ক্যালোটিস ভার্সিকালার : দেবাশিস দে

দেবাশিস দে

ক্যালোটিস ভার্সিকালার
দেবাশিস দে

কিরে এখনও শুয়ে আছিস ? অফিস যাবি না ? – বিজু জিজ্ঞাসা করে। সুনেত্র বলে – না আজ ভালো লাগছে না, যাব না, অফিসে জানিয়ে দিয়েছি। বিজু বলে – সে কিরে কাল বললি অফিসে অনেক কাজ, যতই শরীর খারাপ হোক আজ অফিসে যেতেই হবে। আর আজ অন্য কথা। সত্যি ক্যালোটিস ভার্সিকালার।

কথাটা শুনে সুনেত্রর মুখ ভার হয়ে যায়। বিজু খেয়াল করে না। অফিসে চলে যায়। দুই বন্ধুর ছোটো বেলা থেকে খুব ভাব। পড়াশুনা খেলা ধুলা সবই একসঙ্গে। এমনকি কলকাতা থেকে এই দিল্লিতে আসার কারণও তাই। যদিও চাকরি করে দুজনে দুই আলাদা অফিসে। যতই প্রিয় বন্ধু হোক কোনো কারণ ছাড়া এই রকম একটা ইংরেজি গালাগাল সুনেত্র মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। সুনেত্র এটুকু বুঝে যায় এখন নূতন অফিসে বিজু কাজ করে। হয়তো নূতন অফিসে অনেক বন্ধু বান্ধবও হয়েছে। তাদের কারও থেকে ও নিশ্চয় এইসব শিখেছে। ঠিক ক’রে নেয় আজ বিজু অফিস থেকে ফিরলে একটা ফয়সলা করতে হবে।

কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সুনেত্র। না টিভি না মোবাইল। একবার এটা একবার ওটা। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। সময় কেটে যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দরজায় বেল বাজে। সুনেত্র দরজা খুলে দিয়ে খাটে আজকের পেপারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। বিজু দূর থেকে সুনেত্রর হাব ভাব দেখে বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে এসে সুনেত্রর পাশে বসে বলে – আজ তোর কী হয়েছে রে। এত চুপ চাপ। শরীর ভালো তো। সারাদিন কি কি করলি বল।
সুনেত্র চুপ ক’রে থাকে।
বিজু – কিরে, তোর কী হল বল তো।
সুনেত্র – আমি কী খারাপ কাজ করেছি যে তুই সকালে ইংরেজিতে গালাগাল দিয়ে চলে গেলি? নতুন নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশছিস্‌ আর এইসব নতুন নতুন গালাগাল শিখছিস্‌। এর চেয়ে তো দু’ঘা মেরে দিলে পারতিস।
বিজু কিছু বলবে কি হো হো ক’রে হাসতে থাকে।
সুনেত্র – গালাগালও দিবি আবার হাসবি।
বিজু – তুই জানিস ক্যালোটিস ভার্সিকালার মানে কী? কাল একটা জার্নালে পেলাম নামটা। দারুণ লাগল। শব্দ দুটোর মধ্যে একটা ভাইসচ্যান্সেলার গন্ধ আছে না? কাল যখন তুই বললি আজ অফিসে তোকে যেতেই হবে আর আজ যখন বললি আফিসে যাবি না তখন হঠাৎ আমার এই মজাদার শব্দটা মাথায় এসে গেল। বলে ফেললাম তাই। কিন্তু তুই যে এটাকে এত খারাপ ভাবে নিবি আমি তো একদম বুঝতেই পারিনি।
সুনেত্র – আমি যে এই শব্দটা কোনোদিন শুনিনি। কি করে জানব শব্দটা ভালো না খারাপ। তুই বল।
বিজু – ক্যালোটিস ভার্সিকালার আপাত দৃষ্টিতে খারাপ হলেও এরা এক প্রকার শিল্পী কিন্তু।
সুনেত্র – কি রকম?
বিজু – আমাদের চারপাশের বন বাদাড়ে এইসব প্রাণী দেখা যায়। ত্রিশ থেকে চল্লিশ সেন্টিমিটার লম্বা হয় এরা। ভালো গাছে চড়তে পারে। ফসলের অপকারী কীট পতঙ্গ ধ্বংস ক’রে এরা আমাদের উপকার করে। রাসায়নিক  বস্তুর প্রকৃতি বিচারের জন্য এদের কিন্তু অতিরিক্ত অঙ্গ বা শক্তিশালী ইন্দ্রিয় থাকে। বলত দেখি আমি কিসের কথা বলছি।
সুনেত্র – ঠিক ধরতে পারছি না। তবে যা বলছিস গিরগিটির সঙ্গে কিছু মিল পাচ্ছি মনে হয়।
বিজু – এই তো বন্ধু ঠিক ধরেছ। গিরগিটির সাইন্টিফিক নাম হল ক্যালেটিস ভার্সিকালার। তবে একটা মজার আর রহস্যের জিনিস কিন্তু আছে এদের জীবনে। তা হল এদের প্রজনন পদ্ধতি।
সুনেত্র – বল না, জানতে ইচ্ছা করছে।
বিজু – এইবার মজা পেয়েছ দেখছি। বলছি বাবা বলছি। শোন তাহলে। আমার মনে হয় এটা শুনলে তোর কলেজের কথা মনে পড়ে যাবে। যাক্‌। বলছি। প্রজনন মরসুমে পুরুষ গিরগিটি সামনের পা-দুটো সহ মাথা থেকে বুক পর্যন্ত কালো লাল রঙ ধারণ ক’রে গলা ফুলিয়ে স্ত্রী গিরগিটিকে আকর্ষণ করে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এদের প্রজনন কাল। প্রজননের পর স্ত্রী গিরগিটি নরম মাটিতে কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা গর্ত ক’রে ৬ থেকে ২০টা ডিম পাড়ে। ডিমগুলি ছয় থেকে সাত সপ্তাহে ফোটে। সদ্য ফোটা বাচ্চার রঙ হাল্কা সোনালী হলুদ থেকে বাদামী রঙের হয়।
প্রজনন মরসুম ছাড়াও শিকারী প্রাণী বা শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য দেহের রঙ পরিবর্তন ক’রে শত্রুকে ভয় দেখায় নয়তো প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়।
সুনেত্র – দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
বিজু – তাহলে তুই আমার উপর বেকার রাগ করছিলি। মানুষ তার শরীর নিয়ে এত শিল্প করতে পারবে?
সুনেত্র – তা যা বলেছিস। সত্যি এ এক রহস্য আবৃত প্রাণী।
বিজু – তোকে তো আর একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসই বলা হয়নি।
সুনেত্র – বেকার কৌতুহল বাড়িয়ে লাভ কী? বল না বাবা।
বিজু – টেক্সাসে এক রকমের গিরগিটি দেখতে পাওয়া যায় যাদের ত্বকের একটা আশ্চর্য গুণ আছে। জল তেষ্টা পেলে ত্বক দিয়ে জল শুষে নিতে পারে বা দেহের কোনো অংশে জল পড়লেও দেহ তা শুষে নেয় আর সেই জল একেবারে মুখে চলে আসে। আসলে এদের দেহের প্রতিটি আঁশের মাঝে একটা নালী থাকে আর এই নালী বেয়ে জলীয় পদার্থ মুখগহ্বরে প্রবেশ করে।
সুনেত্র – সত্যি, এই ছোটো প্রাণীটিকে দেখে বোঝা যায় না এদের এত ক্ষমতা আছে।
বিজু – এখন তাহলে বল তোকে কত দামি শব্দ দুটো বলেছিলাম। আর তুই আমার উপর রাগ ক’রে থাকলি সারাদিন। যাক অনেক হয়েছে বক বক। এবার একটু দানাপানি খেয়ে বিশ্রাম নেওয়া যাক।
বিজু উঠে যায়।
সুনেত্র ভাবতে থাকে – সত্যিই কি সে নিজে ক্যালোটিস ভার্সিকালার? আজ তো তার কিছুই হয়নি। বস যেহেতু অনেক কাজ তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে তাই বসকে জব্দ করতে শরীর খারাপ বলে অফিসে ফোন ক’রে দিয়েছে। এখন পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে হোমো স্যপিয়েন্সরা কি ক্যালোটিস ভার্সিকালার হয়ে যাচ্ছে !!
                      *
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.