![]() |
সঞ্চারী ভট্টাচার্য্য |
ঘটনাটি দু চার বছর প্রাক্তন নয় প্রায় দু হাজার বছরেরও অধিক পুরাতন| ইউরোপে গ্রীস বাসী তখনও সভ্যতার মুখ দেখেনি, আরও অনেক দেশই ছিল অন্ধকারে| সভ্যতা সৃষ্টির পূর্বের এক ঐতিহাসিক গাঁথা এটি | ভারতবর্ষের করাচি শহর থেকে পাঞ্জাবের দিকে যেতে প্রায় 200 মাইল উত্তরে মহেঞ্জোদাড়ো বলে একটি নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করলেন এক বিখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়| বৌদ্ধ যুগের কোন এক নিদর্শন আবিষ্কার করতে গিয়েই আবিষ্কৃত হয়েছিল ভারতের ইতিহাসের এক বিস্মৃত যুগ |
প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে বেড়ান অতীতের ইতিহাস| শত শত বছর আগেকার এক সভ্যতার নিদর্শন পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন| সেই সময় ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের প্রধান ছিলেন স্যার জন মার্শাল| নানা জিনিস নিয়ে গবেষণা করার পর তিনি বলেছিলেন যে, " মহেঞ্জোদাড়োতে বেদের সভ্যতার চেয়েও উন্নত এক সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল| তিনি আরো বলেন যে বেদের আর্যরা যেখানে বসবাস করত সেখানে তাদেরও আগে তাম্র যুগের অন্য প্রজাতির লোকেরা থাকতো| তার মতে সে সভ্যতা ছিল খ্রীষ্টের প্রায় চার হাজার বছর আগের|"
স্যার জন মার্শাল এর মতো অনেক বিদেশি ঐতিহাসিকই বলতে চান যে ভারতে বেদের যে সভ্যতার কথা পাওয়া যায় তা বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছিল| মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা কে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সভ্যতা বলে দাবি করেছেন তিনি | আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে বসতি স্থাপনের আগে এখানে যারা এসে বসবাস গড়ে তুলেছিল তাদের বলা হয় আদি অধিবাসী| সেই আদি অধিবাসীদের মধ্যে সম্ভবত প্রাচীনতম ছিল নিগ্রো (Negrito) জাতির কোন একটি ধারা| যাদের বলা হতো 'নিগ্রোবটু'| অনুমান করা হয় এরা অন্ধকারের দেশ আফ্রিকা থেকে এসেছিল| নৃতত্ত্বের বিচারে নিগ্রোবটু আদিবাসী গোষ্ঠীর পর ভারতে আসে অস্ট্রিক বা নিষাদ জাতির একটি শাখা| কথিত আছে যে এরা সুদূর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে এসেছিল|
আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিষাদ গোষ্ঠীর পরেই ভারতে সম্ভবত এসেছিল দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী| অনুমান করা হয় এদের আদি বাসস্থান ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল(Mediterranean Regian). এখান থেকে তাদের একটি শাখা প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল| পরে আর্যরা যখন ভারতে প্রবিষ্ট হয়ে সপ্তসিন্ধু নদীর অববাহিকা বা সপ্তসিন্ধু অঞ্চল এ তাদের বসতি বিস্তার করে, তখন তাদের সঙ্গে দ্রাবিড়দের প্রবল সংগ্রাম হয়| দ্রাবিড়রা পরাভূত হলে আর্যরা তাদের উত্তর ভারত থেকে বিতাড়িত করে| বর্তমানের ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগে যে সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল তার প্রধান স্থপতিকার হলেন এই দ্রাবিড় জাতি|বর্তমান দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেগু, তামিলনাড়ুতে তামিল, কর্নাটকে কন্নড়, কেরালার মালায়ালাম, দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠীর জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত| এসব দেখে ঐতিহাসিক জন মার্শাল মন্তব্য করেছিলেন, "Mohenjodaro and Harappa represented the oldest of all civilisations known".
সিন্ধুনদের তীরে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদাড়ো নগরী আর সিন্ধুর উপনদী রাভীর তীরে বিকাশ ঘটেছিল হরপ্পা নগরীর। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় অসাধারণ স্থাপত্যকলার নিদর্শন পাওয়া গেলেও তা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রাসাদ ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় রীতিমতো আধুনিক নগর গড়ে উঠেছিল। ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের সড়ক ছিল, জল সরবরাহের জন্য কূপসহ নানা ব্যবস্থা ছিল, পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ড্রেন ছিল, স্নানাগার ছিল, রাস্তায় ড্রেন ও সড়ক বাতি ছিল, নগরীতে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল। এই দুই নগরীতে প্রায় ২৫০০টি সীল পাওয়া যায় যার বেশিরভাগে বিভিন্ন চিহ্ন, ষাঁড়, মহিষ প্রভৃতি পশুর প্রতিকৃতি ছিল।
পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, বিভিন্ন কারণে কোন এক অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিপুষ্ট হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে গৌরবের চূঁড়ায় উঠে অতঃপর কোন-না-কোন সংকটে পতিত হয়ে আত্মরক্ষার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে একসময় কালের আয়না থেকে হারিয়ে গিয়ে প্রত্নতত্ত্ব আর ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়। হয়তো বা সিন্ধু-সভ্যতার পতনও ঘটেছে এই অবধারিত নিয়মে। কিন্তু প্রয়োজনীয় লিখিত উপাদান ও ঐতিহাসিক দলিলের অভাব থাকায় সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
কারো কারো মতে ভূ-পৃষ্ঠ ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় সিন্ধু অঞ্চলের মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছিলো। সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের অনেকাংশে মরুভূমির প্রভাব পড়ায় ধীরে ধীরে মাটি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর ফলে এ সভ্যতা আর আগের মতো শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। মর্টিমার হুইলারের মতে, সভ্যতার শুরুতে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও বনাঞ্চলের যে চিত্র ছিলো তা শেষ দিকে ছিলো প্রায় অনুপস্থিত। এতে কৃষি-ব্যবস্থার পাশাপাশি বন্দর হিসেবে মহেঞ্জোদাড়ো নগরীর গুরুত্ব হ্রাস পায়। ড. হুইলার মনে করেন সিন্ধু সভ্যতার পতনের বেশ আগে থেকেই এর পতনের আভাস পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালের মহেঞ্জোদাড়ো নগরীকে তিনি পূর্বের মহেঞ্জোদাড়োর ‘ছায়ামাত্র’ বলে অভিহিত করেন।
তাঁর এই মতের উপর নির্ভর করে কেউ কেউ মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দের মধ্যেই এ সভ্যতার অবক্ষয় শুরু হয়। তার প্রভাবে সিন্ধু-সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও পৌর-ব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙে পড়ে। মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা ও অন্যান্য নগরের জনসংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃহৎ অট্টালিকার বদলে পুরনো ইঁটের বাড়ি তৈরি হয়। এমনকি ঘর-বাড়িগুলি রাজপথের উপরে এসে পড়ে এবং একটি বিশৃঙ্খল শহরে পরিণত হয়। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতার পতনে এ যুক্তিটি খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়নি।
কেউ কেউ মনে করেন সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে ভূমিকা রেখেছে সিন্ধু নদের ক্রমাগত বন্যা। তাঁদের মতে প্রাকৃতিক কারণে সিন্ধু নদীর জল অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। ফলে ক্রমাগত বন্যার আঘাত আছড়ে পড়তো এ সভ্যতায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত যে ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় শহর দুটো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহেঞ্জোদাড়ো নগরীতে বেশ কয়েকবার বন্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে তিন স্তরে ভয়াবহ বন্যার প্রমাণ রয়েছে। লোথাল ও চানহুদারো শহরও দু’বার বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে কালিবঙ্গান শহরে বন্যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও শহরটিতে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিলো। তাই বন্যা সভ্যতার ধ্বংস করেছে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ বন্যা প্রতিরোধ করার অভিজ্ঞতা নিয়েই প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা তাদের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলো। এক্ষেত্রে কেউ কেউ বন্যার পাশাপাশি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পকে এ সভ্যতা ধ্বংসের কারণ মনে করেন। যদিও ভূমিকম্প হওয়ায় এ সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিলো এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা যেভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণী ধ্বংস করেছে একইভাবে তা উৎপাদনে মনোযোগ দেয়নি। ফলে এককালে প্রচণ্ড খাদ্য-সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এসবই দুর্বল যুক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়।
তবে উপরের কারণগুলির কোন একটি বা একাধিকের সমন্বয়ে এ সভ্যতা যদি ধ্বংস হয়ে থাকে তবে তা ঘটেছিলো একেবারে সভ্যতার চূড়ান্তে এসে। তাৎক্ষণিকভাবে এ কারণগুলি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করার যুক্তি নেই। অর্থাৎ পণ্ডিতদের মতে দীর্ঘদিন ধরে সিন্ধু সভ্যতার পতনের সূত্রপাত হিসেবে সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে সূক্ষভাবে অবক্ষয় চলে আসছিলো। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর উপরের স্তর পরীক্ষা করে দেখা গেছে নগর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে একটি ভগ্নদশা চলছিলো। মহেঞ্জোদাড়োর আয়তনও ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসতে থাকে। আগের মতো সুপরিকল্পিত নগর শেষ দিকে দেখা যায়নি। শেষ দিকের মৃৎপাত্র তৈরিতেও অদক্ষতার ছাপ দেখা যায়। ক্রমে জনসংখ্যার চাপ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবং কৃষিক্ষেত্রে তেমন কোন উন্নয়ন না হওয়ায় জীবন নির্বাহে সংকট বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিদেশের সঙ্গে সিন্ধু-সভ্যতার যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো শেষ দিকে তাতেও ভাঙন ধরে। এবং এই সংকট-সঙ্কুল অবস্থাতেই বহিঃআক্রমণের মোকাবেলা করতে হয় সিন্ধুবাসীদের।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ বহিরাগতদের দ্বারা সিন্ধু-সভ্যতা ধ্বংসের কারণকে সমর্থন করেন। প্রত্নতত্ত্ববিদ মর্টিমার হুইলার সিদ্ধান্ত করেছেন যে, উত্তরদিক থেকে আগমনকারী আর্যদের আঘাতেই ধ্বংস হয়েছিলো সিন্ধু-সভ্যতা। তাঁর এই বক্তব্যের প্রধান ভিত্তি সিন্ধু অঞ্চলে পাওয়া কিছু প্রত্ননিদর্শন ও বৈদিক সাহিত্যের বক্তব্য। উৎখননের পর দেখা গেছে আক্রমণকারীদের হাত থেকে সম্পদ রক্ষা করার জন্য সিন্ধুবাসীরা সম্ভবত অলঙ্কার ও মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলো। আবার কোথাও পাওয়া গেছে একসঙ্গে অনেক নরকঙ্কাল। মহেঞ্জোদাড়োর রাস্তা, সিঁড়ি ও বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কঙ্কাল পাওয়া গেছে যেগুলির কোন কোনটির মাথার খুলিতে ভারি অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে কঙ্কালগুলিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিশেষ করে আর্য, অনার্য ও অন্যান্য জাতির লোকের কঙ্কাল প্রাপ্তি থেকে অনেকে মনে করেন সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের একাধিক বহিরাগত শত্রুর মোকাবেলা করতে হয়েছে। বেলুচিস্তান ও ইরানের কয়েকটি উপজাতীয় লোকের সঙ্গে এসব অস্থি ও কঙ্কালের মিল পাওয়া যায়। আবার বেশ কিছু অস্ত্র ও মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে যেগুলো সিন্ধু সভ্যতার মানুষের তৈরি বলে মনে হয়নি। এসব থেকে অনুমান করা হয় প্রাকৃতিক ও আভ্যন্তরীণ সংকটের সঙ্গে বহিরাগত আক্রমণের চূড়ান্ত আঘাত সংযুক্ত হয়েছিলো সিন্ধু সভ্যতার উপর। আর এসবের সম্মেলনেই সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছিলো।
আর্য-আক্রমণ ও সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংস :
প্রথমেই স্মর্তব্য যে, সিন্ধু-সভ্যতা ও বৈদিক আর্য-সংস্কৃতির মধ্যে সুস্পষ্ট প্রভেদই হলো সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসের কারণ|সিন্ধু সভ্যতা মূলতই কৃষি-নির্ভর এবং বৈদিক-সংস্কৃতি মূলতই পশুপালন নির্ভর। ইতিহাসবিদদের কিছু কিছু মতবিরোধ সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতায় আক্রমণকারী বহিরাগতরা যে আর্য জাতিই ছিলো এই যুক্তির পেছনে প্রত্নতত্ত্বমূলক ও প্রাচীন সাহিত্যমূলক নিদর্শন রয়েছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।
সিন্ধু-সভ্যতা প্রসঙ্গে গর্ডন চাইল্ড বলেন, এর আদি পর্বের চেয়ে অন্তিম পর্বের কথাই আমাদের কাছে স্পষ্টতর। কেননা প্রত্নতত্ত্বে প্রমাণিত হয়েছে, কোনো এক লিপিহীন প্রাক্-সভ্য মানবদলের আক্রমণেই এ-সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিলো।
কিন্তু এই আক্রমণকারী কারা? এ প্রসঙ্গে ১৯২৬ সালেই শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মন্তব্য করেছিলেন, ঋগ্বেদ থেকেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়– বোঝা যায়, যাঁরা বেদ রচনা করেছিলেন তাঁরাই ধ্বংস করেছিলেন সিন্ধু সভ্যতা।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯২২ সাল থেকে সিন্ধু-উপত্যকার প্রত্নখননের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্ন-নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে যাবতীয় তথ্য-প্রমাণসহ তৎকালীন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান স্যার জন মার্শাল প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্ট প্রকাশ করেন ১৯৩১ সালে। ঐ রিপোর্টে এবং পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এ-বিষয়ে শ্রীযুক্ত চন্দ’র মূল মন্তব্যই সুপ্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। শ্রীযুক্ত চন্দ এ-বিষয়ে ঋগ্বেদ থেকে কোন ধরনের নজির দেখিয়েছিলেন সংক্ষেপে তা উল্লেখ করা যেতে পারে (সূত্র: দেবীপ্রসাদ/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫২-৩)-
‘ঋগ্বেদের অনেক জায়গায় পুরঃ বা পুর্-এর উল্লেখ দেখা যায়| একটি ঋকে অয়স্-নির্মিত কোনো শতভূজি বা বিরাট পুরের উল্লেখ আছে। অয়স্ মানে লোহা বা তামা। স্পষ্টই বোঝা যায় মজবুত বা কঠিন অর্থেই এ সব ক্ষেত্রে অয়স্ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ঋগ্বেদে কিন্তু আর্য ঋষি ও উপাসকদের বদলে আর্য শত্রুদের সঙ্গেই পুর-এর সম্পর্ক বারবার চোখে পড়ে। ঋগ্বেদের দু’জন বিখ্যাত রাজা– ভরতদের রাজা দিবোদাস এবং পুরু-দের রাজা পুরুকুৎস– পুর-অধিবাসী শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে নিরত। দিবোদাস ছিলেন সুবিখ্যাত সুদাস-এর পিতামহ। পরুষ্ণী বা রাবী নদীর পশ্চিম তীরে সুদাস দশটি ট্রাইবকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। ভক্ত দিবোদাসের হয়ে ইন্দ্র ‘অশ্মনময়ী’ শত পুর ধ্বংস করেছিলেন। আধুনিক বিদ্বানেরা পুর বলতে সাময়িক আশ্রয়স্থল বুঝেছেন।কিন্তু পুর শব্দের অর্থ হলো নগর বা শহর, কেল্লা নয়। কেল্লার সংস্কৃত প্রতিশব্দ হলো দুর্গ এবং ঋগ্বেদেই তার উল্লেখ পাওয়া যায়।একটি ঋকে পুর এবং দুর্গ শব্দ পাশাপাশি উল্লিখিত হয়েছে।ঋগ্বেদের যুগে কোথাও কোনো নগরের চিহ্নই ছিল না– এ-জাতীয় সংস্কার থেকে মুক্ত হলে উক্ত ঋকে শহর এবং কেল্লা উভয়েরই পরিচয় আমাদের চোখে পড়বে। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়োতে নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হবার পর আজ আর এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে ঋগ্বেদের আর্যরা বিপক্ষের নগর ও শহরের সঙ্গে পরিচিত ছিল।এককালে ইন্দ্র-উপাসক আর্যরা সত্যিই এ-দেশের সুসভ্য অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, সেই স্থানীয় মানুষেরা নগরে বাস করতো এবং সুরক্ষিত স্থানের আশ্রয়ে যুদ্ধ করত– এই ঘটনাটি সত্য এবং জনস্মৃতিতে এর স্মৃতি বহুদিন টিকে থেকেছে। তা হলে, আর্যদের ওই শত্রু বলতে কারা? ঋগ্বেদে কি তাদের সম্বন্ধে আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়? আমার মনে হয়, সিন্ধু-উপত্যকায় আর্যরা এই যে স্থানীয় নগরবাসীদের সঙ্গে সংগ্রাম করেছিল, ঋগ্বেদের সমস্ত মণ্ডলেই তাদের নাম দেওয়া হয়েছে পণি।পণি শব্দটি স্পষ্টই পণ বা মূল্য থেকে এসেছে।
ঋগ্বেদ-উল্লিখিত পণি বলে মানুষেরা ধনী সওদাগর এবং ঋগ্বেদের নানা জায়গায় এই পণিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়েছে। ঋগ্বেদের সূক্তগুলি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, বৈদিক আর্যরা প্রধানত দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল : পুরোহিত ও যোদ্ধা। পশুপালনই তাদের প্রধান জীবিকা, প্রধান ধনসম্পদ বলতে গোরু। কৃষিকাজের প্রচলন ছিল সীমাবদ্ধ। সিন্ধু-উপত্যকায় সুপ্রাচীন কালে ব্যবসা-বাণিজ্যমূলক জীবন গড়ে উঠছিল। ওই পণিরা খুব সম্ভব ছিল সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার শেষ পর্যায়ের প্রতিনিধি, সেই পর্যায়েই তারা আক্রমণকারী আর্যদের সংস্পর্শে আসে।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে সিন্ধু উপত্যকায় যে-ঘটনা ঘটেছিল তার সঙ্গে সমসাময়িক ইজিয়ানের ঘটনার তুলনা করা যায়– উত্তর-পশ্চিম দেশ থেকে একের পর এক আর্য ভাষাভাষীর ঢেউ এসে পড়ে। এই আক্রমণকারীদের মধ্যে ঋগ্বেদে যারা নিজেদের আর্য আখ্যা দিয়েছে তারা উপত্যকার দক্ষিণাংশে নগর ও সৌধবাসী এক সুসভ্য মানবদলের সংস্পর্শে আসে– এরা প্রধানতই ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নির্ভর করত। বিজেতা আর্যরা ঐহিক সংস্কৃতির দিক থেকে তুলনায় অনুন্নত ছিল; তারা হয় ঐ নগরগুলি ধ্বংস করেছিল আর নয়তো এগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে দিয়েছিল। ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রকে বলা হয়েছে পুরোহা বা পুরন্দর– পুর-ধ্বংসকারী। ইজিএন্-এর প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার মতোই সিন্ধু-উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতাও আর্য-আক্রমণের আঘাত সহ্য করতে পারেনি।’
হরপ্পা-নগরীর গৌরবের দিনে কর্তৃপক্ষ যেমন নিখুঁতভাবে নগর-পরিকল্পনার আইনকানুন কায়েম রাখতো তা আর টিকছে না। পিগট্ দেখাচ্ছেন, মহেঞ্জোদাড়োর সর্বোচ্চ পর্যায়টিতেও আতঙ্কপূর্ণ অবস্থা এবং অবক্ষয়ের ছবি সুপরিস্ফুট। আতঙ্কিত নগরবাসী ধনদৌলত গয়নাগাঁটি মাটিতে পুঁতে রাখবার আয়োজন করছে, পথঘাটের উপর বাড়িঘর এগিয়ে আসছে, ইটের গাঁথনি আগের তুলনায় অনেক নিকৃষ্ট, বড় বড় ঘরগুলো ভাগ করে নিয়ে এক বাড়িতে অনেকে একসঙ্গে থাকবার আয়োজন করছে, এমনকি সদর রাস্তার উপরেই মৃৎপাত্র পোড়াবার চুল্লি তৈরি হচ্ছে। এবং এ-নগর আক্রান্ত হবার পরিচয়ও অস্পষ্ট নয়– রাস্তায় সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়া মানুষের কঙ্কাল তার সাক্ষ্য। এমনই দুর্দিনে তারা খুন হয়েছিল যখন বাকি মানুষ প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত– মৃতের সৎকার করবে কে?’
নগরগুলি শেষ পর্যন্ত অধিকার করলো কারা? তারা যে লিপি-হীন প্রাক্-সভ্য ছিলো এ-বিষয়ে হরপ্পা এবং চানহুদারোর নিদর্শন থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পার দুটি কবরখানার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিমেট্রি আর-৩৭’ (Cemetery R-37) এবং ‘সিমেট্রি-এইচ্’ (Cemetery H)। হুইলারের মতে প্রথমটি অনেক পুরানো, প্রকৃত হরপ্পা-সংস্কৃতির পরিচায়ক; কিন্তু দ্বিতীয়টি অনেক পরের যুগের। কেননা দ্বিতীয়টিতে শুধু যে কবর দেবার পদ্ধতি অন্য রকম তাই নয়, এই কবরখানায় অন্যান্য এমন নিদর্শন পাওয়া গেছে যাকে কিছুতেই প্রকৃত হরপ্পা-সংস্কৃতির পরিচায়ক বলা যায় না।
এখানে প্রশ্ন হলো, দ্বিতীয় কবরখানাটা যদি প্রকৃত সিন্ধু-অধিবাসীদের না হয়, তাহলে তা কাদের কবরখানা? ১৯৪৩ সালে গর্ডন চাইল্ড একটু রয়েসয়ে মন্তব্য করেছিলেন, এ-কবরখানা আক্রমণকারী আর্যদেরই হওয়া সম্ভব। এবং প্রত্নতত্ত্বমূলক পরবর্তী কাজ– বিশেষত ১৯৪৬ সালের উৎখনন– চাইল্ডের এই মন্তব্যকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
১৯৪৪ সালে ‘আর্কিওলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে স্যার মর্টিমার হুইলার বিভিন্ন প্রত্নস্থানে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পরবর্তী যেসব খননকাজ পরিচালনা করেন তার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় সেখানেই সিন্ধু-সভ্যতায় আর্য-আক্রমণের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন সাক্ষ্য-নিদর্শন দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন-
‘সিমেট্রি-এইচ্’-এর প্রত্ন-নিদর্শনগুলির সঙ্গে প্রকৃত হরপ্পা-সংস্কৃতির নিদর্শনের পার্থক্য থেকে স্বভাবতই অনুমিত হয়েছে, এগুলি কোনো এক স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিচায়ক। তার নাম দেয়া হয় ‘সিমেট্রি-এইচ’ ইন্ডাস্ট্রি। ১৯৪৬ সালের প্রত্ন-খননকাজে স্পষ্টই বোঝা গেলো, হরপ্পা নগরীর ধ্বংসস্তুপের উপর বেশ অনেকখানি জঞ্জাল জমা হয়েছিলো; তারই উপর আগন্তুক ইন্ডাস্ট্রির স্বাক্ষর। তার মৃৎপাত্র অনেক নিকৃষ্ট, সে-মৃৎপাত্রের সঙ্গে সংযুক্ত গৃহনির্মাণকৌশলের যেটুকু পরিচয় তাও অনেক নিকৃষ্ট– হরপ্পা-সংস্কৃতির নির্মাণকুশলতার সঙ্গে তুলনা হয় না। এই নব্য-ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে অক্ষর-পরিচয়েরও অভাব দেখা যায়। তা ছাড়া, এই আগন্তুক ইন্ডাস্ট্রির আবির্ভাব যেন আকস্মিকভাবেই ঘটেছিলো– সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের উপর হঠাৎ যেন উটকোর মতো এসে পড়েছিলো। এই উৎখননে আরও দেখা গেলো, হরপ্পা-নগরীর শেষদিকের পর্যায়ে রক্ষণ-ব্যবস্থাকে নতুন করে– এবং খানিকটা তাড়াহুড়ো করেই যেন– আরও পাকা-পোক্ত করে তোলবার আয়োজন হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে পিগট্-এর মন্তব্য হলো, নগরবাসীরা তখন আত্মরক্ষার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত।
কাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা? স্বভাবতই অনুমান হয়, ‘সিমেট্রি-এইচ্’-এর সঙ্গে সংযুক্ত লিপি-হীন নির্মাণ-অনভিজ্ঞ প্রাক্-সভ্য মানবদলের আক্রমণ।
চানহুদারোর ধ্বংসস্তুপ থেকেও মোটের উপর একই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে-
‘প্রথম– অর্থাৎ সর্বনিম্ন, অতএব সর্বপ্রাচীন– স্তরে অবধারিত হরপ্পা-সংস্কৃতির পরিচয়। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তর দুটিতে স্বতন্ত্র এবং আগন্তুক সংস্কৃতির সাক্ষ্য; প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও সুস্পষ্ট। এর মধ্যে দ্বিতীয় স্তরটির নাম দেওয়া হয় ঝুকর-সংস্কৃতি। অর্থাৎ চানহুদারোতে হরপ্পা-সংস্কৃতির ধ্বংসস্তুপের উপর ঝুকর-সংস্কৃতির মানুষেরা আবাস স্থাপন করেছিল। কিন্তু সে-আবাসের নির্মাণকৌশল অত্যন্ত নিকৃষ্ট। তা ছাড়া, এ-সংস্কৃতির সীল, হাতিয়ার, তাবিজ প্রভৃতিও পাওয়া গিয়েছে। হরপ্পা-সংস্কৃতির সীলের উপরকার সুনিপুণ কারিগরির তুলনায় ঝুকর-সংস্কৃতির সীলগুলি শুধুই যে স্থূল ও বাজে ধরনের তাই নয়– এগুলিতে কোনো লিপির পরিচয় নেই। সিন্ধু-সাম্রাজ্যের অন্যান্য জায়গায়ও এই ঝুকর-সংস্কৃতির স্মারক পাওয়া গিয়েছে এবং সর্বত্রই তা বর্বর-অবস্থারই পরিচায়ক (পিগট্-এর অভিমত)। আরও দ্রষ্টব্য হলো, এই ঝুকর-সংস্কৃতির সীলের সঙ্গে ছবি প্রভৃতির দিক থেকে প্রাচীন হিটাইট-দের সীলের সাদৃশ্য চোখে পড়ে এবং হিটাইটদের এক চুক্তিপত্রে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতাদের নাম আবিষ্কৃত হয়েছে। অতএব চানহুদারোতে হরপ্পা-সংস্কৃতির ধ্বংসস্তুপের উপর ঝুকর-সংস্কৃতির যে-বাহকেরা আবাস স্থাপন করেছিল তাদের সঙ্গে বৈদিক আর্যদের সম্পর্ক– বা যোগাযোগ– থাকা অসম্ভব নয়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৫)
সিন্ধু-সভ্যতায় আর্য-আক্রমণের ঋগ্বেদ-সাক্ষ্য :
১৯৪৩ সালে গর্ডন চাইল্ড যে ‘সিমেট্রি-এইচ্’-কে বৈদিক মানুষদের কবরখানা বলে সনাক্ত করতে চেয়েছিলেন, এই প্রসঙ্গে– এবং ১৯৪৬ সালের খননকাজের ভিত্তিতে– স্যার মর্টিমার হুইলার মন্তব্য করেছেন (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের তর্জমায়)-
‘ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের পটভূমি হিসেবে ভারতীয় সাহিত্যের নজির খুঁজতে যাওয়া সব-সময়েই কিছুটা বিপজ্জনক এবং সে-বিপদের সম্ভাবনা এখানেও আছে। সপ্তসিদ্ধু পাঞ্জাব ও তার আশপাশে আর্য-আক্রমণের বর্ণনা হিসেবে বারবার স্থানীয় অধিবাসীদের প্রাচীরবেষ্টিত নগর বিধ্বস্ত করবার কথা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে এই নগর বোঝাবার জন্য পুর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর্যদের যুদ্ধদেবতা ইন্দ্র ছিলেন পুরন্দর, পুর-ধ্বংসকারী। জরার ফলে যে-রকম বস্ত্র বিদীর্ণ হয় ইন্দ্র সেইভাবেই পুরগুলি বিদীর্ণ করতেন। এই পুরগুলি কোথায় ছিল? আগেকার কালে ধরে নেওয়া হতো, এগুলি নেহাতই বুঝি পৌরাণিক কল্পনা, বা হয়তো বড় জোর আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত কোনোরকম অত্যন্ত স্থূল প্রাচীর-পরিখা ধরনের কিছু। হরপ্পায় সাম্প্রতিক খননকাজের ফলে এই চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। এখানে পাওয়া গিয়েছে এক সুউচ্চ সভ্যতার পরিচয়, সে-সভ্যতা একান্তই আর্য-পূর্ব। আমরা এখন জানতে পেরেছি যে এখানে সুবিশাল রক্ষণ-ব্যবস্থাও রচিত হয়েছিল এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের নদীগুলিকে আয়ত্তে রাখবারও আয়োজন করা হয়েছিল। এ সমস্তই হলো এমন এক যুগের কথা যা কিনা মোটামুটি আর্য-আক্রমণের সমসাময়িক। সেই সভ্যতা বিলুপ্ত হলো কী করে? জলবায়ুর অবস্থা পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে তা হয়তো দুর্বল হয়ে পড়েছিল; কিন্তু তার চূড়ান্ত বিলুপ্তির কারণ খুব সম্ভব কোনো এক ব্যাপক ও কঠিন আক্রমণ। মহেঞ্জোদাড়োর শেষাবস্থায় নির্বিচারে স্ত্রী-পুরুষ-শিশু হত্যার নিদর্শনও নেহাতই অহেতুক ঘটনা না হওয়াই সম্ভব। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, ইন্দ্রই এ-অপরাধে অভিযুক্ত।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৫-৬)
কিন্তু এমন কথা কি সত্যিই কল্পনা করা যায়, ইন্দ্র-বিধ্বস্ত ওই সৌধ বলতে হরপ্পার নিদর্শনের বদলে আসলে অন্য কিছু ছিলো– হয়তো এখনও তা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়েছে? হুইলার বলছেন-
‘এ কথা কল্পনা করতে হলে দাবি করা দরকার যে হরপ্পার শেষ এবং আর্য-আক্রমণের শুরু, এই দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী সংক্ষিপ্ত সময়টুকুর মধ্যে একই অঞ্চলে অপর কোনো এক শক্তিশালী সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং আর্য আক্রমণকারীরা তারই সুবিস্তৃত রক্ষণব্যবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। এ-জাতীয় কথা স্বীকার করা সহজ নয় এবং এ-কথা স্বীকার করতে হলে হরপ্পার রক্ষণ-ব্যবস্থা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলিকে স্বেচ্ছায় অবজ্ঞা করতে হয়। অবশ্যই আরও খননকার্যের ফলেই এ-প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর পাওয়া যাবে।’
এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদের মন্তব্য হলো- ‘হুইলারের শেষ মন্তব্যটি অবশ্যই বিনয়সূচক। কেননা ভবিষ্যতের প্রত্নতত্ত্বমূলক গবেষণার ফলে সিন্ধু-সভ্যতা সংক্রান্ত যত নতুন তথ্য পাবার সম্ভাবনাই থাকুক না কেন, ওই একই এলাকায় ওই একই যুগের কোনো এক স্বতন্ত্র সুউচ্চ সভ্যতা আবিষ্কারের সম্ভাবনা সত্যিই অবাস্তব। তা ছাড়া প্রমাণ হিসেবে অনাবিষ্কৃত তথ্যের সম্ভাবনা আবিষ্কৃত তথ্যের তুলনায় একান্তই নগন্য। প্রত্নতত্ত্বমুলক ও সাহিত্যমূলক তথ্যের মিলিত ইঙ্গিত থেকে একটি কথাই অনুমান হয় : বৈদিক মানুষদের আক্রমণে হরপ্পা-সভ্যতা বিধ্বস্ত হয়েছিল।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-৫৬)
এই অনুমানের পক্ষে ঋগ্বেদের সাক্ষ্য থেকে আরো কিছু যুক্তিও প্রদর্শিত হয়েছে। যেমন, ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলে একটি ঋক পাওয়া যায় যেখানে ইন্দ্রের কীর্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘বধীদিন্দ্রো বরশিখস্য শেষোহভ্যাবর্তিনে চায়মানয় শিক্ষন্ ।
বৃচীবতো যদ্ধরিয়ূপীয়ায়াং হৎপূর্বে অর্ধে ভিয়সাপরো দর্ত্ ।।’- (ঋগ্বেদ-৬/২৭/৫)
অর্থাৎ : চয়মানের পুত্র অভাবর্তীর প্রতি অনুকূল হয়ে ইন্দ্র বরশিখের পুত্রগণকে সংহার করেছেন। তিনি হরিয়ূপীয়ার পূর্বভাগে অবস্থিত বরশিখের পুত্র বৃচীবানের বংশধরদের বধ করেন, তখন পশ্চিমভাগে অবস্থিত বরশিখের শ্রেষ্ঠ পুত্র ভয়ে বিদীর্ণ হয়েছিলো।
ষষ্ঠ অধ্যায় : চার্বাক সিদ্ধান্ত আলোচনা-পর্যালোচনা
চার্বাক সিদ্ধান্ত আলোচনা-সমালোচনা
১.০ : প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ
(ক) প্রত্যক্ষই প্রমাণশ্রেষ্ঠ…
চার্বাক প্রসঙ্গে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টর বক্তব্য এবং তত্ত্বোপপ্লবসিংহ
(খ) প্রত্যক্ষ অনুগামী অনুমান
মাধবাচার্যের সর্বদর্শনসংগ্রহ ও চার্বাকের অনুমান-খণ্ডন
হরিভদ্রসূরির ষড়দর্শনসমুচ্চয় ও চার্বাকের অনুমান-খণ্ডন
পুরন্দরের মত এবং শান্তরক্ষিত ও কমলশীল
চার্বাকমত সম্পর্কে জয়ন্তভট্টর বক্তব্য প্রসঙ্গে
চার্বাকমত প্রসঙ্গে কৌটিল্যের সাক্ষ্য
প্রমাণ-প্রসঙ্গে অতঃপর চার্বাক সিদ্ধান্ত
প্রত্যক্ষ-প্রসঙ্গে
অনুমান-প্রসঙ্গে
২.০ : দেহাত্মবাদ বা ভূত-চৈতন্যবাদ
শঙ্করাচার্য-বর্ণিত চার্বাকী দেহাত্মবাদ
মদশক্তির দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা
দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াস
দেহাত্মবাদ খণ্ডনে তর্ক ও যুক্তি বিস্তার
চার্বাকী দেহাত্মবাদী সিদ্ধান্ত-খণ্ডন প্রয়াসের পর্যালোচনা
(ক) ‘দেহাকারে পরিণাম’ নিছক ভূতবস্তু না বাড়তি কিছুর ফল?
(খ) মৃতদেহের নজির
(গ) স্মৃতির নজির
৩.০ : স্বভাববাদ
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের নজির
ভূতবাদ ও স্বভাববাদ
স্বভাববাদ খণ্ডন-প্রচেষ্টা
স্বভাব ও যদৃচ্ছা
৪.০ : চার্বাকী বস্তুবাদ
চার্বাক ও বেদ
বস্তুবাদ বনাম ভাববাদ
বস্তুবাদী চার্বাক
উদ্দালক-আরুণি সংবাদ: উপনিষদে বস্তুবাদের অনন্য নজির
এবং তৈত্তিরীয় উপনিষদ-এ বস্তুবাদের নজির
বস্তুবাদের অন্যতম সহচর
বিশেষ অধ্যায় : কেন চার্বাক-পাঠ প্রাসঙ্গিক
চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শন :
অন্যান্য নাস্তিক্য-দর্শন ও দার্শনিক
১.০ অজিত কেশকম্বল
২.০ মক্ষলি গোশাল
৩.০ পূর্ণ কাশ্যপ
৪.০ প্রক্রুধ কাত্যায়ন
৫.০ সঞ্জয় বেলট্বিপুত্ত
৬.০ বর্ধমান মহাবীর ও জৈন দর্শন
৭.০ গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ দর্শন
অন্যান্য আস্তিক্য দর্শন ও দার্শনিক :
ভারতীয় ষড়দর্শন
১.০ সাংখ্য দর্শন
২.০ যোগ দর্শন
৩.০ ন্যায় দর্শন
৪.০ বৈশেষিক দর্শন
৫.০ পূর্ব-মীমাংসা বা মীমাংসা দর্শন
৬.০ উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন|
Reference :-
Allchin, Bridget (১৯৯৭)। Origins of a Civilization: The Prehistory and Early Archaeology of South Asia। New York: Viking।
Allchin, Raymond (ed.) (১৯৯৫)। The Archaeology of Early Historic South Asia: The Emergence of Cities and States। New York: Cambridge University Press।
Aronovsky, Ilona (২০০৫)। The Indus Valley। Chicago: Heinemann। অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
Basham, A. L. (১৯৬৭)। The Wonder That Was India। London: Sidgwick & Jackson। পৃষ্ঠা 11–14।
Chakrabarti, D. K. (২০০৪)। Indus Civilization Sites in India: New Discoveries। Mumbai: Marg Publications। আইএসবিএন 81-85026-63-7।
Dani, Ahmad Hassan (১৯৮৪)। Short History of Pakistan (Book 1)। University of Karachi।
Dani, Ahmad Hassan (১৯৯৬)। History of Humanity, Volume III, From the Third Millennium to the Seventh Century BC। New York/Paris: Routledge/UNESCO। আইএসবিএন 0415093066।অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
Gupta, S. P. (১৯৯৬)। The Indus-Saraswati Civilization: Origins, Problems and Issues। Delhi: Pratibha Prakashan। আইএসবিএন 81-85268-46-0।
Gupta, S. P. (ed.) (১৯৯৫)। The lost Sarasvati and the Indus Civilisation। Jodhpur: Kusumanjali Prakashan।
Kathiroli (২০০৪)। "Recent Marine Archaeological Finds in Khambhat, Gujarat"। Journal of Indian Ocean Archaeology (1): 141–149। অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
Kenoyer, Jonathan Mark (১৯৯৮)। Ancient cities of the Indus Valley Civilisation। Oxford University Press। আইএসবিএন 0-19-577940-1।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন