রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ক্ষণজন্মা কবি : রুদ্রসাগর কুন্ডু

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ক্ষণজন্মা কবি : রুদ্রসাগর কুন্ডু
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ক্ষণজন্মা কবি : রুদ্রসাগর কুন্ডু





রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর। ১৯৯১ সালের ২১ শে জুন মৃত্যু বরণ করেন। ক্ষণজন্মা এই কবি অনেক গানও লিখেছেন। তিনি প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন। লিখেছে প্রেমের কবিতা। বিরহ বিচ্ছেদে জরাজীর্ণ কবির প্রতিটি গানে আত্মযন্ত্রণার সুর জেগে উঠতো। শ্রুতিমধুর কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি যোগ্য কবিতার জন্য তরুণ পাঠকেরা নয়নমনি করে রেখেছিল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার প্রচুর জনপ্রিয় কবিতা রয়েছে। ``বাতাসে লাশের গন্ধ'' তার জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম। তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মংলার মিঠেখালিতে গড়ে উঠেছে ``রুদ্র স্মৃতি সংসদ''।

আসুন, আমরা এবার কবির কিছু ব্যাক্তিগত বিষয়ে চর্চা করি। মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়েন কবি, লিখে ফেললেন কবিতা। ``আমি ঈশ্বর আমি শয়তান''। উনি লিখলেন :  
আমায় যদি তুমি বলো  ঈশ্বর, / আমি বলবো, হ্যাঁ আমি তাই। / আমায় যদি বলো পাপী শয়তান, / আমি বলবো, হ্যাঁ  আমি তাই-ই।/ -- কারণ আমার মাঝে যাদের অস্তিত্ব / তার একজন ঈশ্বর; অপরজন শয়তান। / তাই যখন শয়তানের ছবিটি ভাসে / আমার মানব অবয়বে- তখন আমি পাপী।/ আর যখন সত্যের পূর্ণতায় আমি- / মানবের কল্যানে আমার কর্ম / ঠিক তখনি আমি ঈশ্বর, কারণ / সত্য, পুণ্য আর মানবতাই ঈশ্বর।/
কবিতাটির নাম আগেই বলেছি। কবিতা লেখার সময়কাল ১৯৭৩। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ছিল ছদ্ম নামে প্রকাশিত। এই কবিতাটি পরবর্তী সময়ে কোনো কাব্যগ্রন্থেই স্থান দেননি কবি। সত্তুরের দশকের বাংলাদেশ ছিল আন্দোলন নির্ভর একটি সংগ্রামী জাতির দেশ। সমাজ ও রাজনীতির প্রতিটি পদক্ষেপে তখন প্রত্যাশা আর আশা ভঙ্গের অনিবার্য অস্থিরতা। সেই সময় কলম চালনায় অদম্য এক সাহসিকতা ছাড়া কেই বা পারে নৈরাশ্যের বিরুদ্ধে এমন কবিতা লিখতে? ``রুদ্র'' নামটি স্বনির্বাচিত। এবং শহীদুল্লাহ পরিবর্তন করে শহিদুল্লাহ, মোহাম্মদকে মুহম্মদ করা  তার ব্যক্তিগত নাম নির্বাচন। এভাবে তার নাম দাঁড়ালো, ``রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। বাংলা বানান নিয়ে তার আরো অনেক পছন্দ ও-পছন্দের গল্প আছে। তার একটি হল, তিনি মূর্ধন্য হ্যাবহার করতেন না।
রুদ্রসাগর কুন্ডু

নানাবাড়ির পাঠশালায় তৃতীয় শ্রেণি পাশ করে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন মংলা সদর থানার সেইন্ট পলিশ স্কুলে। ১৯৭৩ সালে ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে ৪টি বিষয়ে লেটার্স মার্কসহ বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পাশ করেন। এর পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। রুদ্রর পরিবার চাইতো ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু রুদ্র মানবিক বিভাগে ভর্তি হলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়তে লাগলেন। ১৯৭৮ সালে ডাকসুর নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচন করেছিলেন ``বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন'' থেকে। রুদ্র ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমৃত্যু তিনি এই ভাবধারাতেই টিকে ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি অনার্স পাশ করেন। ১৯৮৩ সালে নেন এম.এ ডিগ্রি।

এরই মধ্যে রুদ্রর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে যায়।``উপদ্রুত উপকূল'' এবং`` ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম''। পড়াশোনার সময় কালেই রুদ্র বিয়ে করেন। ২৯ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে তসলিমা নাসরিনকে। তসলিমা একজন ডাক্তার। রুদ্রর সঙ্গে পরিচয় লেখালেখির সূত্র ধরেই। পরবর্তীতে তসলিমাও রুদ্রর হাত ধরে লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়েন। তসলিমার সঙ্গে রুদ্রর বৈবাহিক জীবন স্থায়ী হয়নি। ছয়বছর দাম্পত্য জীবন শেষে ১৯৮৬ সালে দুজনের সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। 

এ সময় রুদ্র খুব ভেঙে পড়েন। জীবনে চরম অনিয়ম এবং যন্ত্রনা থেকে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে জীবন। বেহিসাবি ধূমপান ও মদ্যপানের ফলে পাকস্থলীতে আলসার হয়ে যায়। পায়ের আঙুলে বার্জারস ডিজিজ। তার কাছে এসবের গুরুত্ব ছিল না। ধুকতে ধুকতে জীবনকে শেষ করেছেন কবি। জীবনের শেষ সময় মানে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নীলক্ষেত বাবুপুরায় নিঃসঙ্গ সময় কাটাতেন।  

নীলক্ষেতে কবি অসীম সাহার সাহিত্য আড্ডায় মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আহমদ ছফা, চিত্রকর সময় মজুমদার, সংগীত শিল্পী কিরণচন্দ্র রায়, কবি কাজলেন্দু দে প্রমুখ এসে নিয়মিত বসতেন। থাকতেন রুদ্রুও। একদিন রুদ্র নেই। পেপটিক আলসারে অসুথ হয়ে ঢাকার হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে রুদ্র চিকিতসাধীন। হাসপাতালে সপ্তাহব্যাপী থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ২০ জুন বাসায় ফেরেন। ২১ জুন ১৯৯১ সালের সকালবেলা দাঁত ব্রাশ করার সময় বেসিনের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে যান। সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট।  

পরদিন ২২ জুন চিরনিদ্রায় শায়িত রুদ্র চলে আসেন মংলার মিঠেখালিতে। না, সবকিছু এতো অল্পে আর সহজে হয়নি। রুদ্রর মৃত্যু সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলো গোটা সাহিত্য মহল। দেশে বিদেশে শোকাহত হয়েছেন লাখ কবি। ভক্তরা তারস্বরে কেঁদেছেন কবির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। কবি অসীম সাহা সন্তান হারানোর বেদনা পেয়েছেন। নীলক্ষেত নীরবতায় ঢেকে গেছিলো। বাংলা কবিতায় এতটাই প্রভাব ছিল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর, বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি থেকে ২১৪ পৃষ্ঠার আকারে প্রকাশিত হলো রুদ্রর জীবনী গ্রন্থ। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক তপন বাগচীর সম্পাদনায়।













Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.