যৌথ পরিবারের সাবেকিয়ানা বনাম থিম পুজো : সমাপ্তি চৌধুরী

যৌথ পরিবারের সাবেকিয়ানা পুজো
যৌথ পরিবারের সাবেকিয়ানা 

বনাম থিম পুজো

সমাপ্তি চৌধুরী

আশ্বিনের সকাল। বাংলা হিসেবে শরৎকাল । পেজা তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ আকাশ জুড়ে। দিকে দিকে কাশবনের মেলা। মনমাতানো শিউলির সৌরভ। সকালের হিমশীতল বাতাসে হাড়  কেঁপে ওঠে মাঝে মাঝে। এই সময়ে গাছে গাছে লাগে রঙের মেলা। ধীরে ধীরে গাঢ় সবুজ পাতারা হরেকরকম রঙে যেন নিজেদের সাজিয়ে তোলে।প্রকৃতির এই সাজ মুগ্ধ করে বৃদ্ধ হিরণ্ময় বাবুকে। শরতের সকালবেলায় সোনাগলানো রৌদ্রের মধ্যে বসে বসে ভাবতে থাকেন পুরনো দিনের কথা। একসময় কত লোকজন ছিল বাড়িটাতে। সবসময় যেন গমগম করতো। ধীরে ধীরে ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে চারিদিকে। একা বটবৃক্ষের মতো রয়ে গেছেন তিনি।

এই সোনাপুর গ্রামের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গা  পুজোর জাঁকজমক একসময় মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতো। সারা গ্রামের মধ্যে এই বাড়ির পুজোই ছিল নামকরা। সারাবছর সবাই মুখিয়ে থাকত এই পুজোর কটা দিনের জন্য। চারদিন ধরে গ্রামে এমন কেউ থাকত না যার পাত পড়ত না এই রায়চৌধুরী বাড়িতে।  সন্ধ্যাবেলা পুজোমণ্ডপে আলোর রোশনাই, আর তার সাথে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেসব এখন গল্পকথা।  তবে পুজোর কটা দিন এখনও রায়চৌধুরী বাড়ি ভরে ওঠে। বর্তমানে কাজের সূত্রে সবাই চারিদিকে ছিটকে থাকলেও, পুজোর কটা দিন সবাই গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে। একসাথে  মায়ের আরাধনায় মেতে ওঠে।  অসহায়, একাকী,নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ মানুষটি সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন পুজোর কটা দিনের জন্য। ছেলে-বৌমা, মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি দের কোলাহল যেন ভুলিয়ে দেয় সারাবছরের শব্দহীনতাকে।

চারদিকে পুজোর আয়োজনের হাঁকডাক  জানান দেয় শরৎ এসেছে, আর সাথে সাথে এও জানান দেয় যে পুরনো রায়চৌধুরী ভিলা আবার নবরূপে সেজে উঠবে। মাসখানেক ধরে বাড়িতে চলে নানা মানুষের আনাগোনা। সবজিওয়ালা, চালের আড়ৎদার,মাছের আড়ৎদার সবাই একে একে বায়না নিয়ে যায়। আগে তো বাড়িতে ভিয়েন বসত। কত ধরনের নাড়ু মুরকি তৈরি করা হতো। আগে যখন বুড়ো কর্তার মা বেঁচেছিলেন তখন তিনি সব পিতলের গামলায় করে ঠাকুরের জন্য আলাদা করে তুলে রাখতেন। পরবর্তীতে রায়বাবুর স্ত্রী অর্থাৎ যোগমায়া দেবী সবকিছু সামলাতেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আগের অনেক কিছুই বদলে গেছে। এখন পুজোর যাবতীয় সবকিছু কিনে আনা হয়। তবে এখনও বছরের এই একটা সময় বাড়িতে উৎসবের আয়োজন হয়। রাঁধুনি ঠাকুর, ঝি, চাকর সবাই মিলে নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়ে।বৃদ্ধ হিরণ্ময় বাবুও এইসময় খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। একা হাতে সবকিছু তদারকি করেন। দেখতে দেখতে এসে যায় সেই শুভক্ষণ। একে একে সবাই এসে জড়ো হতে থাকে। বর্তমানে ছেলে মেয়েদের থেকেও নাতি নাতনি দের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি ভালোবাসেন হিরণ্ময় বাবু। তাদেরকে পুরনো দিনের সব গল্প শোনান। এরা নবীন প্রজন্ম, জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠা সবই শহরে। তবে দাদুর মুখে পুরনো  দিনের গল্প শুনতে তারাও খুব ভালোবাসে।

বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই নাতি নাতনিরা  হৈ হৈ করে দুর্গামন্দিরে যায়। পুরনো দিনের মন্দিরটিকে নতুনভাবে সংস্কার করে তাতে আনা হয়েছে নতুনত্বের ছোঁয়া। মন্দিরের সাথে লাগোয়া ঘাট বাঁধানো পুকুরটি খুব পছন্দের জায়গা ওদের। সেখানে হাঁসেদের চড়ে বেড়ানো দেখতে খুব ভালোবাসে ওই শহুরে ছেলে মেয়েগুলো। মন্দিরে তারা সাবেকি দুর্গা প্রতিমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এ বাড়ির  প্রতিমার আদলটি একদম অন্যরকম। সেই বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকে চলে আসছে একই ছাঁচে গড়া প্রতিমা। এই মূর্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দাদুর সাথে গল্পের ছলে চলে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা।

রায়চৌধুরী বাড়ির নবপ্রজন্ম চিরঞ্জীব রায়চৌধুরী কথায় কথায় দাদুকে প্রশ্ন করে---" দাদু, দুর্গাপুজোকে অকালবোধন বলা হয় কেন ?" দাদু সহজভাবে বোঝাতে থাকেন--- পুরাণ মতে রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাদের পূজার যথাযথ সময় নয়। অকালের পুজো বলে এই পুজোর নাম হয় 'অকালবোধন '।পুরাণ মতে রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রম্ভা দুর্গার  বোধন ও পুজো করেছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পুজো করেছিলেন। তবে প্রচলিত মত অনুযায়ী ভগবান ব্রম্ভা শরৎকালের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে রামকে মা দুর্গার উপাসনা করার কথা বলেন। শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজোর উপযুক্ত সময় বসন্তকাল। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে সূর্যবংশীয় রাজা সুরথ বসন্তকালে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তাই এই পুজো বাসন্তীপুজো নামে পরিচিত। 


যৌথ পরিবারের সাবেকিয়ানা পুজো
এই পর্যন্ত শোনার পর নাতনি চিত্তরূপা বলে ওঠে---"দাদু, এই বাড়ির পুজো সম্পর্কে আমাদের গল্প শোনাও। " বৃদ্ধ হিরণ্ময় বাবুর চোখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বলতে থাকেন----" সে অনেক ইতিহাস রে দিদিভাই। আমারও জন্মের বহু আগে থেকেই এই বাড়ির পুজো চলে আসছে। ছোটবেলায় আমরা সব ভাইবোনেরা মুখিয়ে থাকতাম রথের দিনের জন্য। ওইদিন আমাদের পূর্বপুরুষদের ঠিক করা মিস্ত্রিরা এসে মায়ের কাঠামোয় এক মৃত্তিকা দিয়ে যেত। তার মাসখানেক পর দুই মৃত্তিকা। কী সুন্দর সব ছাঁচে গড়া মূর্তিগুলো। একে একে মা দুর্গা ও তার ছেলে মেয়েরা মূর্ত হয়ে উঠত ওই মিস্ত্রিদের হাতের স্পর্শে। তার কিছুদিন পর ঠাকুরের গায়ে চুন লাগানো হতো, যাতে পরবর্তীতে রংগুলো ফুটে ওঠে। এরপর আসত সেই দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যার দিনটি, যার নাম মহালয়া,এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে  তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা।এই দিন হিন্দু দেবী লক্ষীর পুজো করা হয়। " সঙ্গে  সঙ্গে আরও দুই নাতনি ঐশানি ও ভার্গভী বলে ওঠে ,"দাদু দেবীপক্ষ কী?" ----- সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ  থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে 'দুর্গাষষ্ঠী ', 'মহাসপ্তমী' ,'মহাষ্টমী', 'মহানবমী' ও 'বিজয়াদশমী' নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষটিকে বলা হয় "দেবীপক্ষ "।----- এই পর্যন্ত বলে বৃদ্ধ হিরণ্ময় বাবু যেন দম ছাড়লেন। 

গল্প করতে করতে পুরনো দিনের সব স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে আসছে। সেই ছেলেবেলার পুজোর দিনগুলো কত হাসি মজাতে কেটেছে। তারপর আস্তে আস্তে প্রাকৃতিক নিয়মেই সবাই বড় হয়ে উঠেছেন। দিদি ও বোনেদের বিয়ের পর খুব মন কেমন করত। কিন্তু প্রত্যেক বছর পুজোর সময় সবাই একজায়গায় জড়ো হতেন। কর্মসূত্রে দুই দাদা বাইরে থাকতেন। তারাও পুজোর সময় বাড়ি আসতেন। পুজোর কটা দিন সবাই সবকিছু ভুলে আনন্দে মেতে থাকতেন। তারপর সময়ের সাথে সাথে একে একে নিয়তির বলি হয়েছেন সবাই। শরীরের বার্ধক্য আর জরাগ্রস্ত মন নিয়ে পড়ে রয়েছেন শুধু তিনিই। 

" ও দাদুভাই, কী এত ভাবছ? তারপর কী হতো বলো?"------- নাতি-নাতনিদের প্রশ্নবাণে সম্বিত ফিরে পান হিরণ্ময় বাবু। বলতে থাকেন মহালয়ার দিন কী উত্তেজনায় কাটত তাদের ছেলেবেলা।ওইদিন মিস্ত্রিরা ঠাকুর প্রতিমার গায়ে রং দিতে আসতেন। আর বাড়ির সব ছোটরা এক একটা পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত একটু উদ্বৃত্ত রং পাবার আশায়। সেই রং নিয়ে তারা বাড়িতে নিজেদের মতো করে আলপনা আঁকতেন। ওই মিস্ত্রিদের মধ্যে একজন বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন, যাকে বাড়ির খুদেরা গনেশ দাদু বলে  ডাকত। তিনি কী সুন্দর পটচিত্র আঁকতেন। বাড়ির বড় থেকে ছোট সবাই মুগ্ধ হয়ে বসে তাঁর আঁকা দেখতেন। তাঁর পটচিত্রের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছিলো। তিনি অনেকবার এই কাজের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। বংশানুক্রমে তাঁর নাতিরা এখন এই কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা কেউ গনেশ দাদুর মতো সুনাম অর্জন করতে পারেন নি। 



লেখিকা : সমাপ্তি চৌধুরী

হিরণ্ময় বাবু ভাবেন কর্মক্ষমতা হারালে সবাই সংসারে ব্রাত্য হয়ে যায়। শেষ জীবনে  গনেশ দাদু খুব কষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কোথাও যেন নিজের জীবনেরই  প্রতিচ্ছবি দেখেন। তিনিও তো আজ এই সংসারে ব্রাত্য, অপাংক্তেয় হয়ে এক কোনায় পড়ে আছেন। বাড়ির কোনো বিষয়ে তাঁর মতামত নেওয়ার কেউ প্রয়োজন-ই বোধ করে না। অথচ একসময় কী প্রতাপ ছিল তাঁর। ছেলে-মেয়েদের কাছে এখন দু-দণ্ড সময়ই নেই এই বুড়োর সঙ্গে বসে কথা বলবার মতো। তবে নাতি-নাতনিগুলো দাদুর খুব ন্যাওটা। ওদের মুখ তাকিয়েই এখনও বোধহয় ভিটে আগলিয়ে বসে থাকেন  বৃদ্ধ হিরণ্ময় বাবু।

পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবার গুলোতেই আয়োজিত হয়। পুরনো ধনী পরিবার গুলোর দুর্গাপুজো "বনেদি বাড়ির পুজো " নামে পরিচিত। পারিবারিক দুর্গাপুজোগুলোতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়। ঠিক তেমনই এই বনেদি রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো। ষষ্ঠীর সন্ধ্যা বেলায় ষষ্ঠীকল্পনার মধ্য দিয়ে মায়ের চক্ষুদান করা হয়। এই বাড়ির রীতি অনুযায়ী বাড়ির বড় বউ সারাদিন উপোস করে এই ষষ্ঠীকল্পনার সময় ব্রাহ্মণকে বস্ত্র দান করেন। শাস্ত্রমতে মহাষষ্ঠীর এই দিনটিতেই মা দুর্গার তাঁর সন্তানদের নিয়ে মর্ত্যে আগমন ঘটে। মহাসপ্তমীতে কলাবউ স্নানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় পুজোর। সকাল বেলায় নির্দিষ্ট তিথিতে বাড়ির ছেলেরা দোলা কাঁধে নিয়ে পারিবারিক পুকুর থেকে,ঢাকের বাদ্যি সহকারে কলাবউকে স্নান করিয়ে আনে। ঐ দিন সকাল থেকেই দুর্গামন্দিরে ব্যস্ততা লক্ষণীয়। বাড়ির মেয়ে বউরা সকাল থেকেই স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরে পুজোর বিভিন্ন কাজকর্মে লেগে যায়। কেউ ফল কাটছে, কেউ ঠাকুরের মালা গাঁথছে, কেউ বা ফুল সাজাচ্ছে------ আর তার সাথে চলে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি। পুজোর কটা দিন বাড়ির ছোট থেকে  বড় প্রত্যেকেই পুজো শেষে ঠাকুরের চরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করে। 

এরপর মহাষ্টমীতে হয় মহাষ্টমীকল্পারম্ভের পুজো। ঐদিন বিশেষ কিছু আচার পালন করা হয়। অষ্টমী শেষে নবমী তিথি শুরু হওয়ার সময় সন্ধিপুজো হয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে অষ্টমী তিথি শেষ হয়ে যাওয়ার শেষ  ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথি শুরু হওয়ার প্রথম ২৪ মিনিটকে বলে সন্ধিক্ষণ। এই সময়েই দেবী ত্রিনয়ন উন্মীলিত করে চামুণ্ডা রূপে চণ্ড ও মুণ্ড নামে ভয়ঙ্কর অসুরদের নিধন করেছিলেন। দেবীর এই চামুণ্ডা রূপেরই আরাধনা করা হয় সন্ধিপুজোর মাধ্যমে। বিভিন্ন আচার-নিয়ম মেনে সন্ধিপুজো করা হয়। সন্ধিপুজোয় ১০৮ টি  পদ্ম দেওয়া হয় এবং ১০৮ টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। নৈবেদ্যয় দেওয়া হয় গোটা ফল, জবা ফুল, সাদা চাল, শাড়ি, গহনা  এবং সাজ। এইসময় সমস্বরে অনেক ঢাক বাজানো হয়।

অষ্টমীর সারাদিন উপোস ও খাটাখাটনির পর যখন সবাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, সেইসময় বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য অর্জুন রায়চৌধুরী, দাদুর কাছে জানতে চাইলে-----"দাদু, মহিষাসুর কে কখন বধ করা হবে?"----- হিরণ্ময় বাবু নাতিকে গল্পের ছলে বলে চলেন----- "পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নেয়। তখন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রম্ভা, এবং তারপর শিব ও নারায়ণের সামনে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচারের কাহিনী শুনে তাঁরা অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমণ্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হলো। সেই সঙ্গে ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই মহাতেজ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। এক এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল। প্রত্যেক দেবতা তাদের অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তার বাহন সিংহ দান করলেন। এই দেবীই দশভুজা দুর্গা রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। দেবী ও তার বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কেঁপে উঠল। প্রথমে মহিষাসুর তার সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তার বাহন সিংহ একে একে সকল যোদ্ধা ও অসুরসেনাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রজালিক মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।কিন্তু দেবী তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে, মহিষাসুরের উপর চড়ে  তার কন্ঠে পা দিয়ে ত্রিশূল দিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করে তাকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে পালিয়ে গেল এবং দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন।,,,,,,বুঝেছ দাদুভাই?"------ গল্পের ছলে পুরো কাহিনি শুনে সবাই মজা পেল। 

প্রতিষ্ঠান কর্তৃক থিম পুজো

অষ্টমী শেষে আসে নবমী তিথি । নবমীতে মহানবমী বিহিত পুজো হয়। এই দিন বড় করে মায়ের হোম হয়। হোমশেষে প্রত্যেককে হোমের ফোঁটা লাগিয়ে শান্তিজল প্রদান করা হয়। নবমীতে আখবলির রেওয়াজ আছে এই বাড়িতে। এ  বাড়ির পুজোয় কোনো প্রাণী বলি হয় না। প্রত্যেকদিন চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। নবমীর দিন তার সাথে সাথে আখবলি হয়। আর তার পরেই বাড়ির খুদেদের মধ্যে সেই আখ নিয়ে কাড়াকাড়ি। এইভাবেই বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান মেনেই আজও এই বাড়ির পুজো চলে আসছে। পুজোর কটা দিন হিরণ্ময় বাবু মনে অন্যরকম জোর পান। সারাদিনই প্রায় পূজামণ্ডপে বসে থাকেন আর পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে থাকেন। এরপর এসে যায় বিজয়াদশমী। ওইদিন বিসর্জনের পুজো দিয়ে  দশমীর পালা শেষ হয়। পুরনো রীতি অনুযায়ী ওইদিন সবাই  কম-বেশি সিদ্ধি পান করে। বিকেলে দোলায়  করে কলাবউ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পুজোর পরিসমাপ্তি ঘটে। ওইদিন মা- দুর্গার মতো বাড়ির প্রত্যেক সদস্যদেরও মন ভারাক্রান্ত থাকে। বিকেলে বড় দের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ ও  মিষ্টিমুখের মধ্যে দিয়ে পুজোর পরিসমাপ্তি ঘটে।

সন্ধ্যাবেলায় দাদুর আশীর্বাদ নিতে নিতে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দাদুর একপ্রস্থ তর্ক-বিতর্কও চলে। রায়চৌধুরী বাড়ির নবপ্রজন্ম দের মনে হয়েছে-- এই পুজো একঘেয়ে। বছরের পর বছর ধরে তারা এই একই মূর্তি দেখে আসছে। সবকিছু একইরকম ভাবে চলে আসছে। কোথাও কোনো নতুনত্বের স্বাদ নেই। তাদের মতে বর্তমানে থিম পুজোর যুগ। শহরের সব সার্বজনীন পুজোয় 'থিম ' বা নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক মণ্ডপ , প্রতিমা ও আলোকসজ্জা দেখা যায়। থিমগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে 'শারদ সম্মান ' নামে বিশেষ পুরস্কারও  দেওয়া হয়। রায়চৌধুরী বাড়ির প্রাচীনপন্থী আর নবীনপন্থীদের এই তর্ক চলতেই থাকে, যেমন থিম নাকি সাবেকি---- সেই তর্ক বহুদিনের। দিন যত এগিয়েছে ততই পাল্টেছে শহর থেকে শহরতলীর পুজো সংস্কৃতি। পুজোর পরম্পরা এক থাকলেও, আড়ম্বরে যোগ হয়েছে নানা স্বাদের নানা বিষয়। বর্তমানে প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে সাবেকি প্রতিমার জায়গায় এসেছে থিমের প্রতিমা,  প্যাণ্ডেলের সাজে এসেছে থিমের সাজ। বদলে গিয়েছে দুর্গাপুজোর ঘরানা।

তবে পুরনো বনেদি বাড়িগুলো এখনো ধরে রেখেছে তাদের সাবেকিয়ানা। হিরণ্ময় বাবু যেমন বলেন------ " মায়ের ওই চোখের দিকে তাকালে মনে সাহস পাই। শরীরে শক্তি পাই, ভক্তিরসের সাগরে আপ্লুত হয়ে যাই।" এ এক অন্য অনুভূতি। বাইরের জাঁকজমক নয়, অন্তরের আকুতিই এখানে সর্বস্ব। তবে মায়ের আরাধনা যেরূপে বা যেভাবেই হোক না কেন, যাবতীয়  অশুভ শক্তি নিধনে মর্তে আসেন সর্ব শক্তিমান দেবী দুর্গা। সেইটেই চরম সত্য।

আনন্দের মুহূর্তগুলো যেন বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় বলে মনে হয় হিরণ্ময় বাবুর। এসে যায় বিদায়ের ক্ষণ। ছলছল নেত্রে একে অপরকে বিদায় জানায়। গমগমে রায়চৌধুরী ভিলা আবার একাকী হয়ে যায়। ছেলে-মেয়েরা বাড়ির কাজের লোকেদের বকশিশ দিয়ে, আর বাবার খেয়াল রাখার কথা বলে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলে যায়। খাঁ খাঁ করা হৃদয় আর একবুক অভিমান নিয়ে আবার বছরভর প্রতীক্ষা। এ প্রতীক্ষার শেষ কবে,,,,,,ভাবতে ভাবতে তাঁরই মতো একাকী , অবহেলায় পড়ে থাকা বাড়ির পুরনো সেগুন কাঠের চেয়ারটায় বসে বসে স্মৃতির সাগরে ডুবে যান।

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

1 Comments:

Unknown বলেছেন...

খুব ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে।