গ্রেগর জোহান মেণ্ডেল ( ২০ জুলাই ১৮২২ - ৬ জানুয়ারি ১৮৮৪)
জন্মদিন উপলক্ষে জিন নিয়ে কিছু কথা
মৃদুল শ্রীমানী
গুহা ও কোটরবাসী আদিম মানুষ শিকার করে পশু পাখির মাংস খেত ও সেই মাংস আগুন জ্বেলে ঝলসে খেলে তুলনায় সুস্বাদু হত, সহজপাচ্য হত বুঝতে পেরেছিল। তার খাওয়া সেই মাংসের ফেলে দেওয়া হাড় ও অন্যান্য অংশ খেতে আসত নেকড়ে বাঘের দল। ক্রমে এদের একটি অংশ মানুষের সঙ্গ পেতে পছন্দ করা শুরু করে। নেকড়ে বাঘের থেকেই কুকুরের মতো জানোয়ারের উদ্ভব। মানুষ কুকুরের প্রজনন লক্ষ্য করেছিল। কুকুরের প্রজনন বৈশিষ্ট্যের ফলে নানাবিধ গুণ ও দক্ষতা সম্পন্ন কুকুরের উদ্ভব হয়েছিল। কোনো কুকুর শিকার ধরতে সহযোগিতা করত। কেউ নিহত শিকার খুঁজে আনতে পারত, আবার কেউ পাহারা দেবার কাজে ওস্তাদ।
আজ থেকে প্রায় একলক্ষ বছর আগে খুঁজে, কুড়িয়ে , শিকার করার জীবন থেকে চাষের কাজে মানুষ লিপ্ত হয়েছিল। গুহাবাসী, বৃক্ষবাসী আদিম মানুষ লক্ষ্য করেছিল বীজ থেকে গাছ মাথা তোলে। সেই নতুন গাছে একসময় ফুল ও ফল আসে। তাতে আহার্য সংস্থান সহজ হয়। এরপর পছন্দসই গাছের বীজ সংগ্রহ করে গাছ লাগানোর কাজ থেকে ক্রমে কৃষি কাজের উদ্ভব। চাষের কাজে পশুকে নিয়োজিত করে মানুষ নিজের কাঁধের জোয়াল হালকা করেছিল। এইসূত্রে চাষের কাজের পশু, যাতায়াতের সহায়ক পশু ও মালবহনের পশুর নানা বৈশিষ্ট্য মানুষ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছিল, ও ক্রমেই তার প্রজননের কৌশল করায়ত্ত করেছিল। সভ্য হয়ে উঠতে থাকা মানুষ লক্ষ্য করেছিল উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্রস ব্রিডিং করলে নানাবিধ উন্নত গুণবিশিষ্ট উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্ম হয়।
গ্রেগর জোহান মেণ্ডেল ( ২০.০৭.১৮২২ - ০৬.০১.১৮৮৪) ছিলেন এক পরিশ্রমী কৃষকের সন্তান। মেণ্ডেল পরিবার প্রায় ১৩০ বৎসর ধরে মোরাভিয়া- সাইলেশিয়া সীমান্তে হাইনসিস নামে একটি গ্রামে চাষবাসের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করতেন।
ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক পরিবেশে মেণ্ডেল বাগানের কাজে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন। আর ওইসাথে মৌমাছি পালন শিখেছিলেন। চাষবাস করায় মেণ্ডেল পরিবারে অন্নের অভাব না থাকলেও নগদ টাকার রীতিমতো সংকট ছিল। অথচ পড়ার আগ্রহ ছিল মেণ্ডেলের প্রচণ্ড। সেই জন্য সাধু বনলেন। অগাস্টিনিয়ান সাধুদের একটি আশ্রমে মেণ্ডেল সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করলেন, যে সাধুগিরির অকৃত্রিম উদ্দেশ্য তিনি নিজেই জানিয়েছেন, অন্নাভাব থেকে মুক্তি পাওয়া।
সাধুগিরির ফাঁকে ফাঁকে ছোটবেলায় শেখা বাগানের কাজের পুঁজির উপর নির্ভর করে সাধারণ মটরশুঁটি নিয়ে বংশগতির পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দিলেন। ১৮৫১ সালে মঠাধ্যক্ষ সিরিল ফ্র্যান্টিসেক ন্যাপ তাঁকে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন । সেখানে তিনি অন্যান্য বিদ্যার সঙ্গে মূলতঃ পদার্থবিদ্যা চর্চা করেছিলেন।
১৮৫৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়ে মঠে তিনি ফিরে এলেন। ১৮৫৪ সালে মঠাধ্যক্ষ ন্যাপ তাঁকে উদ্ভিদ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য বাগান করতে প্রায় পাঁচ একর জমি দেন। অনেক আগে থেকেই ১৮৩০ সালে মঠাধ্যক্ষ ন্যাপ মহোদয় এই বাগানে গাছগাছড়া লাগিয়ে রেখেছিলেন।
মেণ্ডেল একদা ওলোমোউক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও দর্শনের ছাত্র ছিলেন। সেখানে কৃষিবিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপক জোহান চার্লস নেস্টলার উদ্ভিদ ও প্রাণীর বংশগতির নানাবিধ বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। মূলতঃ তাঁর চর্চার বিষয় ছিল ভেড়ার প্রজনন। এঁদের কাজের দ্বারা মেণ্ডেল প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজের গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ মটরশুঁটি যাকে পাইসাম স্যাটিভাম বলা হয়, তার বংশগতিকে।
এই গবেষণার শুরু হয়েছিল ১৮৫৬ সালে, তখন তাঁর চৌত্রিশ বছর বয়স। মেণ্ডেল সাধারণ মটরশুঁটির সাতটি বিষয় নিয়ে নিজের লক্ষ্য কেন্দ্রীভূত করেন। ১. মটরশুঁটির দানার গঠন, ২. ফুলের রং, ৩.বীজের খোসার রং, ৪. শুঁটির গঠন, ৫. কাঁচা শুঁটির রং, ৬. ফুলের অবস্থান, এবং ৭. উদ্ভিদের উচ্চতা।
প্রথমে মেণ্ডেল দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, মটরশুঁটি বীজের গড়নের দিকে, সেটি নিটোল গোল, না, কুঁচকানো।
মটরশুঁটি গাছের দৈর্ঘ্যের প্রশ্নে মেণ্ডেল দেখালেন বিশুদ্ধ লম্বা গাছের সঙ্গে যদি বিশুদ্ধ বেঁটে গাছের সঙ্করায়ণ করা যায়, তাহলে দ্বিতীয় প্রজন্মের অপত্য উদ্ভিদে প্রতি চারটি উদ্ভিদে একটি বিশুদ্ধ বেঁটে গাছ জন্মায়, একটি বিশুদ্ধ লম্বা গাছ জন্মায়, আর দুটি হয় সঙ্করজাতীয়।
এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল সংরক্ষণ, ও যুক্তিবিচার বিশ্লেষণ করে তিনি যে তত্ত্ব হাজির করলেন তা পরবর্তী বিজ্ঞান সাধকের পরিশ্রমে ল অফ সেগ্রিগেশন আর ল অফ ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট অ্যাসর্টমেন্ট নিয়ম নামে চিহ্নিত। এটাই মেণ্ডেলের বংশগতি তত্ত্ব নামে পরিচিত হয়েছে।
১৮৬৬ সালে মোরাভিয়ার ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে দু দুটি সেমিনারে তিনি "উদ্ভিদ সঙ্করায়ণের বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা" নাম দিয়ে গবেষণা পত্র পাঠ করলেন। ১৮৬৬ তেই মেণ্ডেলের এই গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু, প্রকাশের প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর পরেও খুব সামান্য সংখ্যক ব্যক্তি মেণ্ডেলের গবেষণা পত্র নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
লক্ষ্য করা দরকার, সমসাময়িক যুগন্ধর বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ( ১২.০২.১৮০৯ - ১৯.০৪.১৮৮২) পর্যন্ত মেণ্ডেলের গবেষণা বিষয়ে অবহিত ছিলেন না। তা যদি হত, তাহলে ডারউইন এর যুগান্তকারী প্রতিভার ছোঁয়ায় জেনেটিক্স অনেক আগেই একটি বড়ো জায়গায় পৌঁছে যেত। মেণ্ডেল যখন তাঁর গবেষণাপত্র ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে পাঠ করেছিলেন, তখন জনা চল্লিশ বিজ্ঞানী সেই বক্তৃতা শোনেন। কিন্তু মনে হয় মেণ্ডেলের বক্তৃতার সারমর্ম তাঁরা বুঝতে পারেন নি।
এরপর মেণ্ডেল সেই সময়ের একজন বড়ো জীববিজ্ঞানী কার্ল নাগেলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু, নাগেলিও মেণ্ডেলের বক্তব্য অনুধাবন করতে পারেন নি। বিজ্ঞানীদের কাছে পাত্তা না পেলেও মেণ্ডেল আশা হারান নি। তিনি বলতেন, একদিন এসব মানুষ বুঝতে পারবেন।
আজ আমরা জানি, বংশগতির এই রহস্যের পিছনে বহুসংখ্যক জিনের অবদান রয়েছে। জিন সম্পর্কে চার্লস ডারউইনেরও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। যদিও ডারউইন "প্যানজেনেসিস" নামে একটা তত্ত্ব খাড়া করে "জেমমিউল" নামে কোনো একটা কিছুর ঘাড়ে চেপে জীবের বৈশিষ্ট্য অপত্য প্রাণীতে সঞ্চারিত হয় বলেছিলেন, তথাপি আধুনিক যুগে "জিন" বলতে বিজ্ঞানীরা যা বোঝেন, ডারউউনের প্যানজেনেসিস বা জেমমিউল তার কাছাকাছি পৌঁছায়নি।
১৯০০ সালে হুগো ডি ভ্রিস, কার্ল কোরেন্স, এরিক ভন শ্চারমাক এবং উইলিয়াম জাসপার স্পিলমান প্রমুখ বিজ্ঞানীরা মেণ্ডেলের সংগৃহীত তথ্য নিয়ে পুনরায় নাড়া ঘাঁটা শুরু করেন। এছাড়া কার্ল পিয়ারসন এবং ডবল্যু এফ আর ওয়েলডন রাশিবিজ্ঞানগত পরিসংখ্যান দিয়ে মেণ্ডেলের তথ্য পুনঃপরীক্ষা করেন। পরবর্তীতে মেণ্ডেলের তত্ত্বের সাথে ডারউইনের তত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন স্যর রোনাল্ড আইলমার ফিশার (১৭.০২.১৮৯০ - ২৯.০৭.১৯৬২)। রাশিবিজ্ঞানগত পরিসংখ্যান দিয়ে বৈজ্ঞানিক ভাবনা বিকশিত করা, ও যুক্তি উপস্থাপন করায় স্যর ফিশার বিখ্যাত । মেণ্ডেলের কথা বলতে বলতে বিজ্ঞানী হুগো ডি ভ্রিস এর কথা বলতেই হয়। ১৮৪৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মেছিলেন। ৮৭ বৎসর বয়সে ১৯৩৫ সালের ২১ মে তারিখে তিনি প্রয়াত হন। এই ডাচ বিজ্ঞানসাধককে আমরা প্রথম যুগের জিন বিজ্ঞানী বলে গণ্য করি। আঠারো বছর বয়সে, ১৮৬৬ সালে তিনি লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। চার্লস ডারউইনের ইভলিউশন থিওরিতে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। চার্লস ডারউইনের প্যানজেনেসিস তত্ত্বকে কিছুটা সংস্কৃত করে ১৮৯৯ সালে হুগো ডি ভ্রিস তাঁর বই "ইনট্রা সেলুলার প্যানজেনেসিস" প্রকাশ করেন। ১৮৯০ নাগাদ তিনি মেণ্ডেলের গবেষণা পত্রের খোঁজ পান। তখনো অবধি মেণ্ডেলের গবেষণা বিজ্ঞানীদের মধ্যে সেভাবে পরিচিত ছিল না। এই ১৮৯০ সালেই হুগো ডি ভ্রিস একটি ফরাসি বিজ্ঞান জার্ণালে মেণ্ডেলের আবিষ্কৃত বিষয়গুলি মেণ্ডেলের নামোল্লেখ না করেই প্রকাশ করে দেন। এমনকি তিনি মেণ্ডেলের ব্যবহার করা বৈজ্ঞানিক পারিভাষিক শব্দগুলিকে নিজের মনোমত করে বদল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু, হুগো ডি ভ্রিস এর এই কাণ্ডে বাদ সাধলেন একজন জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কার্ল ইরিচ কোরেন্স ( ১৯.০৯.১৮৬৪ - ১৪.০২.১৯৭৩)। কঠোরভাবে সমালোচনা করে তিনি হুগো ডি ভ্রিসকে সতর্ক করেন। কোরেন্স মেণ্ডেলের কাজ নিয়ে পুনরায় আলোকপাত করেছেন। একই সাথে ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে জিন বিষয়ে গবেষণার ভিত্তিভূমি গড়তে অবদান রেখেছেন। কোরেন্স এর উদ্যোগে নিজেকে সংশোধন করে নিয়ে ডি ভ্রিস বিশ্বের সামনে মেণ্ডেলের কাজকে উপস্থাপন করেন। ডি ভ্রিস ১৯০০- ১৯০৩ এই সময়কালের মধ্যে দুইখণ্ডে নিজের গুরুত্বপূর্ণ বই "দি মিউটেশন থিওরি" প্রকাশ করেন। ১৯০৫ সালে ডি ভ্রিস লেখেন "স্পিসিজ় অ্যাণ্ড ভ্যারাইটিজ় : দেয়ার অরিজিন বাই মিউটেশন।" ইভলিউশন কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে ডি ভ্রিস এর মিউটেশন তত্ত্ব সাহায্য করে।
আগেই বলেছি, ডারউইনের ধারণা ছিল "জেমমিউল" নামে একটা কিছু জীবের গুণাবলী অপত্য জীবে সঞ্চারিত করে। তাঁর ব্যবহৃত প্যানজেনেসিস শব্দটি কেটে ছেঁটে "জিন" শব্দটি দাঁড় করিয়েছিলেন ডেনমার্কের বিজ্ঞানী উইলহেল্ম জোহানসেন। সেটা ১৯০৯ সাল। কিন্তু এই ধারণার গোড়ায় রয়েছে গ্রেগর জোহান মেণ্ডেলের গবেষণা।
১৮৫৬ থেকে ১৮৬৩ সাল অবধি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মেণ্ডেল যে তত্ত্ব ১৮৬৬ তে মোরাভিয়ার ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির দু দুটি সভায় পাঠ করলেন, তার আগেও জেনেটিক্স শব্দটি উঁকি মেরে গিয়েছে । ১৮১৯ সালে হাঙ্গারিয়ান বিজ্ঞানী ইমরে ফেসটেটিকস তাঁর বই লিখেছেন, যার নাম "দি জেনেটিক ল অফ দি নেচার।"
উইলিয়াম বেটসন ( ০৮.০৮.১৮৬১ - ০৮.০২.১৯২৬) নামে ইংরেজ বিজ্ঞানী "জেনেটিক্স" কথাটা নতুনভাবে আনলেন। সেটা ১৯০৫ সালের কথা। তাঁর বইয়ের নাম ছিল মেটেরিয়ালস ফর দি স্টাডি অফ ভ্যারিয়েশন। অবশ্য অনেক আগেই ডারউইনের অনুপ্রেরণায় প্যানজিন শব্দটি দিয়ে জিন নামে জিনিসের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন হুগো ডি ভ্রিস। আর ডারউইন স্বয়ং ব্যবহার করেছিলেন জেমমিউল শব্দটি। জননের সময় যে পদার্থগুলি নিঃসৃত হয়ে জীবের বৈশিষ্ট্য অপত্য জীবে বহে যায়, ডারউইনের ভাষায় তাকেই জেমমিউল বলে চেনানো হয়েছে।
জিন এর মূল বস্তু যে ডি এন এ তা প্রমাণিত হয়েছে ১৯৫২ সালে হারসে - চেজ় এক্সপেরিমেন্ট মারফতে। ১৯৫৩ সালে রোজালিণ্ড ফ্রাঙ্কলিন ও মরিস উইলকিনস এর আবিষ্কৃত এক্স রে ক্রিস্ট্যালোগ্রাফি পদ্ধতির আশ্রয়ে ডিএনএ র হেলিক্যাল স্ট্রাকচার বা প্যাঁচোয়া গড়ন আবিষ্কার করেন জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক।
বংশগতির নানা বিষয় লক্ষ্য করে গায়ের রঙ, দেহের উচ্চতা, নাক মুখ চোখ আর ঠোঁটের গড়ন, ইত্যাদির মধ্যে কয়েকটিকে বিশেষ ভাল বলে চিহ্নিত করে, তাকে আর্য বা নর্ডিক লেবেল সেঁটে সর্বোত্তম আখ্যা দিয়ে, ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার এক অমানবিক প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিছু বিজ্ঞানকর্মী ও প্রকৌশলীকে তাঁবেদার বানিয়ে, জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার মনগড়া সব তথ্য খাড়া করে ইহুদি নিধন শুরু করেন।
শুধু হিটলারের উপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। হিটলারের প্রতিপক্ষ ইংরেজ ও আমেরিকানরা কালা আদমি নাম দিয়ে ভারত, আফ্রিকা ও আমেরিকার ভূমিপুত্রদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছে। ভারতের ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেনের সভ্য মানুষের জন্য এক আইন রাখত, আর নেটিভ ভারতীয়দের জন্য সম্পূর্ণ বিপরীত রকম আইন আনতে মনে কোনো বাধা দ্বিধা সংকোচ অনুভব করত না। লোধা শবর গোষ্ঠীর মানুষকে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভাবে অপরাধপ্রবণ আখ্যায়িত করে নানা অবিচার অত্যাচারের শিকার হতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ সরকার। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেকটি অংশকে শূদ্র নাম দিয়ে নানা ধরনের বঞ্চনার ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। বলেছিলেন শূদ্রেরা ব্রহ্মার পায়ের থেকে জন্মেছে। এবং তারা পশুর সামিল। মুসলমানদের মধ্যেও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যধারী মানুষকে কাফের বলে চিহ্নিত করে অত্যাচার করার কথা বলা হয়েছে।
আজ আধুনিক জেনেটিক্স প্রমাণ করে দিয়েছে যে, আমরা সবাই মানুষ, এবং আমরা সকলেই হোমো সেপিয়েনস সেপিয়েনস। সকলেই সুযোগ পেলে পড়াশুনা, জ্ঞান বিজ্ঞান, ও সংস্কৃতি চর্চায় পারদর্শিতা দেখাতে পারে, এ আজ প্রমাণিত সত্য। জিন নিয়ে পড়াশুনার আলোকে আজ নতুন করে বলার সুযোগ এসেছে, "জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি।"
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন