বসন্ত রোগ-প্রতিকারে বিজ্ঞান, নাকি ধর্মীয় নীতিতে প্রতিকার

মায়ের দয়া, না-কি বিজ্ঞানের অধ‍্যবসায়!

মায়ের দয়া, না-কি বিজ্ঞানের অধ‍্যবসায়!


 মৃদুল শ্রীমানী

লুই পাস্তুর ভয়াবহ জলাতঙ্ক রোগের টিকার প্রথম সার্থক প্রয়োগ করেন। ৬ জুলাই, ১৮৮৫ সালে তিনি জোসেফ মিইস্তার নামে একটি নয় বৎসরের বালককে জলাতঙ্কের টিকা দেন। তেরোখানি টিকা  নেবার পর সে ছেলে একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠলো। লুই পাস্তুর দেখিয়ে দিয়েছিলেন নানা রকম মারণরোগ ঘটায় ব্যাকটিরিয়া। আর সেগুলিকে বিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে চিনিয়ে দিতে তার ক্লান্তি ছিল না। আরো দেখিয়েছিলেন ব্যাকটিরিয়ার দৌরাত্ম্য  আটকানো যায়  বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে।

শাম্ব ছিলেন কৃষ্ণের পুত্র । শাম্ব নিজের পিতা কৃষ্ণকে গোপিনীদের সাথে রমণরত দেখে ফেলেছিলেন। তাইতে কৃষ্ণ ভীষণ রেগে পুত্রকে কুষ্ঠ আক্রান্ত হবার অভিশাপ দেন, এমন গল্পকথা ভারতীয় পুরাণকার লিখেছেন। কুষ্ঠ পরিচিত ছিল সাংঘাতিক রোগ হিসেবে। কাজেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনু মহাশয় বিধান দিয়েছিলেন যে কুষ্ঠ রোগ হলে রোগীকে সমাজ থেকে দূর করে দিও। ইংরেজ, যারা ভারতীয় কুসংস্কারগুলি দূর করতে পলিটিক্যালি ইচ্ছুক ছিলেন না, তারাও কুষ্ঠরোগীদের একঘরে করে রাখার সপক্ষে ফরমান জারি করেন। স্বাধীন ভারতেও এই ১৯৮৩ অবধি আইনটি চালু ছিল। স্বামীর কুষ্ঠ হলে স্ত্রী বিচ্ছেদ পেত সহজেই।

আশার কথা এই যে, ভারতের শীর্ষ বিচারালয় এই রোগ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিতে চাইছেন। কিন্তু কেন? কেন না, নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহারড হ্যানসেন  ১৮৭৩ সালে প্রমাণ করে দেন যে এই অসুখটি একটি ব্যাকটিরিয়ার অবদান। সেই ব্যাকটিরিয়ার নাম মাইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপরি । এই রোগের চিকিৎসা আছে আর চিকিৎসা সঠিক সময়ে শুরু হলে এই রোগ সেরেও যায়।

মুশকিলের কথা হল অপুষ্টি আর অভাবকে যক্ষ্মা বা আমাশয় বা ম্যালেরিয়া বা আরো পাঁচটা রোগের মতো কুষ্ঠরোগটাও ভারি পছন্দ করে। ভারতে যেহেতু সাধারণ মানুষের জীবন বড্ডো বেশিরকম লজ্জাজনকভাবে অবহেলিত, তাই বিশ্বের ৫৯% কুষ্ঠরোগী এই ২০১৫ সালেও ভারতের বাসিন্দা। ভারতের প্রশাসন এই নিয়ে গর্ববোধ করতে পারেন। এক ফরাসী মানবতাবাদী, রাউল ফোলেরো ১৯৫৪ থেকে জানুয়ারির শেষ রবিবারে বিশ্ব কুষ্ঠদিবস পালন শুরু করেন। ওই দিনটা আমাদের মহাত্মা গান্ধীর শহীদ দিবসের কাছাকাছি পড়ে বলে ভারতে মহাত্মাজীর মৃত্যুদিনকেও কুষ্ঠ প্রতিরোধ উপলক্ষে পালন করা হয়। যাই হোক, ভারতে যুক্তিচর্চা খুব শীর্ণ ও অবহেলিত হবার কারণে, এবং রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে কুসংস্কারের প্রশ্রয়দাতা হবার কারণে আজো কুষ্ঠরোগ নিয়ে আমাদের রাখঢাকের শেষ নেই। চিকিৎসা করার জন্য রাষ্ট্রীয় আরো উদ্যোগ দরকার বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের দাবি।

মশা নানা রোগের বাহক। কিউলেক্স মশা গোদ এর সমস্যা ঘটায়। এডিস ইজিপটাই উপহার দেয় এনসেফেলাইটিস রোগের। টাইফয়েডের জীবাণু জলের ঘাড়ে চেপে আমাদের শরীরে ঢোকে। কমা ব‍্যাসিলাস আর ভিবরিও কোলেরি ঘটায় কলেরার মতো অসুখ। পোলিও মায়েলাইটিস ব‍্যাকটিরিয়ার আক্রমণে পোলিও হয়। যক্ষ্মাও ঈশ্বরের অভিশাপ নয়। হাইনরিশ হারমান রবার্ট কখ্ ( ১১.১২.১৮৪৩ - ২৭.০৫. ১৯১০) নামে জার্মান  যক্ষ্মা, কলেরা আর অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণুকে চেনালেন। আমাশয় রোগে কখনো ভোগেন নি এমন বাঙালি বিরল। অ্যাণ্টামিবা হিস্টোলিটিকা নামে প্রোটোজোয়া আমাদের আমাশয় ঘটায়।  আন্তন ভ‍্যান লিউয়েন হক অণুবীক্ষণ যোগে অণুজীবের জগৎকে চিনেছিলেন। ব‍্যাকটিরিয়াকে পাকড়াও করেন। মাইক্রো বায়োলজি শাখার সূচনা করেন। তার সামান‍্য পূর্বে রবার্ট হুক কোশ আবিষ্কার করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটান।

 গবেষণাগারে অ্যান্টিবায়োটিক  তৈরি করেন ফ্লেমিং। কিন্তু রোগীকে বাঁচাতে প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণে পেনিসিলিনের সরবরাহ, আর সেই পেনিসিলিনের শুদ্ধতা হতে হবে খুব উঁচু মানের। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেও বিশুদ্ধ মানের পেনিসিলিন প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ছিল যুগের দাবি। সেই কাজটা করে দেখালেন অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ওয়ালটার ফ্লোরে আর স‍্যর আর্নস্ট চেইন।

বিশুদ্ধ পেনিসিলিন পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরিতে ওঁদের এই প্রচেষ্টার ফলে ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কার বাস্তবে কার্যকরী ভাবে প্রয়োগ করা গিয়েছিল। সেই জনকল্যাণমূলক অবদানের স্বীকৃতিতে ১৯৪৫ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর সাথেই হাওয়ার্ড ওয়াল্টার ফ্লোরে ও স‍্যর আর্নস্ট চেনকে নোবেল সম্মানে ভূষিত করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮ তারিখে ছিল ওয়াল্টার ফ্লোরে জন্মেছিলেন।

ডাচ বিজ্ঞানী আন্তন ভ‍্যান লিউয়েন হক ( ২৪.১০. ১৬৩২ - ২৬.০৮.১৭২৩) অণুবীক্ষণকে আরো উন্নতমানের একটি সরঞ্জাম হিসেবে গড়ে তোলেন। ১৬৮৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি ব‍্যাকটিরিয়ার ধারণা দেন। মাইক্রো বায়োলজি বা অণুজীববিদ‍্যা বিষয়টি তিনি বিকশিত করেন।

শরীরের ভিতর রক্ত চলাচল করার পদ্ধতি ও হৃৎপিণ্ডের ভূমিকা বৈজ্ঞানিক মনন নিয়ে লক্ষ্য করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে ( ০১.০৫. ১৫৭৮ - ০৩.০৬.১৬৫৭) । ১৬২৮ সালে "একসারসিটাটিও দে মতু করডিস এট স‍্যাংগুইনিস ইন অ্যানিম‍্যালিবাস" নামে বই লিখে তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণলব্ধ চিন্তাভাবনা  প্রকাশ করেন। অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানসাধক কার্ল ল‍্যাণ্ডস্টেইনার ( ১৪.০৬. ১৮৬৮ - ২৬.০৬.১৯৪৩) ১৯০০ সাল নাগাদ রক্তের প্রধান ও প্রাথমিক গ্রুপগুলি আবিষ্কার করেন। তাঁর গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয় যে রক্ত সঞ্চালন করার পূর্বে রোগীর রক্তের গ্রুপ নির্দিষ্ট ভাবে জেনে ঠিক সেই গ্রুপের রক্ত দিলে জীবনহানির সম্ভাবনা কমানো যায়। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী ১৯০৭ সালে নিউইয়র্কে মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে রুবেন ওটেনবার্গ রোগীর শরীরে রক্ত সঞ্চালন করেন।  বিশ্ব ইতিহাসে সেই প্রথম সফলতার সঙ্গে রক্ত সঞ্চালন।

১৯৩৭ সালে তিনি আলেকজান্ডার এস উইনার এর সাথে মিলে রীসাস ফ‍্যাকটর আবিষ্কার করেন। কার্ল ল‍্যাণ্ডস্টেইনার আবার পোলিও মায়েলাইটিস রোগের ভাইরাস আবিষ্কার করেন। এই কাজে তাঁর সাথে ছিলেন কনস্ট‍্যানটিন লেভাডিটি ( ০১.০৮.১৮৭৪ - ০৫.০৯. ১৯৫৩) এবং আরউইন পপার ( ০৯.১২.১৮৭৯ - ২৮.০৯.১৯৫৫)।

লেভাডিটি আবার সিফিলিস নামে সাংঘাতিক রোগের জীবাণুর আবিষ্কার করেন। সিস্টার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ( ১২.০৫. ১৮২০ - ১৩.০৮. ১৯১০) ছিলেন সেবিকা অর্থাৎ নার্স। কিন্তু ওই পরিচয়ে নাইটিঙ্গেল সীমাবদ্ধ নন। অভিজাত এই মহিলা ছিলেন গণিতবিদ। রাশিবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর প্রগাঢ় অধিকার ছিল। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহত সৈনিকদের তিনি সেবা শুশ্রূষা করতেন। কিন্তু তাতেই তাঁর উৎসাহ সীমিত ছিল না। তিনি  রাশিবিজ্ঞান সম্মত পথে  দেখিয়ে দিয়েছেন অস্ত্রের আঘাতে যত সৈন‍্য মরে, কাটা ঘায়ে সংক্রমণ হয়ে তার অনেক বেশি সংখ্যক সৈন‍্যের প্রাণহানি হয়। তৎপরতার সঙ্গে উপযুক্ত সেবা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও ড্রেসিং নিশ্চিত করলে এই অকারণ প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব। তিনি গাণিতিক তথ‍্য দিয়ে নার্সিং বিষয়টিকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। তাঁর জন্মদিন আজ আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবস বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়।

ভারতে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞান সাধকদের কঠিন অধ‍্যবসায়ে যুক্তিসিদ্ধ পথে বারংবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবেই চিকিৎসা বিজ্ঞান এগিয়েছে। কোনো দেব দেবীর দয়ায়  বা অতীন্দ্রিয় প্রক্রিয়ায় এ কাজ হয় নি। আজও মানুষের রোগব্যাধির উপশম ঘটাতে গেলে বিজ্ঞানসম্মত পথেই এগোতে হবে। করোনার প্রতিরোধ করতে বিজ্ঞানকে আশ্রয় করেই এগোতে হবে। যতদিন না প্রতিষেধক বের হয়, স্বাস্থ্য বিধিসম্মত পথে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। হতাশায় ভুগলে হবে না। কুসংস্কারের পায়ে মাথা কুটলেও হবে না।   বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ,  পরীক্ষা নিরীক্ষা ও যুক্তিবিচারের প্রতিষ্ঠিত পথেই সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.