..শেষে মায়ের জেদের কাছে মনিকে হার মানতেই হলো ..আগামী শ্রাবনে ওদের চার হাত এক করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ..
আজ মনির বিয়ে ..আজ মেয়েটা তার কাছ থেকে চলে যাবে ..পায়ে পায়ে অনিতাদেবী সূর্যের ছবিটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ..ছেলের ছবিতে বড়ো একটা রাজনীগন্ধার মালা পড়ানো ..তার সুবাসে সারা ঘর মো মো করছে ..মনিকে তিনি কখনো বৌমা ভাবেন নি ..সেই প্রথম দিন থেকেই .....নিজের মেয়ে হিসেবেই ওকে বুকে ঠাঁই দিয়ে ছিলেন ..বৌমা ভাবলে বোধয় এতবড়ো কাজটা তিনি করতে পারতেন না ..সূর্যের ছবিটার দিকে তাকালেন ..দেখলেন ছবির কাঁচের মধ্যে দিয়েও সূর্যের উজ্জ্বল চোখ দুটো ..ছেলেটা যেন হাঁসছে... আর তাকে বলছে .."মা তুমি পেরেছো "তিনি এক দৃষ্টে সূর্যের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন ..
হয়তো নিজের সবটুকু সূর্যের সাথে ভাগ করে নিতে ???
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . সমাপ্ত
বিঃদ্রঃ :জানি না এমন শাশুড়ী মা হয় কিনা ..আমার অন্ততঃ জানা নেই ..তবু গল্পটা লিখলাম ..হতেও তো পারে লাখে 1টা ??বন্ধুরা জানা থাকলে অবশ্যই আমায় জানিও ..😁😁..
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন