নবী নন্দিনী, শুদ্ধ পাবক শিখা : মৃদুল শ্রীমানী

মৃদুল শ্রীমানী
নবী নন্দিনী, শুদ্ধ পাবক শিখা

সেই যে দেশটা, যক্ষপুরী, সেখানে কোনো সময় মানুষ থাকত জন্মভূমিতে। লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে সেই সব সাধারণ মানুষকে টেনে আনল যক্ষপুরীর খনিতে। সেখানে কীটপতঙ্গকে হার মানিয়ে সারাদিন খনি থেকে সোনার আকরিক তুলে আনার কাজ। কাজে ফাঁকি দেবার কোনো সুযোগ নেই। কোনো ছুটি নেই, অবসর নেই, নেই শান্ত মনে চারিদিকে চোখ মেলে দেখার সময়। যক্ষপুরীর প্রশাসনের নাম সর্দারতন্ত্র। ছোটো সর্দারের উপর মেজো সর্দার, তার মাথায় বড়ো সর্দার। সর্দারি একটা ব্যবস্থা। নিজের মনুষ্যত্বের কোমল শ্যামল সরল যা কিছু, লোভ আর সন্দেহের ধোঁয়া ঘেরা চুল্লিতে ঢেলে দিয়ে তবে সর্দারি। রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিখুঁত প্রশাসক ছাড়া আরো কিছু গুণী মানুষ লাগে। যেমন বিজ্ঞানী ও নানা বিদ্যার বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক,অধ্যাপক । 

যক্ষপুরীর নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় নানা রঙের ধুতি চাদর বা আলখাল্লার নিচে এরা সবাই এক একটা সর্দার। এই সর্দারি ব্যবস্থার ব্রত হল হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স এর গা থেকে মনুষ্যত্ব নামে জিনিসটাকে ঝেঁটিয়ে পাঁশগাদায় ফেলা। তার পর সেই না-মানুষী দুপেয়েকে দিয়ে যক্ষপুরীর সোনার ভাঁড়ার বাড়ানো। তবু কারো কারো মধ্যে ভুলে থাকা মানুষী অভিজ্ঞান উঁকিঝুঁকি মারলে তাকে শায়েস্তা করার বিস্তর ব্যবস্থা। সেজন্যে মন্দিরে মসজিদে গির্জায় নাম গানের ঢালাও আয়োজন আছে। তাতে না শানালে, মদ ও মাদকের নানা আসর। তার পরে যদি কেউ কুঁই কুঁই, কেঁউ কেঁউ, ঘেউ ঘেউ, ঘেঁক করে ফেলে, তার জন্যে চাবুক আছে। আছে অস্ত্রাগার। যক্ষপুরীর নির্মানুষিক ব্যবস্থায় মন্দির মসজিদ গির্জার পাশেই মদের ভাঁড়ার আর অস্ত্রাগার। এই তিন মোক্ষমের সহাবস্থান যক্ষপুরীর ব্যবস্থাকে এক অসাধারণ সুষমার ঠিক বিপ্রতীপে রেখেছে। কীর্তনবাগীশ ধর্মগুরুর জপের মালা, তসবি খানা যে সুতোয় তৈরী, সর্দারদের চাবুক পর্যন্ত সেই এক অভিন্ন অদ্বিতীয় সুতোয় বানানো। যক্ষপুরী এক আশ্চর্য ব্যবস্থা। 

মানুষের পিতৃদত্ত নাম ভুলিয়ে এখানে তাকে সংখ্যা বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। গাঁয়ে আপন পরিবেশে যে ছিল ফাগুলাল, সে তার রঙিন অস্তিত্ব হারিয়ে এখানে লিকলিকে ৪৭ ফ। যে ছিল বিশু, বিশ্বাস আর ভালবাসা কেড়ে নিয়ে তাকে যক্ষপুরী দাগিয়ে নিয়েছে ৬৯ ঙ বলে। এখানে মেয়েরাও সরলতা হারিয়ে বসেছে। স্বামীর সাথে ঘর নেহাত করতে হয়, তাই করা; নইলে আমোদ আবদার আশনাই, যা কিছু সর্দারদের দিকে তাকিয়ে। 

তবু এইখানে এক মানবী দেখা দেবেন। দেখা দেবেন অগম পারের দূতী হয়ে। তিনি আনবেন শুদ্ধ পাবক শিখা। বিপ্লবের আগুন জ্বেলে অগ্নিশুদ্ধ করে নেবেন নন্দিনী রক্তকরবী।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.