রাধারমণের শেষ দিন : দেবাশিস দে

রাধারমণের শেষ দিন : দেবাশিস দে
রাধারমণের শেষ দিন : দেবাশিস দে

    রাধারমণবাবু আজ মারা যাবেন। কাল দুপুরে ডাক্তার পরিতোষ ভদ্র সেই রকমই বলেছেন। অবশ্য পরিতোষ ভদ্র  রাধারমণের নাড়ির ওপর ভরসা করেই বলেছেন।
    একাত্তর বছরের রাধারমণবাবুর এক বছর হল একটি কিডনি নষ্ট হয়েছে। কিছুদিন হল আর একটাও নষ্ট হয়েছে।
    তিন মেয়ে, দুই ছেলে রাধারমণবাবুর। বড় মেয়ের আমেরিকায় বিয়ে হয়েছে, সে এসেছে দশ দিন হল। জামাই কালকের ফোন পেয়ে আজ সকালে পৌঁছেছে। মেজ মেয়ে আর জামাই দুজনেই শিলিগুড়ি গভরমেন্ট হাসপাতালের ডাক্তার। ইচ্ছা থাকলেও ছেলের পরীক্ষার জন্য তারা আসতে পারেছেন না । তবে শ্রাদ্ধে  অবশ্যই আসবে বলে ফোনে জানিয়েছে। ছোট মেয়ে বাড়ির কাছেই থাকে। সে কাল ফোন পাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। আজ সকাল থেকেই থেকেই সে শুধু কাঁদছে। বড় ছেলে ইন্দ্রজিৎ রাষ্ট্র্যয়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, আজ ভেবেছিল অফিস যাবে না। কিন্তু বারোটা পর্যন্ত দেখে অফিস বেরিয়েছে। বলে গেছে তেমন কিছু বুঝলে মোবাইলে ফোন করতে। ছোট ছেলে বিশ্বজিৎ পেশায় ইঞ্জীনীয়ার। খুব ভেবে চিনতে কাজ করে। আজ অফিসে যায়নি। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, বাড়ির হিসেব আর যেখানে যেখানে বাবার নাম আছে, ওই সব পেপার  নিয়ে বসেছে। রাধারমণ বাবুর স্ত্রী সবিতা দেবী ঘরের এক কোনে বসে কেঁদে যাচ্ছেন। বড় মেয়ে আর দুই বৌ রান্না নিয়ে ব্যস্ত। ইন্দ্রজিৎ আর বিশ্বজিৎ-র একটি করে প্রায় সমবয়েসী ছেলে তন্ময় আর সম্বিত দাদুকে খুব ভালো বাসে। ওরা  সকালেই শুনেছে দাদুর আত্মা আজ ভগবান তাঁর রথে নিয়ে  যাবে। ওরা জানত এই রখম হয়  কিন্তু চোখের সামনে সে জিনিস দেখার কৌতুহলে তারা সকাল থেকে দাদুর পাশে বসে আছে। বাইরের ঘরে একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে আই ব্যাঙ্ক থেকে রাধারমণ বাবুর চোখ কালেক্ট করবার  জন্য দুই ভদ্রলোক হাতে এটাচি নিয়ে বসে আছেন। বিশ্বজিৎ মাঝে মাঝে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন। রাধারমণ বাবুর এক গুরুভাই সামনে ছোট টুলে গীতা রেখে পাঠ করে চলেছেন। কাল ডাক্তার ভদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে ইন্দ্রজিৎর সঙ্গে যখন ফিসফিস করছিল, তার দুই- একটা কথা রাধারণ বাবুর কানে গিয়েছিল – ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম ...কাল দুপুরটা কাটে কিনা দেখুন...’।
    রাধারমণ কাল রাত থেকে আস্তে আস্তে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছে, কাল রাতে ঘুম হয়নি। সকালে বিশ্বজিৎকে বলেছিল তার লেখা সব কবিতা, গল্প, উপন্যাস বিছানায় দিতে। সেইমত বিশ্বজিৎ দিয়েছিল। তাতে একবার চোখ বুলিয়েছে রাধারমণ। পুরনো দিনের কথা মনে হচ্ছে তার। সেই ছোটবেলার কথা, কৈশর...স্বাধীনতার জন্য মিটিং মিছিল.....বিয়ে...ইন্দ্রজিৎ,বিশ্বজিৎ...। মাঝে মাঝে  দুচোখ ভিজে উঠছে জলে।
    এখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হচ্ছে। রাধারামণ এখনও আছে......। আই ব্যাঙ্কের দুই ভদ্রলোক এই মাত্র চলে গেল। তন্ময়,সম্বিত টিভির কার্টুন দেখায় ব্যস্ত। গীতা পাঠ শেষ করে রাধারমণ বাবুর গুরুভাই রাধারমণ  বাবুর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছেন। রাধারমণ বাবুও নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে ভেবে যাচ্ছেন। যে যার কাজে......।
    এখন ঘড়িতে সাতটা তিরিশ। রাধারমণ বাবু স্ত্রীকে বললেন তাকে ধরে ধরে বাথরুমেএ নিয়ে যেতে। সবিতা দেবী অনেক বোঝালেন। রাধারমণ বাবু বাথরুমের দরজা বন্ধ করলেন। সবিতা দেবী বাইরে অপেক্ষা করছেন। বাথরুমে যেখানে ফিনাইল, সার্ফ থাকে তার পাশ থেকে ইঁদুর মারা বিশটা খুব সন্তরপনে তুলে নিলেন রাধারমণ বাবু।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.