![]() |
তীর্থঙ্কর মৈত্র |
ঔপন্যাসিক অমিতকুমার বিশ্বাস তার চেতনঅবচেতনে বিঁধে থাকা ‘সময়ের কাঁটা’ একটি একটি করে যেন খুলে রেখেছে তার ‘ঙ-বৃত্তান্ত’ উপন্যাসটিতে। এটি পড়তে পড়তে বারবার মনে উঠে এসেছে ডাডাইজমের প্রথমার্ধের সেই কথাগুলো, যেভাবে মনোজগতে নানান বিষয় কিংবা দৃশ্যাবলি উঠে আসে, তাকে হুবহু তুলে এনে শিল্পে ব্যবহার করা। যা ঠিক পরিশোধিত রূপে নয়, বরং আকরিক রূপেই ব্যবহৃত। অমিতের ‘ঙ-বৃত্তান্ত’র স্রোত অনেকটা সেইরকমই প্রবহমান। অমিত কখনও সময়ের ভাষ্যকার, কখনওবা সময়ের দ্রষ্টা। সুররিয়েলিজম, সিম্বলিজম, ইমেজিজমের আশ্রয়ে সে গড়ে তোলে সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র জগৎ যার দ্বারা সে গর্ভস্থ জমজের ভিতরও দেখায় দখলের লড়াই, যে লড়াই ভূমিষ্ঠ হবার পরেও বর্তমান, যে লড়াই পাঁচশো বছর পূর্বে ইছামতীর তীরে লুঠ করতে আসা জমজ পাঠানভাই ফিদা ও জাফরের ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব দখলের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, আবার তা আছে বর্তমান সময়ের জমজভাই কেউটে ও মাধোর ভিতর, যারা প্রকৃতঅর্থে সাপ ও নেউল, যাদের ভিতর যুদ্ধটা সব সময় উপস্থিত, যেখানে নেউলের কাছে সাপের পরাজয় নিশ্চিত। তবু সাপ যুদ্ধে নামে। এ যেন চার্লস ডারউইনের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, যেখানে এই তত্ত্বের বিষমপ্রজাতির সঙ্গে সংগ্রাম ও স্বপ্রজাতির সঙ্গে সংগ্রাম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফিদা ও জাফর, মাধো ও কেউটে প্রত্যেকেই প্রতীকমাত্র। পৃথিবীর সকলেই যেন পরস্পরের জমজ, সেখানেই গোপন লড়াই টিকে আছে সকলের ভিতর।
পদ্মার নষ্ট চোখের বর্ননা 'ঙ-বিত্তান্তে' এভাবেই উপমায় ধরে অমিত।
--“কালোজামের মতো পদ্মা। রসে টইটম্বুর। চুষে-চুষে রস নেবার পর জিভটা কেমন বেগুনি হয়ে যায়, প্রাণটা ভরে ওঠে রসে, তেমনই। বাঁ-চোখটা খেজুরগাছের চোখের মতো শান্ত। কোনও সুদক্ষ গাছি ছ্যানাদা দিয়ে এঁকেছে ধীরে-ধীরে। কিন্তু ডান মণিটা হাঁড়িতে ভেঙে-যাওয়া সেদ্ধ কুসুমের মতো অসহায়। ঈশ্বর মণিটা সেদ্ধ করেই পাঠালেন তবে? নুনঝালতেল মাখিয়ে চটকে তারিয়ে-তারিয়ে উপহাস করবে কারা? হা ঈশ্বর, তুমি সুন্দর বোঝো না?”
ছ’এর দশক ও তার পূর্বে যেসব চরিত্র গল্প-উপন্যাসে আসত, সেসবের নাম, চরিত্র ও কাহিনি অধিকাংশই উচ্চবর্ণের। কিন্তু পরবর্তীকালে অনেকেই তা থেকে বেরিয়ে আসলেও সমাজের মধ্যে যারা অবহেলিত, এই অবহেলিতদের মধ্যেও একশ্রেণির তুচ্ছতাচ্ছিল্য মানুষ আছে, তাদের নিয়ে প্রথম কাজ বোধহয় অমিতই করল। এখানেই সে নতুন। এখানে প্রায় প্রতিটা কাহিনির আবর্ত এদের নিয়েই। পরিবার বা পাড়ার মানুষের দেওয়া নাম যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নতুন নতুন শিরোপা। নামের মধ্যেই যেন ধরা আছে গোটা মানুষটি, যারা বহমান সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। সময়কে তারা বারবার ধরতে যাচ্ছে, কিন্তু সময় যেন তাদের ততোধিকবার ছিটকে ফেলে দিতে চাইছে মূলস্রোতের বাইরে। এ যেন এক তেজি ষাঁড়ের পিঠে জোর করে রুগ্ন এক ল্যাংড়াকে তুলে দিয়ে মজা নিচ্ছে সময়ের গ্যালারিতে বসে থাকা অগনিত চেনাঅচেনা মুখের দর্শক। উত্তরাধুনিক নিম্নশ্রেণির এইসব তুচ্ছ ও অতিতুচ্ছ চরিত্রের নাম পূর্বে কেউ ব্যাবহার করেছেন কি? উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করছি ডেরি, কেন্তার, ডেগা, ঘেনি, হাগোদা, ছড়াদা, ফক্কা কিংবা নানিদের নাম। এদের মধ্যে ডেরি, যে কিনা স্বামীর মৃত্যুর পর বাঁচবার তাগিদে বাজারে মাছকুটে জীবিকা অর্জন করছিল, মাছের কাঁটার খোঁচায় তার এক হাতে পচন ধরে, ফলে কবজির নীচ থেকেই হাতটা কাটা পড়ে। আর তখনই সে আরও এক ধাপ নীচে তুচ্ছাতিতুচ্ছ চরিত্রের রূপ নেয়।
‘ঙ-বৃত্তান্তে’ দেখি দেশভাগের দুঃসহ যন্ত্রণার প্রকাশ, তৎসহ মরিচঝাঁপির ষড়যন্ত্র, বর্ণবৈষম্য, এমনকী সমসাময়িক ধর্মীয় উন্মাদনা ও তাকে ঘিরে রাজনীতি যা সুপ্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে, ইছামতী তীরের অতীত কাহিনিতেই তার ইশারা সুস্পষ্ট।
দেবীদুর্গার প্রচলিত আর্য মিথ ভেঙে অনার্য মিথে দেখানো হয়েছে এখানে। অসুররাই প্রকৃত নায়ক। তবু তারা সমাজের চোখে ঙ।
‘ঙ বৃত্তান্তে’ কোথাও কোথাও অমিতের আর্তি আছড়ে পড়ে শাসকের উদ্দেশে। এই ঙ সময়ের থেকে আসা দুঃখ ও যন্ত্রনাবোধ গুলোকে যখনই সে কাউকে বলতে পারে না, বোঝাতে পারে না, ঠিক তখনই সৃষ্টি হয় 'হরিহরের', যার উদ্দেশেই তার সংলাপগুলো উচ্চারিত হয় সমস্ত দুঃখ যন্ত্রনাগুলো থেকে উপশমের জন্য। এটা তার ছোটগল্পেও পেয়েছি, যেখানে ওই 'হরিহর'ই একমাত্র শ্রবণকারী। এই ‘হরি’ আর ‘হর’ আসলে সৃষ্টির পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তার মিলিত এক রূপ, তাঁকেই যেন এসব জানানো। আমাদের অর্জিত শতশত বছরের যেসব অভিজ্ঞতা, লৌকিক বিশ্বাস, লৌকিক দেবদেবী, ব্রতকথা, যা আমরা হারাতে বসেছি, এখানে লেখক যেন সেইসবের কাছেই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
‘ঙ বৃত্তান্ত’ আসলে এই 'ঙ' সময়ের এক যাপনবৃত্তান্ত, যা ডেরি বা ডেগার মতো নামপ্রাপ্ত এই সময়। উপন্যসটি পূর্বপরিকল্পিত নয়, অমিত যেন চিত্রনাট্য ছাড়াই সময়ের মধ্যে ক্যামেরা নিয়ে বসে আছে, তাতে ধরা পড়ছে সমসাময়িক গাছ আন্দোলনের বিষয় ও নানা কথা ,ঘটনা । তাকে গোদারের মতো আপাত এলোমেলো বোধ হলেও শেষমেশ সময়ের সত্যই তার কলমে ধরা পড়ে।
উপন্যাসটি নির্মাণের ক্ষেত্রে মনে হয় অমিত যেন ইনস্টলেশন আর্টবাদীদের মতোই। উপন্যাসের নায়িকা প্রতিমার মূর্তি বারবার এখানে নির্মিত হয়, আবার বারবার ভেঙেও ফেলা হয়। এই নির্মাণ আর বিনির্মাণে প্রতিমা একটি সার্থক চরিত্র। এভাবে চরিত্র নির্মাণে প্রতিমার বোবা কালা স্বামী ও যে তাঁকে ছাড়িয়ে যায় ।
এই উপন্যাসের পরতে পরতে আবিস্কারের হাতছানি রয়েছে। কবিতার মতো ইশারা ও ইঙ্গিতে উপন্যাসটি পরিপূর্ণ ও সার্থক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস পুনঃপুন পাঠে এটির নতুন নতুন দিক উন্মোচিত করবেন ভবিষ্যতের নব নব পাঠকেরা। পরিশেষে এই উপন্যাস যাঁরা ছাপলেন সেই কবিতা আশ্রমের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আমার সৌভাগ্য ও আনন্দ যে বাংলা গদ্য সাহিত্যের এমন এক বাঁক দেখে যেতে পারছি।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন