উমাপদ কর : যে-কথা জানে না তেমন কেউ

উমাপদ কর

 যে-কথা জানে না তেমন কেউ

বাঁশ কাটার শব্দ হচ্ছিল। তুলসীতলায় পাটির ওপর তোষকে-বালিশে শায়িত ছিল নিথর এক লাশ। কোনও এক অতিশিশুর দাদু। কাঁদছিল তার মা-বাবা, দিদি-দাদারা, পড়শিরাও কেউ কেউ। শিশুটিও কাঁদছিল রান্নাঘরের বারান্দায় বসে। হয়তো দেখে-দেখেই। সে আর কী-ই বা বোঝে মৃত্যুর! একসময় সে বড়োদিদির কোলে। দিদি তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল—‘কাঁদিস না। তোকে খুব ভালোবাসত রে দাদু।” সকাল দশটা-সাড়েদশটা হবে। গামছা কোমরে বেঁধে শ্মশানযাত্রীরা সব প্রস্তুত। বাঁশের মাচানে তোলা হলো তার দাদুকে। কাঁধ লাগালো তার বাবা আর কয়েকজন। ‘বলোহরি— হরিবোল’ ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সকলের কান্না যেন চতুর্গুন হয়ে গেল। শিশুটি চুপ— তাকিয়ে দেখছে চলে যাওয়া। বাবা কি তার একবার মাটিতে পড়ে গেল! পরবর্তীকালে শিশুটিকে সেই দিনের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে সে শুধু মনে করতে পারল, কারা যেন কাঁধে তুলে নিল একটা মাচান, আর কেউ যেন একটা পড়ে গিয়েছিল। এ-দুটো টুকরোই তার মাথায় গাঁথা, বাকি কিছু মনে নেই। থাকবে কী করে! সবে তখন সে চারে পড়েছে।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ। রবীন্দ্রজন্মের শতবার্ষিকী। পালিত হচ্ছে দেশজুড়ে। শহর বহরমপুর ছাড়িয়ে ৩ মাইল দূরে এক গ্রাম, মণীন্দ্রনগর। শিশুটির আস্তানা বা বাড়ি। সে-বাড়িতেও জন্মজয়ন্তী পালনের আয়োজন। বারান্দায় মা-মাসি-দিদিদের কাপড় টাঙিয়ে আর একটা চাঁদোয়া বেঁধে মঞ্চ। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। আরও সবকিছুর মধ্যে শিশুটির জন্য একটা সময় বরাদ্দ করা হয়েছিল। সে রবীন্দ্রনাথের ‘দামোদর শেঠ’ কবিতাটা আবৃত্তি করবে। করলও। হাত-পা নেড়ে, কিছু শব্দের আধো উচ্চারণ করে— ‘অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি!’। পরে তাকে সেদিনের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে, মাথা চুলকে সে বলেছিল— “না তেমন কিছু মনে নেই। হ্যাচাকের সামনে মাঝে-মধ্যে লাল-নীল-হলুদ চিকচিকে (সেলোফেন পেপার) কাগজ আনা হচ্ছিল, আর আমি খুব হাত-পা নেড়েছিলাম, কিন্তু ভুলিনি।” এর বেশি তার পক্ষে আর মনে রাখাও কঠিন। মাত্র ছয়। হাজারিবাগান ফ্রি-প্রাইমারি স্কুলে সবে যাওয়া শুরু করেছিল সেই শিশু।

এই শিশু মায়ের অষ্টম গর্ভ হয়ে জন্মেছিল ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৫-য়। বাবা সতীশ চন্দ্র কর ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ১৯৪৭-৪৮ সালে যিনি সপরিবারে ওপার বাংলার ময়মনসিংহ জেলার (অবিভক্ত বাংলার) কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহর থেকে, বলতে গেলে পালিয়ে এসেছিলেন কপর্দকশূন্য। সাকুল্যে ষোলোটি মুখ, আয়নার পেছনে লুকোনো তিনশ টাকা আর গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেটটা সম্বল। আর বসত জমিটি কিনে রেখেছিলেন ১৯৪৬ সালে। তারপর লড়াই আর লড়াই। শিশুটির মা, সিন্ধুবালা কর, ষোলো বছর বয়সে নেত্রকোণা (ময়মনসিংহ জেলার একটি ছোট শহর) থেকে নতুন বউ হয়ে দাস থেকে কর হয়ে ঢুকেছিলেন কর-পরিবারে। যেখানে জেলার নামকরা এক কবিরাজ শ্বশুর আদিনাথ করের কল্যাণে দুপুরে রাতে প্রায় বিশটি করে পাত পড়ত, আর যার হেঁসেল সামলানোর কাজ হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন সেই কৈশোরত্তীর্ণা যুবতী। তারপর এপারে এসে শুরু হয় ভিন্নতর কঠিন লড়াই। বেঁচে-থাকার, আর বাঁচানোর। স্বামী বাইরে থাকেন জীবিকার জন্য, তাই সন্তানাদির দেখভাল-অসুখবিসুখ-পড়াশোনা তাকেই সামলাতে হয় খুব সামান্য অর্থে, আর পেটে ক্লাস ফোর পাসের বিদ্যে নিয়ে।

একদিন এই শিশু, তখন থ্রি কি ফোর-এ পড়ে মার কাছ থেকে পাঁচটি পয়সা পেয়ে দিন-দুনিয়ার মালিক বনে দৌড়-দৌড় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য একছুট্টে পৌঁছে গিয়েছিল স্কুলের মাঠে, যেখানে তার জন্যই যেন অপেক্ষা করে ছিল এক আইসক্রিমবালা। নিমেষে ঢপ থেকে বেরিয়ে এসেছিল দু-দুটো আইসক্রিম, পাঁচ পয়সায়। একটা লাল, একটা শাদা। দু-হাতে দুটো নিয়ে জমায়েত আরসবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে একবার এটা চুষছিল, আরেকবার ওটা। শেষ হলে দু-হাতে লেগে থাকা জলটাও সাবড়ে দিয়েছিল চেটে চেটে। আহা, কী আনন্দ। এ-শিশুই বন্ধু-বান্ধবসহ স্কুলের কাছাকাছি এক জমি থেকে লাগানো আখের টুকরো তুলে নিয়ে এসে উল্লাসে চিবোয়, আর জমির মালিকের অভিযোগে রাগী হেডমাষ্টারের বেতের বাড়ি খায় ততোধিক। কাঁদে, চোখে জল আসে না। এই শিশুই ক্লাসের ফাঁকে বা শেষে লাগোয়া ফুটবল মাঠে সবন্ধু প্রায় উপকরণহীন এক খেলায় মেতে উঠত। পোড়া-মাটির পাতলা টুকরো বা চাড়া আর চীনকাগজ (চীনাংশুক)। চাড়ায় থুতু দিয়ে রঙিন চিনকাগজ সেঁটে একসঙ্গে সবাই উঁচুতে ছুঁড়ে দিত। ওপরে একসময় কাগজ আলাদা হয়ে বাতাসে এদিক-ওদিক ভেসে নীচে নেমে আসত। যারটা সব শেষে মাটিতে পড়ত সেই জয়ী, এই খেলায়। নামার সময় একসঙ্গে ভেসে থাকা রঙিন কাগজের দুলুনি দৃশ্য শিশুর মনে এক অনাস্বদিত আহ্লাদের জন্ম দিত। চেয়ে-চেয়েই থাকত সেই পতন-দৃশ্যে। স্কুলে চিত্তর সঙ্গে মারামারিতে হেরে যেত সে। হয়তো চোখের নীচে কলমের খোঁচা। অভিযোগ হেডস্যারকে, সপাসপ বেতের বাড়ি চিত্তর পিঠে, তখন চিত্তর কষ্ট দেখতে না-পেরে মাষ্টারমশাইকে সেই কেঁদে অনুরোধ—‘আর মারবেন না স্যার, আমার কিছু হয়নি।’ শুধু শরীরে নয়, মনেও সে হয়তো দুর্বল ছিল। সবিতা দিদিমণি খাতায় সরু আঙুলে পদ্মফুল, হাঁস, আরও অনেককিছু এঁকে দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বাড়ি থেকে দেখে-দেখে এঁকে নিয়ে আসতে বলতেন। যে সুন্দর এঁকে নিয়ে যেত, তাকে খুব সুন্দরী সবিতা দিদিমণি আদর করতেন। সেই আদর খাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে রেষারেষি লেগে যেত প্রায়ই। শিশুটি যেন হা-পিত্যেশ করে মরত দিদিমণির নয়নের মণি হতে। তার মধ্যে যে সে কী দেখেছিল! 

শিশু কিশোর হয়। প্রাইমারির মমতা ছাড়িয়ে মাধ্যমিকে চলে যায়। পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে জুড়ে যায় আরও সব নতুন বন্ধু। মণীন্দ্রনগর হাই-স্কুলে আরেকটা জগৎ। কিশোরের পৃথিবী রঙে-রসে-মজায় শৈশবের পৃথিবী থেকে আলাদা। পড়াশোনা যেমন চলে, সঙ্গে চলে স্কুল-পাড়ার ক্লাবের ফাংশানে আবৃত্তি। জুড়েছেন, সুকুমার রায়। মজা পায় খুব কিশোর। ‘আবোল তাবোল’ শেষ, শেষ রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ আর ‘শিশু ভোলানাথ’। পড়তে ভালোবাসে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও। ক্লাসে ফার্স্ট হতে আটকায় না এসব। বাইরের পড়ায় দিদি সহায়ক। ‘ঠানদিদির থলে’, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, একদিকে যেমন, অন্যদিকে ‘ছোটদের মহাভারত’, ‘ছোটদের রামায়ণ’, আরও সব শেষ সিক্সের মধ্যেই। এবারে শিবরাম চক্রবর্তী এসে জুড়লেন ‘নিখরচায় জলযোগ’ আর ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’-এ। সে এক মজাদার অভিজ্ঞতা। সেভেন থেকেই একটা মোড়, ‘স্বপনকুমার’ চলে এলেন তার রহস্য সিরিজ নিয়ে। কিন্তু বাড়ির মানুষ পড়তে দিতে চায় না যে। অগত্যা বাড়িতে খাতার পেছনে লুকিয়ে কিংবা স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে বা বেঞ্চের আড়ালে চলল অ্যাডভেঞ্চার। রহস্যমজাটা একসময় ফুরিয়ে এল। ঘুরে গিয়ে পড়ল, ‘রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘শ্রীকান্ত’-তে। এরই মধ্যে চলল, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধূলা— বিচিত্র তার রকমফের, ‘দাঁড়িয়াবান্দা’, ‘গোল্লাছুট’, ‘হা-ডু-ডু’ ‘পঞ্চাশ চোর’, ‘পিট্টু’ ‘ডাংগুলি’। আর প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে জেতা-হারার ব্যাপার-স্যাপার আছে, ‘টিপ্পি বা মনিয়াল’, নানা ধরণ তার, ‘তাস’ খেলা (নানা রকমের সিগারেট প্যাকেট ছিঁড়ে দু-ভাগ করে, একেকটার একেকরকম মূল্যমান স্থির করে দাগা ছুঁড়ে খেলা), ‘লাট্টু খেলা’, আরও সব। শুধু এতে মন ভরত না কিশোরের। বিকেলে ফুটবল মাঠ, দাদারা খেলে, তার মতো ভাইয়েরা সব বল মাঠের বাইরে গেলে কুড়িয়ে এনে দেয়। কে আগে কুড়োতে পারে আর লাথি মেরে মাঠের মধ্যে ফেলতে পারে তারই প্রতিযোগিতা। পড়াতেও ভিন্নতা এল, সত্যেন দত্তের তাল-ঠোকা কবিতা, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ আর বিভুতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ হাপুস নয়নে। আরেকটা বই কিশোর তার মেজদার সঙ্গে মিলে উচ্চারণ করে পড়ত, বারবার। মা-বাবার বিয়েতে উপহার পাওয়া বইয়ের মধ্যে একটি, ‘অজানার উজানে’। দুজনেই কাঁদত খুব। চোখের জল বাঁধ মানত না। এই ক্লাস এইটের মধ্যেই পড়া হলো অনেক রকমের স্বাদের আর তার অধিকাংশই দিদির দেখিয়ে দেওয়া বা জোগাড় করে দেওয়া। কিছু বই উপহার হিসেবে পাওয়াও হয়েছে কিশোরের, ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ায় আর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়। সেসবও পড়া শেষ। শুধু কি এই? এই সময়ের মধ্যেই দু-দুবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরা কিশোরের। কিছুটা অলৌকিক। একবার ভাগিরথী নদীতে নৌকাযাত্রায় মাসি-মেসোদের পরিবারের সঙ্গে সপরিবারে (বাবা বাদে) যাচ্ছিল কিশোর, খাগড়ার ঘাট থেকে লালগোলার রাজারামপুরে, পূজোর ছুটিতে, মাসির বাড়িতেই পূজোটা কাটাবে আনন্দ করে। তো, নৌকো ছেড়ে কিছুটা যেতে না-যেতেই প্রায় মাঝ-গঙ্গায় নৌকাডুবি। সাঁতার না-জানা পিঠোপিঠি দু-ভাইকে দু-হাতে ধরে রেখে মার স্রোতে ভরা গঙ্গায় একবার ডান-হাত উপরে তুলে আরেকবার বাঁ-হাত উপরে এনে বাঁচবার ও বাঁচাবার আপ্রাণ। পারাপারের ফেরি-নৌকা ছিল কাছাকাছি, আর মণীন্দ্রচন্দ্র বিদ্যাপিঠের ঘাটে স্নান সারছিল অনেক যুবক। তারাই এগিয়ে এল উদ্ধারকাজে। শেষপর্যন্ত তারাই রক্ষাকর্তা হয়ে উঠল। প্রাণ হারালো না কেউ, সবাই কোনও-না-কোনওরকমে বেঁচে গেল কিছুটা অলৌকিকভাবে। কিন্তু মৃত্যুভয় জড়িয়ে ধরল তাকে। নৌকায় সেই সবচেয়ে ছোট ছিল। আরেকবার, বাড়িতে গরুরগাড়ি করে বালি দিতে আসা সরলকাকুর বাঁশের খাঁচা-লাগানো (যার মধ্যে বালি রাখা হয়) গরুগাড়িতে ফেরার পথে উঠে পড়ল কিশোর একটা অতিসাধারণ সরল জীবনে মজা নিতে। কিছুটা যেতেই আলগা বাঁশের খাঁচা হঠাৎই হেলে পড়ায় গাড়ি থেকে চিৎ হয়ে পড়ে গেল কিশোর রাস্তায়। আর মুহূর্তে লোহার বেড় পরানো চাকাটা উঠে এল তার পেটের নরম অংশে। ক্ষণিকের জন্য দম যেন বন্ধ হয়ে এল। পেরিয়েও গেল চাকা। যাক, বেঁচে গেল বড়ো কোনও আঘাত থেকে। ততক্ষণে সরলকাকু গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে রাস্তা থেকে তুলল কিশোরকে। দেখে নিল তার চোট-আঘাত, বলল— ‘বাড়ি যান, ছোটবাবু।’ বাড়ি ফিরতে ফিরতেই কিশোর চিন্তা করে নিল, না, এ-ঘটনার কথা সে বাড়িতে বলবে না, বললে আরেকপ্রস্থ। কিন্তু আবারও একটা মৃত্যুভয় আর আতঙ্ক ঘিরে থাকল তাকে বেশ কিছুদিন ধরে। যদি পেট না-হয়ে গলা কিংবা বুক হতো তাহলে ওখানেই ভবলীলা সাঙ্গ।

শৈশব আর কৈশোরের এই প্রাথমিক পর্বে খুবই সাধারণ কিছু ঘটনা তার কাদার মতো নরম মন ও মানসিকতায় গভীর প্রভাব ফেলত, হয়তো পরবর্তীকালে এসব তার এক সৃষ্টিশীল মনন গড়তে সহায়তা করে থাকবে। খুব ভোরে মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে যেত বোষ্টম-বোষ্টমীর যৌথগানে। কর্তাল বাজিয়ে চলমান সেই ভোরের টহলে কেমন এক মাদকতা, এক আনন্দলাভ। গ্রামের প্রান্তে বাস করা সেই বোষ্টমরা বেলায় মাধুকরী সংগ্রহে এলে ওই শিশু-কিশোরই এগিয়ে যেত সাধ্যমতো তাদের ধামায় চাল-কলা-মুলো তুলে দিতে। এক ধরণের আত্মপ্রসাদ লাভ করা। আরেক বোষ্টম আসত দূর  থেকে। সে জলচৌকিতে বসে কর্তাল বাজিয়ে শুধু গানই গাইত না, তেল-চকচকে বড়ো কপাল আর সদা হাসিমুখ নিয়ে বাড়ির ছোটবাবুর সঙ্গে গল্প না-করতে পারলে যেন চলতই না তার। তার থলেতেও চাল ঢেলে দিত সেই শিশু-কিশোরই। আর সেই বোষ্টমকে তার কত কত প্রশ্ন, সবকিছুর উত্তর দিত হাসতে হাসতে। আর ছিল এক গায়ক-ভিক্ষুক। শ্যামাসঙ্গীত গাইত সে। ‘মন রে কৃষি কাজ জানো নাং/ এমন মানবজমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলতো সোনাং’। অদ্ভুত এক ভঙ্গি তার, সব লাইনের শেষে একটা অনুস্বার যোগ করে দেওয়া। কী যে তার কারণ, বুঝত না শিশু-কিশোর, শুধু বাবার কাছে জেনেছিল, এসব রামপ্রসাদী গান, আর মানুষটার এটাই একটা ঝোঁক। কালীপুজোর শেষে পাড়ার কিছুটা দূরে কয়েকদিন ধরে পালাকীর্তন আর কবিগানের আসর বসত। মাইকে সে-গান ছড়িয়ে পড়ত। সুযোগ পেলেই মেজদার হাত ধরে বা কখনও একাই চলে যেত সে। অবাক হয়ে শুনত দুই কবির প্রায় নেচে নেচে মিল দিয়ে ছড়া কাটা, আর শেষে গানের মতো গেয়ে ওঠা, একই সঙ্গে ঢোল-খোল-কর্তাল-মন্দিরা সহযোগে সঙ্গিদের ধুয়া ধরা। পরপরই আসরে নেমে পড়ত বিপক্ষ কবি উত্তর করতে। জমে যেত আসর। তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে মজে যেত শৈশব পেরোনো কিশোর। মনে মনে ভাবত, বড়ো হয়ে সে এমনই কবিয়াল হবে।

কৈশোরের প্রাথমিক পর্ব কাটতে না কাটতেই, বোধ-সম্পন্ন কৈশোরের হাতছানি বড়ো হয়ে ওঠে তার কাছে। টিনস্ শুরু হয়ে যায়। এবারে সাদাসিধে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে ওঠে মন। কিছু কুহক কিছু রহস্যের হাতছানি। অবাধ ছিল না তার কৈশোর, কিন্তু বাধা ছিল কম। সুযোগ পেলেই বন্ধুরা মিলে জেলেদের নৌকা বেয়ে চলে যেত কাটিগঙ্গার বুক চিরে। শ্যাওলা ও দামে ভরা অঞ্চল পেরিয়ে পানিফলের জংলা। প্রায় স্বাদহীন পানিফল অমৃত মনে হত তার। একেকদিন ফেরার পর, জেলেদের বকুনি খেতে হত বিস্তর। কখনও দৌড়ে পালাতে হত। এক বন্ধুর মোষের পিঠে চড়ে ঘাসের মাঠে দুলে-দুলে চলা, দুলকি চালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অজস্র কবিতাবৃত্তি, আর হাফ-প্যান্টের ডোরে বাঁশের বাতার তরবারি ঝুলিয়ে, মাথায় আমপাতার মুকুট চড়িয়ে বন্ধুর সঙ্গে নাগাড়ে ডায়লগ সহ রাম-রাবণের যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি, পাড়ারই রাম-যাত্রাপালা দলের পনেরোদিনব্যাপী রাত্রিকালীন অভিনয়ের সুবাদে। এ-সময়ে ফুটবল মাঠে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নয়, মাঠে ঢুকে পড়ে চামড়ার গোলায় লাথালাথি। এ-সময়েই আরও বেশি কবিতা আবৃত্তিচর্চা, নিজে নিজেই, আর প্রতিযোগিতায় বেশি বেশি অংশগ্রহণ, অনেক কবির কবিতা জুড়ে গেল এই পরিসরে, সুকুমার-রবীন্দ্র ছাড়িয়ে তা চলে গেল বুঝি না-বুঝি সত্যেন-নজরুল-সুকান্ত-বিষ্ণু-যুবনাশ্ব এমনকি জীবনানন্দে। কৈশোরত্তীর্ণ যন্ত্রণা একদিকে কুহক আরেকদিকে রহস্যের ডালা নিয়ে হাজির হয়। একসময় বন্ধুরা মিলে মাতে শরীর সম্বন্ধীয় কিছু রহস্য উন্মোচনের চেষ্টায়। বিশেষত নারী। খেলাচ্ছলেই সমবয়সিনীদের শরির দেখা ও বোঝার আকূতির মধ্যে কিংবা নারী শরীরের অপার রহস্য আলোচনাতে নিজেদের তারা সাবালক ভাবতে শিখে যায়। একদিন অচানক কোনও এক বন্ধুর সাহচর্যে ও শিক্ষায় সেই কিশোর পেয়ে যায় নিজস্ব এক অসহ্য অনাস্বদিত শরীরের স্বাদ, যা আনন্দে উদ্বেল করে তোলে তাকে শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা দাপিয়ে সহস্র রসের ধারা অসহ স্ফূর্তির ঝলক ক্ষরণের মধ্যে।

কৈশোরোত্তীর্ণ যন্ত্রনার মধ্যেই আরেক উত্তেজনায় জড়িয়ে যায় তার মানসিক অবস্থা। সে রাজনৈতিক-সামাজিক ঘূর্ণাবর্ত। নাইন-টেনে পড়ার সময় হঠাৎ একদিন দেখে স্কুলের দেয়ালে আলকাতরায় লেখা— ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’- ‘সি-পি-আই-এম-এল’। বুঝতে পারে, কিছুদিন ধরে শুনে ও পত্রিকায় পড়ে চলা, আর সদর শহর বহরমপুর থেকে আসা নানা খবরে যে নকশাল-আন্দোলনের খবর পাচ্ছে তার ঢেউ এসে পড়েছে তাদের শান্ত গ্রামেও। অবাক হয় বালক, তাদের গ্রামে কারা এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল! এ-যে মারাত্মক আর ভয়ংকর এক দিক। সারাজীবন কংগ্রেস করা তার বাবাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু তিনিও নিরুত্তাপ, শান্ত, কোনও প্রয়াস নেই দেয়াল মুছে দেওয়ার। কিছু দিনের মধ্যেই তার বাবার চাকরিটা খুন হয়ে গেল রাজনৈতিক ঘৃণ্য চক্রান্তে। পরিবার আবার আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায়। কিশোর প্রত্যক্ষ করল বাম-রাজনীতির নামে কিছু শিক্ষক-পরিচালক একজন কংগ্রেস মনোভাবনাপূর্ণ মানুষের প্রৌঢ়-জীবনে অনর্থক নিয়ে এল অপমান অপযশ। দেখল, সেইসব মানুষ যারা কলিগের পেটে ছুরি মেরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিশ্বমানবতাবোধের কথা বলছে। হয়তো বালক কাঁদলও নীরবে। এরইমধ্যে বালকের হায়ার-সেকেন্ডারি পরীক্ষা। বহরমপুরের স্কুলে সিট পড়ল। একদিকে গণটোকাটুকি অন্যদিকে পরীক্ষাহলের সামনেই বোমা পড়া। ধোঁয়াময় ঘর। পাড়ার যে দাদাটা পরীক্ষার গার্ড হয়ে ছিল, সেই কি চার্জ করে এল বোমা, নয়তো তার চোখ এত লাল কেন? নানা প্রশ্নে আর ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠল বালক। প্রায়ই শোনে খুন, হত্যা, আর পুলিশের তাণ্ডব। সময় বসে থাকে না। আবার চাকরি জুটে গেল বাবার। খুঁড়িয়ে হলেও সংসার চলতে লাগল। পরীক্ষাশেষে এই প্রথম বালক বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও যাওয়ার সুযোগ পেল। দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে মোগলসরাই। মাঝে একরাত্রি কলকাতা বাস। এই প্রথম তার জীবনে মহানগরী। বিকেলে জামাইবাবুর সঙ্গে একটু হাঁটতে বেরোনো, বৃষ্টির তাড়ায় এক কলেজে আশ্রয় নেওয়া, সেখানে ঘটে গেল তার জীবনের আরেক আতঙ্কপূর্ণ ঘটনা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই কলেজের কয়েকজন যুবক তার জামার কলার ধরে হিড়হিড় টেনে নিয়ে গেল এক কোণায়। চলল জিজ্ঞাসাবাদ, কে, কোথা থেকে, কী করে, কোথায় যাবে, এখানে কেন ইত্যাদি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া বালক, তোতলাতে তোতলাতে সঠিক উত্তর, আর প্রতিটি উত্তরের শেষে তাদের সন্দেহ, পোঙায় পাইপগান ধরার হুমকি, ব্যাটনের বাড়ি একটাও মাটিতে পড়বে না হুঙ্কার, পেটাইঘরে চালান করে দেবার নিদান। প্রাণভয়ে হতচকিত বালক, সে যে ঠিক বলছে, তা-নিয়ে কাকুতিমিনতি। এরই মধ্যে জামাইবাবু খুঁজে তাকে বের করে ফেলে, এবং ওই ষণ্ডামতন যুবকদের সঙ্গে কথা বলে বালককে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। রাতে বড়ো জামাইবাবুর কাছে বালক জানতে পারে কলকাতায় চলছে এলাকা দখলের লড়াই। একটু ভুল-বোঝার অবকাশ পেলেই খতম, লাশগায়েব, ইত্যাদি। একদিনেই বালকের বয়স অনেকটাই বেড়ে গেল।

ঝড় উঠেছিল। প্রশ্নের ঝড়, আবেগের ঝড়, কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা-রাখার ঝড়। এ-সবই আভ্যন্তরীণ। বাইরেও ঝড় চলছিল রাজনীতিতে সামাজিক অবস্থানে। পরীক্ষায় ভালোভাবেই পাস। কিন্তু এমন নম্বর নেই যে ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘কৃষ্ণনাথ কলজ’-এ পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিকসহ পড়তে পারবে, যেখানে তার এক দাদা পড়াশোনা শেষ করেছে, আরেক দাদা পড়ছে। গণটোকাটুকির ফল, কেউ সুযোগ নিয়েছে, কেউ নেয়নি, কেউ ভেবলে গেছে। সুযোগ চলে এল বালকের, সেবারই কৃষ্ণনাথ কলেজ কতৃপক্ষ প্রথম সিদ্ধান্ত নেয় প্রবেশিকা পরীক্ষার ভিত্তিতে বিভিন্ন সাম্মানিক শাখায় ভরতি নেওয়া হবে। পরীক্ষা, বালক কৃতকার্য, কলেজে প্রবেশ। বিষয় পদার্থবিদ্যা। এদিকেই তার ঝোঁক। চলল পড়াশোনা। যৌবনের দোরগড়ায় সে। রাজনীতি তাকে ভাবায়, কিন্তু কোথাও মাথা মুড়তে চায় না। সামাজিক কর্মকাণ্ডে সে আহত হয়, মনে ধরে না, কিন্তু বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে না। এরই মধ্যে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে কবিতা লেখায়, যা ছিল টেন-ইলেভেন থেকে চুপেচাপে আড়ালে খাতার মধ্যে, তা খানিকটা হলেও আড়াল ভাঙে। আর ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়ে আবৃত্তি, বিতর্ক, অপুর্বকল্পিত ভাষণ (এক্সটেমপো), ইত্যাদির প্রতিযোগিতায়। কলেজে, কলেজ থেকে পাঠানো অন্য কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে, বিভিন্ন ক্লাবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। পুরস্কার জুটতে লাগল খুব। একটা নেশা, একটা ঘোর। ততদিনে নকশালবাড়ি আন্দোলন মোড় নিয়েছে। একদিকে আমূল পালটে দেওয়ার বাসনায় বিপ্লবীরা ব্যক্তিহত্যা, মূর্তিভাঙা, নাশকতার কাজে জড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র বিপ্লব দমনে নিপীড়ন, অত্যাচার, ধরপাকড়, জেল, এনকাউন্টার, কারান্তরালে গণহত্যা, সবই চালালো। এদিকে পূর্বপ্রান্তে যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, সীমান্তবর্তী জেলা বলে অধিক টের পাওয়া, রাতের অন্ধকারে মাথার ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান উড়ে যাওয়া, বাড়ির কাছেই এম-আই-টি বন্ধ করে দিয়ে সেনাশিবির তৈরি করা, উপছে পড়া শরনার্থীর ভিড়, রিলিফ ক্যাম্প, শরনার্থীদের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে স্কোয়াড করে অর্থ জামা-কাপড় সংগ্রহ করা, ক্যাম্পে পাঠান। সব মিলিয়ে এক দুর্বিসহ অবস্থা, শেষে স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। হবু যুবক হতোদ্যম হয় না। যেখানে যতটুকু সম্ভব নিজেকে রাখে, কিন্তু সেকটেরিয়ান বায়াসড রাজনীতি বাদে। যৌবন থেমে থাকে না। তার আছে এক অপার গতি আর তৎপরতা। পারফরমেন্সের নীচে যে সত্তাটা তার লুকিয়ে থাকে, ঘটতে থাকে তারও প্রকাশ। কলেজের বন্ধুরা তা আরও উসকে দেয়, এখন যুবকের কলেজের ক্লাসের মেয়েবন্ধু, কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে আড্ডা, শুকনো ভাগিরথী পায়ে হেঁটে পেরিয়ে বন্ধুরা মিলে ওপারের আমবাগানের নীচে গান, আবৃত্তি, আড্ডা। হস্টেল বন্ধুদের সঙ্গে হস্টেলে আড্ডা। এরকমই এক আড্ডায় প্রিয় বন্ধু জমিল সৈয়দের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় কবিতা-পত্রিকা করার আবেগসমৃদ্ধ সিদ্ধান্ত। নাম হবে ‘শ্রাবস্তী’। চলল তারও এক পর্ব। টুকটাক কবিতা লেখা, জেলার কিছু পত্রিকায় তার প্রকাশ, শ্রাবস্তী ছাপা হয়ে বেরোনো, সব যেন এক প্রহেলিকা ঘটে চলেছে, প্রায়-যুবকের জীবনে। আবৃত্তি করতে করতে আর বিভিন্ন কবির কবিতা পড়তে পড়তে কখন যে কবিতায় মজে গেল তার মন, সে তা নিজেও জানে না। শুধু রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ যে তাকে এ-পথে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার।

সামান্য কবিতা লেখালিখি, পত্রিকা করা, আবৃত্তি-ডিবেট-এক্সটেমপো-আরও নানা ধরণের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের মধ্যে চলতে লাগল জীবন। সঙ্গে ফুটবল-ক্রিকেট আর ভলিবল খেলাও চলতে লাগল। ভলিতেই আগ্রহ বেশি, সেখানেই জেলা-স্তর পর্যন্ত খেলার সুযোগ পাওয়া গেল, গ্রামে-মফস্বলে-শহরে ঘুরে ঘুরে সেই খেলা অনেককিছু শেখালো যুবককে। একসময় কলেজ শেষ হয়ে গেল। পরীক্ষায় পাস। রাজনৈতিক ডামাডোল আর অব্যবস্থায় ৭৪-এর রেজাল্ট প্রকাশ পেল ৭৬-এ। যুবকের জীবন থেকে খসে পড়ল দু-দুটি বছর। তারমতো সকলেরই একই অবস্থা এই সময়ে। বছর তিনেক সামান্যই কিছু কবিতা লিখে যুবকের মনে হলো, না, তেমনকিছু হচ্ছে না। যা সে লিখতে চায়, তা লিখতে পারছে না, যতই পত্রিকা করুক আর এখানে-সেখানে দু-চারটে ছাপা হোক। পূর্বজ কবিদের দুর্বার প্রভাব তার কবিতায়, যা সে চায় না। বন্ধ করে দিল কবিতা লেখা। একসময় বন্ধ হয়ে গেল ‘শ্রাবস্তী’ও। চলল চাকরি যোগাড়ের পরিক্ষাদিতে অংশগ্রহণ। অচিরেই (জানুয়ারি,৭৭) জুটেও গেল জেলার সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকে। সময় কাটে চাকরিতে, আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। বাড়িতেই আবৃত্তির স্কুল, একটা সাংস্কৃতিক দল (নাচ, গান, আবৃত্তির), যারা গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভাবনাট্য, আলেখ্য, সম্মিলিত আবৃত্তি ইত্যাদি বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশন করে, তারই পরিচালক সে, একটা নাটকের দল, নাম ‘মণীষা’, কয়েকটা নাটক মঞ্চস্থও হলো তার পরিচালনায়। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছিল না সে। এ-পথ তার পথ নয়, বুঝতে পারছিল। একটা দ্বিধা, সংশয়, দোদুল্যমানতা কাজ করছিল তার মধ্যে। আবৃত্তি-নাটক-নাট্যের বিভিন্ন দিক বা ক্লাব/পাঠাগারের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদ, এসব পারফরর্মিং আর্ট এবং কাজ তার জন্য নয়, যদিও সে সেই লগিই ঠেলে চলেছে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না সে, আবৃত্তি করা, শেখানো, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা ছেড়ে দিল। একটা ঘটনা সহায়তা করেছিল তাকে। নতুন চাকরি। কো-অপারেটিভ ব্যাংক ছেড়ে সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। পোস্টিং- রায়গঞ্জ। এই স্থানবদল ভাবনাতেও প্রভাব ফেলে দুরন্ত। মাঝের পাঁচটি বছর কিছুই লেখেনি সে, যদিও পড়াশোনা চলেছে নিরন্তর। এবারে ভেতরে এক প্রণোদনা অনুভব করল লেখার, কবিতার কাছে ফিরে যাবার। নতুন চিন্তা-ভাবনায়, নিজের কবিতাটি লেখার প্রেরণায়। নতুন জায়গা। ভলিবল খেলা ছাড়া আর সেরকম কোনও সম্পৃক্তি নেই। শুরু হলো কবিতা লেখা। সঙ্গও জুটল, কিছু বন্ধুবান্ধব, আড্ডা। কিন্তু এককভাবে আবার কবিতাপ্রয়াস। প্রকাশ? কোনও সম্পাদককে সরাসরি চেনে-জানে না সে। তখন ডাকবিভাগই হলো তার আশ্রয়। কলকাতা, উত্তরবঙ্গ আর মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু লিটল-ম্যাগাজিন তাকে স্থান দিল। একদম ডাক-নির্ভরতা। ডাকে কবিতা পাঠানো, নির্বাচিত হয়ে ছাপা হলে, ডাক মারফত পত্রিকা পাওয়া। কলকাতার, সুশীল রায় সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’, ডঃ শুদ্ধসত্ত্ব বসু সম্পাদিত ‘একক’, অশোক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ঈগল’, যজ্ঞেশ্বর রায় সম্পাদিত ‘চিল’, দেবকুমার বসু সম্পাদিত ‘সময়ানুগ’, কেদার ভাদুরী সম্পাদিত ‘ব্যতিরেক’, উত্তম দাশ সম্পাদিত ‘মহাদিগন্ত’, শিশির দাশ সম্পাদিত ‘অন্যদিন’, ‘রবিবাসরীয় জনতা’ ইত্যাদি পত্রিকা তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, বিভিন্ন সংখ্যায় তার কবিতা প্রকাশ করে। নির্ভরতা জুগিয়েছে উত্তরবঙ্গ ও মুর্শিদাবাদের ‘গদ্য পদ্য এবং’ ‘মধুপর্ণী’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘প্রতিলিপি’, ‘অভিযান’, ‘পাক্ষিক কবিতা’, ‘সংসপ্তক’, ‘অন্যদ্রাঘিমা’, ‘উত্তরকাল’,  ইত্যাদি নানা ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকা। রায়গঞ্জে থাকাকালীন যুবকের আরেকটু অক্সিজেন জুটে গেল এতে। একবার ওখানকার কবি-সাহিত্যিকরা মিলে দেবকুমার বসুর সহায়তায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এলেন। তখন শক্তি তার প্রাণের কবি, প্রিয় কবি। তাঁকে সামনে থেকে দেখবে, তাঁর কবিতাপাঠ-কথা শুনবে, তাঁর সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে, ভাবতেই সে রোমাঞ্চিত। ব্যাংক থেকে দু-দিন ছুটি নিয়ে অন্যদের সঙ্গে প্রায় সবসময়ই তাঁর কাছাকাছি। একরাতে স্থানীয় কবিদের কবিতাপাঠের আসরে সে-ও সংকুচিত হয়ে কম্পিত গলায় পড়ে ফেলল দুটো কবিতা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঘোরে হোক, আর জ্ঞানেই হোক বলে উঠলেন— “আরে এই তো কবিতা। ‘শরবত পানের পরও/ যেমন কিছুটা অলস বরফ পড়ে থাকে’। আহা। খুব ভালো। তোমার বোধ, অনুভব, দেখার ভঙ্গি সব ঠিক আছে। শুধু মেকিংটা আরেকটু দেখতে হবে।” বলে, তিনি যুবকের চিবুক ধরে আদরের ছলে নাড়িয়ে দিলেন। উত্তেজিত যুবক, প্রেরিতও। আরেকবার, এলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর অমিতাভ দাশগুপ্ত সঙ্গে দেবকুমার বসু। সেবারেও রাতে বসল কবিতাড্ডা। বৃষ্টি হচ্ছিল। গান গাইলেন অমিতাভ দাশগুপ্ত। উদার আর ভারী গলা। সবার সঙ্গে যুবকও তন্ময়, বিহ্বল। পরে শুরু হলো কবিতাপাঠ। যথারীতি একসময় যুবকের পালা। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে তার। ভালো লাগবে তো তার কবিতা, গতবার যেমন লেগেছিল। পড়ল সে। অপেক্ষা করল। একে একে দুজনেই তাঁদের প্রশংসাজনিত কথাবার্তাই বললেন। উচ্ছসিত যেমন নন, তেমনি আগ্রহহীনও নন। এসব কথাবার্তা, অগ্রজদের কিছু প্রশংসা, বন্ধুদের উৎসাহ আর পত্রিকা-সম্পাদকদের প্রশ্রয় এই পর্বে তার লেখা তৈরি আর প্রকাশে একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল।

ঝড় উঠেছিল। প্রশ্নের ঝড়, আবেগের ঝড়, যৌবনের ঝড়। আভ্যন্তরীণ এই ঝড়ে কবিতাই প্রেম, কবিতাই আঘাত ও নিরাময়, কবিতাই প্রত্যাখ্যান ও প্রশ্রয়। সেই যুবকের মনে আলোড়ন— ক্ষুদ্র সে, প্রাণ অসীম বড়ো। নিস্প্রাণ সে জড়, তার জীবন জড়তার প্রতি ক্রমাগত বিরুদ্ধাচারণ এবং অসম্ভব সজীব। সবকিছুর সংশ্লেষণে যে জীবন, তার যাপন থেকে যা কিছু অনুসন্ধান, অনুভব, উপলব্ধি, তা থেকেই কিছু বলতে চাওয়া, বলতে চাওয়াটাই এক পীড়ন, বলতে চাইলেও সবসময় বলতে না-পারা এক অবদমন, বলাটা অন্যতে জারিত-চারিত করতে চাওয়া এক বাসনা। তাই, কাগজে-কলমে মুখ গুঁজে দেওয়া, আর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ-চেষ্টা। সেই যুবক মনে করে আলাদা করে তার কোনও কবিজন্ম নেই। যেমন সে অন্য দু-চারটে কাজ করে, যেমন হাসে-কাঁদে, নাচে-কুঁদে, খায়-দায়-দাবা খেলে-অফিস করে, কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখে, বাবার মৃত্যুতে হবিষ্যি করে, প্রেম করে রসিয়ে-কাউকে শ্লেষ করে কষিয়ে, আনন্দ হুল্লোড়ে মাতে, দশে মিলে বেরিয়ে পড়ে পিকনিকে, হেঁটে যায় আদিগন্ত মাঠ, ঘুমে-স্বপ্ন, জেগে-স্বপ্ন, অসুখে কাতরানো, পড়ে-বই গড়ে-মূর্তি ছোঁড়ে-ক্রিকেটবল, তেমনি সে কবিতা লেখে। সে প্রেমের বহু রূপ অনুভব করে। সবকিছুতেই প্রেমের আবিষ্কার এই পর্বে। জীবন-প্রেমের শুরুও এখান থেকেই। কিন্তু জোয়ার যেমন থাকে ভাটাও একটা বড়ো ভূমিকা রেখে যায় জীবনে। ৭৯ থেকে ৮৩ চার বছর চুটিয়ে লিখে, প্রকাশ করে, আবার শুরু হয়ে যায় তার মধ্যে সমস্যা। যা লিখছে, তাতে মন ভরলেও প্রাণ ভরছে না, আরও অন্যরকম, নতুনরকম লিখতে চায় সে। সমস্যা একসময় সংকটে দাঁড়ায়। আবার নানাকারণে তার ওপর কিছু অগ্রজের চোখ-ট্যাঁরানো, ক্ষুদ্র স্বার্থে ক্যাচলামো, ইচ্ছে-করে-অবজ্ঞা যথেষ্ট আঘাত দেয় তাকে, অভিমানী করে তোলে। আবার লেখা বন্ধ করে সে, অনুসন্ধান-পর্বকে জারি রেখেই।

সংসারে এরই মধ্যে ঘটে যায় পিতৃবিয়োগ। আজীবন অস্বাচ্ছন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করা বাবা, যখন তাঁর সব ছলে-মেয়েরাই প্রায় প্রতিষ্ঠিত (কয়েকজনের বিবাহও সম্পন্ন), সংসারে যখন অর্থাগমে হাসির ঝলক তখনই তার বাবা মাথা থেকে রুপোলি পালক ঝরিয়ে চলে গেলেন। বড়ো প্রভাব পড়েছিল তার জীবনে। এরপরেই আবার চাকরিতে বদলি, আবার কর্মস্থল বহরমপুর, আবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মানুষদের আহ্বান। না, এবার আর সে সাড়া দিল না। একটা বন্ধ্যা-পর্ব চলতে লাগল জীবনে। জীবন-প্রেমের যে শুরু কিছুকাল আগে, ভালোবাসার গভীরতাই বলা যাক বা অমোঘতাই বলা হোক, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গেই পরিণতি। বিবাহ। ৮৫-র ডিসেম্বর। এক ধরণের দায়, একটা টান, একটা বন্ধনের মধে জড়িয়ে যাওয়া। প্রায় আড়াই বছর লেখালিখি থেকে দূরে থাকার বন্ধ্যাবস্থারও অবসান এই সময়ে। ‘রৌরব’ পত্রিকার (বহরমপুর থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক) সম্পাদক লেখক শুভ চট্টোপাধ্যায় একদিন একদম সেই যুবকের বাড়ি। আক্ষরিক অর্থে আবার লেখায় ফিরতে হবে-- আহ্বান, রৌরবের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে সখ্যতা— অনুরোধ। সে-যে তাকে নিয়ে এতসব জানত, জানা ছিল না যুবকের। আন্তরিক এই টান, একই সঙ্গে নিজেরও বানপ্রস্থ কাটানোর ইচ্ছে মিলেমিশে শুরু হলো লেখালিখি, পত্রিকা করা। রৌরবে বন্ধু জুটল একদল, তাজা প্রাণ, কিছু করার বাসনায় উদগ্রীব। জুড়ে গেল সে। আবারও একটা ঘোর যেন। যৌবনমত্ততা। আবারও সংঘপ্রিয়তা, আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক, পত্রিকানির্মাণ, চায়ের দোকানে, প্রেসে, অন্ধকার মাঠে, হঠাৎ কারো বাড়িতে, ঘোরবর্ষায় নৌকায় নদীবক্ষে-নদীজোড়ে, শুঁড়িখানায়, কবিতা বিষয়ক আলাপ-আলোচনা, প্রেস-প্রুফ-বইমেলা-পত্রিকা বিক্রি-হুল্লোড়, কবিতা-সাহিত্য-সিনেমা-আঁকা-রাজনৈতিক চেতনা, বন্ধুত্ব-লেখা-লেখাপাঠ-তীক্ষ্ণসমালোচনা-ক্ষুরধার করার প্রক্রিয়া, ভেঙে বেরোনোর চেষ্টা আর প্রকাশ। এসবের কেন্দ্রমণি সেই কবিতা। এসময়েই কবিতা বিষয়ক গদ্য লেখারও শুরুয়াৎ তার। 

সংসারে আনন্দের ফসল হিসেবে প্রথম পুত্র-সন্তানের জন্ম। ১৯৮৮। পিতা হওয়ার অপার স্বাদ। আবার চাকরিতে বদলি। এবার কর্মস্থল ঘুরেফিরে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত তিনটে গ্রামে। কিন্তু লেখা জারি। পরিবার সঙ্গে। দূর থেকেই রৌরবের কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা। চাকরির প্রায় প্রথম থেকেই কমবেশি ইউনিয়নের (কর্মী সংগঠন) সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছিল। এবারে দায়িত্ব কাঁধে এল। ইউনিয়নের পদ নেওয়া এবং কাজ করা। একসময় এই দায়িত্ব বেশ কয়েকটি বড়ো পদে গিয়ে ঠেকল। কিন্তু লেখালিখির পর্ব কিছুটা স্তিমিত হলেও চলতে লাগল। মাঝেমধ্যে বহরমপুর আসা তার, মার জন্য, ভাইবোনদের জন্য। তখনও আড্ডা, পত্রিকা, আরওসব। বাঁকুড়ার গ্রামগুলো তাকে আরও এক অন্যভাবে জীবন চেনাল। দারিদ্র, ক্ষুধা, অশিক্ষা, আর জীবনসংগ্রাম। ইউনিয়ন চেনাল মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্খা-লোভ-কুচুটেপনা-হামবড়াই, সঙ্গে অবশ্যই কিছু ভালোবাসা আর সামান্য হলেও একটা আদর্শবোধ। নানাভাবে চেনা-জানা-শোনা-বোঝা, লেখক-বৃত্তের বাইরের জীবন, বিশেষত এ-দুটো প্রত্যক্ষতা তাকে সমৃদ্ধই করেছে। ৯৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান তার, সে-ও পুত্র-সন্তান। আনন্দ। দায়-দায়িত্বও বেড়ে যাওয়া। ৯৬ সালে আবার বহরমপুর প্রত্যাবর্তন। মুমূর্ষু ‘রৌরব’-কে সবাই মিলে আবার জাগানোর চেষ্টা, বেশকিছুটা সফল। এতদিন লিখছে, প্রকাশ পাচ্ছে, কিন্তু বই করার কোনও উদ্যোগ ছিল না তার। অনেকদিন ধরে বন্ধুদের তাগাদা এবারে জোরদার। ফলশ্রুতিতে ৭৯ সাল থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত লেখা কবিতা সমন্বয়ে প্রথম কবিতার বই ‘ঋতুপর্বের নাচ’ প্রকাশ পেল ৯৭-এর গোড়ায়। প্রথম বই, তা নিয়ে স্বাভাবিক উন্মাদনা উত্তেজনা সবই কাজ করেছিল তার মধ্যে। কিছু প্রতিক্রিয়াও মিলেছিল। তারপর ২০০০ এর গোড়ায় প্রকাশ পায় ‘কয়েক আলোকবর্ষ দূরে’ কবিতার বইটি। রচনাকালঃ ১৯৮৯- ১৯৯৬। এই বইটি অন্যধরণের কবিতা নিয়ে। অ্যান্টি পোয়েট্রির দিকে যাত্রা। সাড়া মেলে, অনেক চিঠিপত্র পায়, অনেক বন্ধুর সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগের সৃষ্টি হয়। ২০০৫ এর গোড়ায় প্রকাশ পায় ‘পরিযায়ী চলো’ কবিতার বই। এবারেও যথেষ্ট সাড়া, অনেক রিভিউ। পশ্চিমবঙ্গর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা ও কবিতা বিষয়ক গদ্য প্রকাশিত হতে থাকে। একসময় ‘রৌরব’ ২৪ বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। প্রয়াত হয় রৌরব-সম্পাদক, বন্ধু শুভ চট্টোপাধ্যায়। বুকে বাজে। একটা হাহাকার। কিন্তু সংসার চলে নিজ নিয়মে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিও চলতে থাকে, প্রতিটি বিষয়ে নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে একটা মনোভাব গড়ে ওঠে। একসময় চাকরিতে পদোন্নতি ঘটে, যা আগে সে প্রত্যাহার করে চলেছিল। ছেড়ে দেয় ইউনিয়নের সমস্ত পদ। এখন আরও মুক্ত, নির্ভার, আরও বেশি লেখালিখির সঙ্গে ওতপ্রোত।

সেই যুবক এখন প্রৌঢ়, যদি ৫০ বছর বয়সকে প্রৌঢ়ত্বের মাপকাঠি ধরা যায়। মনটা তার প্রৌঢ় হয়ে যায়নি। সে এমনটাই ভাবে। পদোন্নতির সূত্রে চাকরিতে স্থান-বদল। এবার আর সঙ্গে পরিবার থাকে না। একা, একা থাকা অভ্যেস হয়ে যায়। পারিবারিক বিচ্ছেদ নিজস্ব সময়টা বাড়িয়ে দিলেও তা খেয়ে নেয় চাকরির দায়িত্ব। মার মৃত্যু এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে। একটা শতাব্দী গড়িয়ে যায় তার উপস্থিতিতে। কম দেখা, পড়াশোনা, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো না। এই প্রকৃতি, তার নিসর্গ, তার জড়-জীব, বিশেষত মানুষ, প্রতিমুহূর্তে সংসর্গে সংঘর্ষে মিথস্ক্রিয়ায় উপলব্ধ বোধ-অনুভূতি-চেতনা- তার সম্প্রসারণ এরই উপজীব্যতায় রচিত হতে থাকল কবিতা। জন্মনিল নিজস্ব কবিতাভাবনা। লেখায় এল স্বতন্ত্রতা, ভিন্নতা, যা প্রচল বা গড্ডলের দাসত্ব করল না। এগোলো নতুন দিকে নতুনের অভিসারে। ভ্রমণ তার জীবনে আনল আরও ভিন্নতা। সেই প্রায় যুবক অবস্থা থেকেই পরিবার সহ, বা পরিবার ছাড়া একা, বা বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়ে-সমুদ্রে-বনে-মরুভূমিতে-ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণ জীবনের ভিন্ন স্বাদ-গ্রহণে সহায়তা করে চলল। একই সঙ্গে চাকরিতে বদলীর জন্য নতুন নতুন স্থান (লালগোলা, রামপুরহাট, সাঁইথিয়া, বালুরঘাট, বোলপুর) আর নতুন নতুন কবি-সাহিত্যিক বন্ধু প্রাপ্তির জন্যও এক ভিন্ন স্বাদাস্বাদন জীবনের রসদ। লেখালিখির এবং আরও প্রকাশের তাগিদে কবিতার বই প্রকাশিত হয়ে চলল। একেকটা বইয়ে ভিন্ন স্বাদ চলন নিজস্ব স্বতন্ত্রতার চিহ্ন সহ। ‘ভাঙা পিয়ানোর পা’ ২০০৯, ‘অপর বসন্ত’ ২০০৯, ‘ধনুক কথায় স্বর’ ২০১১। লেখায় তৃপ্তি মেলে না তবু। নিজেকে পালটাতে হয়, কখনও কলম থমকে যায়, কখনও বন্ধ হয়, সে-এক দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয় তখন। লেখার সংকট বড়ো কষ্টদায়ক তা সে টের পায় হাড়ে হাড়ে। আবার নানা প্রক্রিয়ায় মগ্নতায় সেখান থেকে সে বেরিয়েও আসে। কোনওদিন কারও মতো করে কবিতা লিখবে ভাবেনি সে, নিজের কবিতাটাই লিখতে চেয়েছে, নিজের মতো করে। হ্যাঁ সেই ভাবনার আলোকে অনেকের কবিতাভাবনার সঙ্গে তার যথেষ্ট মিল দেখা গেছে। কিন্তু কবিতাভাবনার মিল আর কবিতার মিল এক নয় সেটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তাই নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন নিজস্ব শৈলীতে। গদ্য লেখাও চললসমতালে, যা ক্রমাগত প্রকাশিত হতে থাকল। এরই মধ্যে তার জীবনে এল এক চরম বিপর্যয়। তখন বোলপুরে থেকে সনসত নামে এক গ্রামে প্রধান আধিকারিক হিসেবে কাজ করছে। একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে মোটর-বাইক দুর্ঘটনায় বাঁ হাঁটু দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। মাস-দেড়েক বিছানায় থেকে আবার যখন অফিস জয়েন করল তখন আর তার ক্ষমতা ছিল না সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরার। এসময়ই তার স্ত্রী হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ল। দায়িত্ব ছেড়ে যেতে পারল না সে। যেদিন যাওয়ার সুযোগ ঘটল সেদিন রাতেই (২৬ জুন, ২০১২) মাসিভ হার্ট-অ্যাটাকে চিরতরে চলে গেল সে। নিজে উপস্থিত থেকে কিছুই সামলানো হলো না তার। মরামুখ দেখল এসে। সে শুধু তার স্ত্রী-ই ছিল না, ছিল বন্ধু, প্রেমিকা, জীবনসঙ্গিনী। এক চরম আঘাত। জীবনধারাটাই বদলে গেল তার। একটা ট্রমায় চলে গেল। দুই ছেলে দু-জায়গায় পড়ছে। আর নয়, তাদের স্বার্থেই চাকরিতে ইস্তফা। একসময় বহরমপুরের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি। মহানগর। মানিয়ে নিতে পারবে তো সে? 

কোনও শূন্যতা জীবনকে খর্ব করলেও রুদ্ধ করতে পারে না। সময় একসময় তাকে আবার তালে লয়ে ছন্দে চলতে শেখায়। তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। এটা ঠিক দীর্ঘ একটা বছর কিচ্ছু লিখতে পারেনি সে। এটাও ঠিক মানসিক বিষাদ মাত্রাছাড়া হওয়ায় দু-আড়াই বছর নাগাড়ে মানসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেতে হয়েছে, কাউন্সেলিং করতে হয়েছে। কিন্তু ফিরতে পেরেছে সে, নিজের মানসিক জোরে আর ডাক্তারের পরামর্শে। সে মনে করে কবিতাই তাকে ফিরতে সহায়তা করেছে সবচেয়ে বেশি। লেখালিখিই তাকে আবার একটা জীবনের ছন্দে ফিরতে বাধ্যও করেছে। এসময় অনেক শুভাকাঙ্খী আর বন্ধুরা ছিল ঠিক তার পাশে, উদ্বুদ্ধ করেছে, সঙ্গ দিয়েছে, লেখায় ফিরতে সহায়তা করেছে। চাকরিহীন জীবনে, প্রায় সংসারহীন জীবনে, একাকীত্ব কাটানোর সবচেয়ে বড়ো ওষুধ পড়াশোনা ও লেখালিখি। তাতেই মজে গেল সে। অনেকটা চাপহীন, কিছুটা একা, বিষাদক্লিষ্ট কিন্তু প্রত্যয়ী। চলল লেখালিখি পত্র-পত্রিকার সম্পাদকদের অনুরোধে তাগাদায় চাপে। প্রকাশও ঘটতে লাগল কবিতার বই ও গদ্যের বইয়ে। ‘নদীতে সায়ং ভেসে যায়’ ২০১৪, ‘বালুমানুষের ঝুনঝুনাৎ’ (দীর্ঘ কবিতার সংকলন) ২০১৬, ‘আলোর হাঁসুয়া’ ২০১৬, ‘নৈর্ঋতে বিষুবে’ ২০১৬, ‘নামিয়ে রাখা চোখ’ ২০১৮, ‘আনারকলির তানপুরা’ ২০১৯, ‘শিরোনামহীন পুতুল’ ২০১৯। কবিতা বিষয়ক গদ্যের বই— ‘রিলেদৌড়ের অনিঃশেষ’ ২০১৭, ‘রবীন্দ্রকবিতাঃ আজকের উঠোনে’ ২০১৮, ‘কণিকা পাহাড়, কণা হিমালয়’ ২০১৯। এই সমস্ত বইয়ে ধরা আছে তার মনন-চিন্তন-প্রকরণ-শৈলী, যাতে তাকে চেনা যায়, কিছুটা হলেও ধরা যায়। 

সেই অতি-শিশু-শিশু-কিশোর-কৈশোরোত্তীর্ণ-যুবক-প্রৌঢ় অতিসাধারণ এক মানুষ, এক সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এক মানুষ আজ ৬৪ বছর বয়সে বার্ধ্যকের দোরগোড়ায়। যদিও সে মনে করে মনের দিক থেকে সে যথেষ্টই তরুণ আর রঙিন। কবিতাই তার এই মনোভাবকে সদাজাগ্রত রাখে। শৈশব থেকে কৈশোরের নানা উপাদান, নানা ঘাত-প্রতিঘাত, তার যৌবনকে ঋদ্ধ করেছে, আবার নষ্টও করেছে স্বাভাবিক সরল যাপনে। সময়ের ঢেউ আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যৌবন সৃষ্টিশীল ভূমিকা পালন করে তাকে নিয়ে এসেছে প্রৌঢ়ত্বে। অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, আর বিয়োগসঞ্জাত বিষাদ তাকে প্রৌঢ়ত্ব থেকে নিয়ে এসছে বার্ধ্যক্যের দোরগোড়ায়, যে আজও ভ্রমণপিপাসু, যে আজও চলনে বিশ্বাসী, চরৈবেতি-চরৈবেতি, যে আজও আনন্দকামী-আনন্দমুখী। যে একটা সত্যি আর স্বপ্নের জীবনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে প্রতীক্ষায়। “তীব্র হুইসেলে একটা সত্যি ট্রেন চলে না গেলে বুঝতেই পারতাম না/ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আর কিসের অপেক্ষায়!”। 

এই শিশু-কিশোর-যুবক-প্রৌঢ়-বার্ধক্যের গোড়ায় এসে দাঁড়ানো সামান্য ক্ষুদ্র মানুষটির নাম— উমাপদ কর, যে নিজেকে একজন ‘কবিতাকর্মী’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, নিজের লেখালিখিকে মনে করে ‘কাজ’, যে ভালোবাসে ঘুরতে, থিয়েটার দেখতে, গান শুনতে, চিনে-বাদাম খেতে, ছোট-মাছ খেতে, বন্ধুদের সঙ্গে দেদার আড্ডা সপান। যে মনে করে কবিতাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে শত বিয়োগেও।  
জুন, ২০১৯।

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.