কবির শেষলেখা
মৃদুল শ্রীমানী
১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই। তাঁর শেষ লেখাটি তিনি লিখবেন। 'লিখবেন' বলাটা যেন ঠিক হল না। আধোজাগর কবি চেতনার গভীরতল থেকে মন্দ্রস্বরে বলে যাবেন, আর শেষ লেখাটি জন্ম নেবে এক আপনজনের কলমে। আশি পেরিয়ে শরীর ভাল যাচ্ছিল না। প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ডের সমস্যা ছিল। শল্য চিকিৎসা পছন্দ করতেন না কোনো কালেই। পছন্দ করতেন না কলকাতার ঘিঞ্জি পরিবেশ। জানতেন, তাঁর যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আগেও কখনো জ্ঞান হারিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে এসে লিখেছেন প্রান্তিক। এবারের যাওয়াটা যেন শেষ যাওয়া। একধরনের আচ্ছন্নতার মধ্যে কার সাথে যেন তাঁর কথা হয়, তা কবিই জানেন। অনেক রকম করে সেই অপরিচিতার সাথে কবির আজীবনের সম্পর্ক।
আলো অন্ধকারের অতীত কোনো গহন রহস্যময় জগতের সংকেত দেন কবি। শেষ লেখায় তিনি বলেছেন, সৃষ্টির সমগ্র পথ এক বিচিত্র ছলনাজালে আকীর্ণ। সেখানে মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ। সেখানে মহত্ত্বকে প্রবঞ্চিত হতে হয়। কবি যেন অনুভব করেন, সৃষ্টির কাছে মহতের পরম প্রাপ্তি সেই প্রবঞ্চনা। সাধারণ লোকের কাছে এই মহৎ মানুষ বিড়ম্বিত ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত। কিন্তু কবির বিশ্বাস কিছুতেই মহৎকে শেষ হিসেবে প্রবঞ্চনা করা যায় না। তার অন্তর চিরস্বচ্ছ। সহজ বিশ্বাসে চিরসমুজ্জ্বল। যে পুরস্কার সে পায়, তা বুঝি শান্তির অক্ষয় অধিকার।
এইসব বাগ্ বিন্যাস এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে করে যেতে থাকেন কবি। কবি আদৌ কিছু বলেন কি? না কি, তাঁর চেতনার অন্তঃস্থল থেকে উদ্গীর্ণ হয় তাঁর গোটা জীবনের অভিজ্ঞান। এক ছলনাময়ীর কথা বলেন তিনি। সারা জীবন ধরে বারে বারে এক ছলনাময়ীর সাথে তাঁর লেনাদেনা। ছলনা। সারা জীবন প্রাণপণ করে যে ফসল কবি ফলাবেন, তা যেন সেই রহস্যময়ী নিয়ে চলে যাবেন।
অথচ, তাঁকেই তো তিনি ডেকেছেন বারেবার। কবির সোনার ফসল উঠে যায় ওঁর সোনার তরীতে। তার পর কবি নিজে সেই তরীর এক কোণে একটু জায়গা পেতে চাইলে, জায়গা আর মেলে না। কবি কে সেই তরীতে না নিয়ে, তীরে তাঁকে ফেলে রেখে, কবির উৎপন্ন সম্ভার সেই আধো চেনা সত্ত্বা তাঁর নৌকায় নিয়ে চলে যান।
যৌবনেই বোধ হয় নিজের শেষের মুহূর্তটির সূচনা দেখেছিলেন কবি। ওই সোনার তরীতে এক ছলনাময়ীর আসা যাওয়া। সে তাঁকে ইঙ্গিত করে দূরে পশ্চিমে অস্তায়মান সূর্যের আলোয় সোনালি তরঙ্গখচিত নীলাম্বুরাশির দিকে। ছলনাময়ীর কাছে কবি জানতে চান সেখানেই কি তাঁর আবাস? রহস্যময়ীর নিবিড় সঙ্গ পেতে কবি উৎসুক। সমস্ত মন প্রাণ চেতনা দিয়ে তাঁর কোমল স্পর্শ খোঁজেন কবি। মেলে না, কিছু মেলে না। মেলে না উত্তর। কখনো কবি সেই ছলনাময়ীর সুর শুনতে পান। অনুভব করেন, সীমার মাঝে অসীমের সুর বাজে। সে এক অদ্ভুত আলোময় জগৎ। সে আলোয় কোনো ছায়া পড়ে না। আর সেই আলোতেই কবিজন্ম। কবিকে কাঁদিয়ে, কবির চোখের জলে সে সুন্দর বিধুর হয়ে ওঠে। কখনো বলেন, একা একা দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ মেলে সারাদিন অপেক্ষা করে থাকেন চিরকালের আপন সত্ত্বাটির জন্য। কখন আসবে কাঙ্ক্ষিত শুভক্ষণ, তার জন্য কবির আকুতি ভরা অপেক্ষা। অপেক্ষার প্রহরে কবি কখনো হাসেন, কখনো গান গেয়ে ওঠেন, আর কোথা থেকে এক সুগন্ধ ভেসে আসে। বেশ বুঝতে পারেন, তাঁর চারপাশে এক জ্যোতিসমুদ্র, আর তারই মাঝে একটি শতদল পদ্ম, আর কবির মনে হয়, তিনি সেই পদ্মের মধু পান করে ধন্য হয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর খেলা ছিল বিশ্বরূপের ঘরে, আর সেই যিনি অপরূপ, তাঁকে তিনি দুই নয়ন মেলে দেখেছেন। কবি আরো বলেন, যাঁকে স্পর্শ করা যায় না, সেই তিনি কবির সকল দেহে ধরা দিয়েছেন। সেই যেন তাঁর চূড়ান্ত প্রাপ্তি, সমুচ্চ স্বীকৃতি। এইবার সব শেষ হোক। কবি কখনো সেই অচেনাকে কোন্ অজানা দেশের এক মেয়ে বলে ভাবেন। বছর দশেক বয়সে কবি নিজের জননীকে হারিয়েছেন। সেই হারিয়ে ফেলা মা যেন কেমন করে প্রবীণ কবির কাছে আসেন। কেমন মা? কবি যেন তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর হাতের স্পর্শ পান, সে এক মাঠ পারে কোন্ বটের তলার বাঁশির সুরের মা। মায়ের সাথে এক অজানা দ্বীপে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এক ভোরবেলাতে নৌকার পাল তুলে।
কখনো তাঁকে রমণী বলে মনে হয়। এক নীরব নিশীথে মহানিস্তব্ধের প্রান্তে কোথায় যেন তিনি রয়েছেন। কবি আশা করেন, তাঁর গানে সেই রহস্যময়ী রমণী তাঁর স্পর্শমণি ছুঁইয়ে দিন। সেই যে বাঁশির সুর, কবি ভাবেন, সে বাঁশি তাঁর নিজের মন। সেই বাঁশির সুরে মেঘে মেঘে বর্ণচ্ছটা লাগে, কুঞ্জে কুঞ্জে ফুটে ওঠে মাধবী মঞ্জরী, ঝর্ণা ওঠে কল্লোলিত হয়ে।
সমস্ত জীবন ধরে এইভাবে এক রহস্যময়ী তাঁকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান। পাওয়া না পাওয়ার দোলায় সারা জীবন দুলতে দুলতে নিজের মনুষ্যত্ব, নিজের পুরুষকারের উপর ভর করে অক্ষয় শান্তির অধিকার তিনি পেয়ে যান।
This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন