ছুটির গল্প : মৃদুল শ্রীমানী

ছুটির গল্প : মৃদুল শ্রীমানী
ছুটির গল্প : মৃদুল শ্রীমানী

ছুটির সন্ধ্যে। সান্ধ্য ভ্রমণের ছলে বাহির হইয়াছিলাম। ড্রাইভারকে আজ ছুটি দিয়াছি। রাত গড়াইলে দ্রব্যবিশেষের কারণে পা গুলি কিঞ্চিৎ টলটলায়মান। চোখেও খুব স্পষ্ট দেখিতেছি না। দূরে কাছের বোধ গুলাইয়া গিয়াছে। রাস্তায় বিশেষ কেহ নাই। এই পার্বত্য শহরে লোকে একটু ত্বরায় শয্যাগত হইয়া থাকে। সুতরাং পথ শুনশান। একটু দূরে ধূম্রকুণ্ডলীর ন্যায় কি যেন দাঁড়াইয়া আছে। উহা কি? দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া মাথা নাড়িতেছে। আমি কি ভুল দেখিতেছি? পাহাড়ি শহরটিতে উচ্চতার কারণে গাছগুলি সরল ঋজু ও স্বল্পশাখ। কাছে যাইব? একাকী ভয় লাগিতেছে। হে হোরেশিও, এখনো এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে, যাহার রহস্য তুমি সমাধানের যোগ্য নহ। তবু পুরুষকারে ভর করিয়া আগাইয়া গেলাম। গিয়া দেখিলাম ধূম্রকুণ্ডলী নহে। বৃক্ষও নহে। এক শালপ্রাংশু প্রৌঢ় ভদ্রলোক। সহসা আমার গাত্রত্বক কণ্টকিত হইয়া উঠিল। এ আমি কাহাকে সাক্ষাৎ করিতেছি? ইনি তো রাজা রামমোহন রায় ! সম্বিৎ ফিরিবামাত্র দণ্ডবৎ হইলাম। আভূমি প্রণত হইবার পরে তিনি জানিতে চাহিলেন কে তুমি? বলিলাম, আমি বঙ্গ ভাষার একজন সেবক। তবে আপনার পদনখকণারও তুল্য নহি। তিনি উদার কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন কোথায় লিখিয়া থাক? সাময়িক পত্র না সংবাদপত্র?
বলিলাম ফেসবুকে নিয়মিত লিখি।
শালপ্রাংশু মহাভুজ কহিলেন ফেসবুক? বই লিখিয়া থাক?
বলিলাম, না না, পুস্তক নহে, উহা একটি সোশ্যাল মিডিয়া। অতি মাত্রায় জনপ্রিয়। কিছু লিখিলেই লাইক পড়িয়া থাকে। রাজা কহিলেন, জনপ্রিয় বুঝিলাম, কিন্তু লাইক কি বস্তু?
বলিলাম, পড়িয়া ভাল লাগিলে লাইক দিয়া থাকে। বেশি ভাল লাগিলে রক্তাভ হৃদয় চিহ্ন দেয়।
প্রৌঢ় আমার প্রগলভতায় বিরক্ত হইয়া বলিলেন রাখো রাখো, তোমাদের রক্তাভ হৃদয়। সেই মেয়েটাকে দেখিতে পাইলে আমি..
ভাবিলাম এই মহাপুরুষের তো মেয়েঘটিত কোনো কিছু কভু শুনি নাই।
বলিলাম, আপনি কোন ভদ্রমহিলার কথা বলিতেছেন?
বলিলেন, আরে আমি সতীদাহ প্রথা রদের জন্য এত করিলাম, আর ওই মেয়েটা বলে কি না তাহাদের বিধানসভায় ইহা পাশ হইয়াছে। না না, এভাবে চলিতে পারে না। তোমাদের যুগে তোমরা সাধারণ জ্ঞানের বিস্তর পিন্ডি চটকাইয়াছ। আর সহ্য করিব না। বিধানসভা প্রতিষ্ঠার বহু আগেই আমি আমার কর্তব্য সমাধা করিয়াছি।
আমি বলিলাম ওহ, এই ব্যাপার? ইহাতে আপনার ন্যায় জ্ঞানবান ও গুণবান ব্যক্তির চঞ্চল হওয়া সাজে না। আপনার সতীদাহ প্রথা রদ কি জিনিস বাঙালি ভুলিয়াছে। ইদানীংকার সংবাদপত্র দেখিবেন, ঘরে ঘরে স্বামী বর্তমানে সতীদাহ চলিতেছে। 
রাজা বলিলেন সে কি? তোমরা শান্ত হইয়া বসিয়া আছ? কোনো আন্দোলন করিতেছ না?
বলিতে গেলাম মহাশয়, আন্দোলন করিব কি শুনিবার কেহই নাই। বড়জোর ফেসবুকে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করিবে। খুব বেশি হইলে শেয়ার করিবে। কিন্তু গায়ে গতরে মাঠে ময়দানে নামার কথা বাঙালি চিরতরে ভুলিয়াছে।
তিনি আমার মাথায় হাত রাখিলেন। বলিলেন ভাবিও না। একদিন সকলি ফিরিবে।
নিজ মস্তকোপরি সেই মহাপ্রাণের স্পর্শ পাইয়া আমার আবেগের রুদ্ধ দুয়ার খুলিয়া গেল। ভেউ ভেউ করিয়া বেশ খানিকক্ষণ অশ্রুপাত করিলাম। একটু সম্বিৎ ফিরিতে দেখি একটি ছেঁড়া কাপড় লইয়া চোখের জল সামলাইতেছি।
মহাপুরুষের আলখাল্লাটি জীর্ণ হইয়াছিল। সেইটি তিনি আমাকে অশ্রুভারাক্রান্ত দেখিয়া দান করিয়া গিয়াছেন।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.