পরিযায়ীর ঈদ : চন্দন কুমার কুণ্ডু

চন্দন কুমার কুণ্ডু

পরিযায়ীর ঈদ
 
চন্দন কুমার কুণ্ডু


জব্বার আর তার দিদি কুলসুমের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল। জব্বার বলল,
--হেই দিদি ঈদের আর কদ্দিন দেরি আছে?
কুলসুম উত্তর দেয়,
-- দিন জেনহে কী করবি তু?
-- আব্বু বুল্যেছে না ঘর যাব্যে, লতুন জামা দিব্যে...
-- তুই যা গাড়হি চলছে তুর লেগ্যে। টেরেন চইলছে না, বাস চইলছে না তা ঘর যাব্বি কী কর‍্যে?
--তালে আব্বু বুল্যে কেনে....!

বসির মিঞা বউ নাজমুন, ছেলে জব্বার ও মেয়ে কুলসুমকে নিয়ে বড় আতান্তরে পড়েছে। বসিরের ছেলে জব্বারের বয়স ছ' বছর আর মেয়ে কুলসুমের আটবছর। বছর চল্লিশের বসির স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে লখ্নৌ শহরের শহর তলীর নানা জায়গায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। এতদিন আরো কয়েকটি বাঙালি মুসলমান পরিবারের সঙ্গে কাজ করে চলে যাচ্ছিল তাদের সংসার। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল লকডাউনে একমাস যাবৎ  কাজ বন্ধ। এতদিন প্রমোটার বাবুরা কিছু কিছু সাহায্য করে  তাদের খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করলেও এবার তাদের পথ দেখতে বলেছেন। কেননা তাঁরাও জানেন না এ কাল নিয়ম আর কতদিন চলবে! কতদিনই বা পাঁচটি পরিবার
কে তাঁরা বসিয়ে রেখে খাওয়াবেন!

স্কুলফাইনাল পাশ বসির মাঝে মাঝে তার মোবাইল থেকে লকডাউন আর করোনা সংক্রান্ত খবরা খবর অন্যান্যদের শোনায়। কিন্তু লকডাউন ওঠার কোন সম্ভাবনাই দেখে না সে। খবরে জানতে পারে বিদেশে থাকা নানা রাজ্যের মানুষ জনকে বিনা ভাড়ায় প্লেনে করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু ট্রেন বাসের চাকা সেই যে একবার থামল  আর চলার নাম নেই। মনের মধ্যে উৎকন্ঠা থাকলেও উপায় নেই। তবূও তো একমাস কিছু কিছু সাহায্য করেছেন বাবুরা। নমাজের সময় আল্লাহর কাছে সে প্রার্থনা করে আল্লাহ যেন এই বাবুদের ভাল রাখেন, সুস্থ রাখেন।

ইতিমধ্যেই বসির জানতে পারে, অন্যান্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে আটকে পড়া শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা শুরু করেছে। লকডাউন নাকি এখনো চলবে। অথচ বিদেশ বিভুঁই এ থাকা মানুষ গুলান খাবে কী? বাঁচবে কি কর‍্যে ? -তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নাই।' উল্টে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের অবলীলায়                            'পরিযায়ী' বলা হচ্ছে। কেন, তারা কী এদেশের মানুষ নয়? মোবাইলে খবর চালিয়ে মাথা ঘুরে যায় বসিরের। হাজার হাজার মানুষ রেলপথ ধরে বা সড়ক পথে লাইন দিয়ে হেঁটে চলেছে। সেই দেখে বসিরের নানার কথা মনে পড়ে। তার নানা তাকে দেশভাগের গল্প শোনাত। হাজারে হাজারে মানুষ মাথায় পোঁটলা পুটলি বেঁধে এদেশ থেকে পাকিস্তানে আর পাকিস্তান থেকে এদেশে কিভাবে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিল, সেই গল্প। তার নানাও ছেলে পুলে ,সংসার নিয়ে পালিয়েছিল পাকিস্তানে। ওখানে গিয়ে বুঝতে পারে 'ওটা তার দেশ লয়। সব ভালবাসা এদেশের পরেই।' তাই আবার ফিরে আসে। ছবির মত নানার কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে বসিরের। তার সঙ্গে অন্যান্য যে পরিবার গুলো কাজ করে সেই নিজাম, মফিজুল, বরকত, লালনদের কারও বাড়ি মুর্শিদাবাদ, কারও মালদা আবার কারও বর্ধমানের কালনা। এদের মধ্যে বসির যা লেখাপড়া জানে। বাকিরা প্রাথমিকের গণ্ডিও পার হয় নি। তাই সবারই ভরসা সেই বসির।

আসরের নমাজের পর বসির সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসে। কী করা যায়? ছেলে মেয়ে নিয়ে তো আর শুকিয়ে মরতে পারে না তারা! বরকত বলে,
--এত লোক যখুন হেঁইটে যেছে তখুন আমরা পারব না ক্যানে? ইখানে সরকারের ভাব সাব ভালো লয় কবে মেরে তাড়াবেক; চল হাঁটি।
অন্যান্যরাও তার কথায় সায় দেয়। বীরভূমের মল্লার পুরের বাসিন্দা বসির আর দেরি না করে সবাইকে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে বলে।

প্রমোটার বাবুর দেওয়া কিছু খাবার দাবার ও সঞ্চিত সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। এক নতুন জীবন সংগ্ৰাম শুরু হয়। দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদের তাপে গাছ তলায় শুয়ে বসে কাটিয়ে রাতের দিকেই হাঁটে বেশি। শরীরের সব তাকৎ যেন শেষ হয়ে আসে। বেশি সমস্যায় পড়ে বাচ্চাদের নিয়ে। তাদের  কাঁধে নিয়েও পথ চলতে হয়। কখন জল ফুরিয়ে যায়, কখন খাবার, কখন যেন চলার শক্তিই হারিয়ে ফেলে। এমন ও হল খাবার পাওয়া গেল না। জল খেয়েই পথ চলতে হল।

অবশেষে এক রাতে একটা গাড়ি পাওয়া গেল। ভাড়া চুকিয়ে উঠে বসল সকলে। সব কষ্ট আর ক্লান্তি ভুলে যে কথা প্রথমেই মনে এল ঈদের আগেই বাড়ি পৌঁছাতে পারবে তারা। আর যাই হোক ঈদটা বাড়িতে কাটান যাবে। নিজেদের অজান্তেই কখন ঘুমিয়ে পড়ল ।

গাড়িটা হঠাৎ শব্দ করে ব্রেক কষে থেমে গেল। তন্দ্রা ছুটে গিয়ে চোখ খুলে গেল। তখন সবে ভোরের আবছা অন্ধকার কেটে গিয়ে সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বাঁধের ওপর গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে। দামোদর ড্যামের বিপুল জলরাশি সকালের আলোয় সকলকে মুগ্ধ করে দিল। সেদিকেই চেয়ে রইল বসির। পরক্ষনেই ভগ্ন দূতের মত দুজন পুলিশ উপস্থিত হলেন। তাঁরা জানালেন,
--গাড়িতে লোক নিয়ে যাবার পারমিশান নেই; অতএব তাদের নেমে যেতে হ'ল। সবার অনুরোধ উপরোধেও কোন কাজ হ'ল না। আবার শুরু হ'ল পদযাত্রা। হাঁটতে হাঁটতে রেলের ওভার ব্রীজ পার হয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল। কোন পথে তাদের পথ চলতে সুবিধা হবে এই কথাবার্তার মাঝেই পুলিশের মোবাইল ভ্যান সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকেই একজন জানতে চাইলেন , তারা কোথা থেকে আসছে এবং কোথায় যাবে? বাড়তি কোন কথা বলতে না দিয়ে অন্য একটি গাড়িতে তাদের তোলা হ'ল। অল্প সময়ের মধ্যেই  একটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পৌঁছে গেল তারা। সেখান থেকে পনের দিনের আগে মুক্তি নেই। বসির বোঝায়,
--তাও ভালো, রাস্তায় না খেঁয়ে মোরব না।ইরা খাবার দিবে, থাকতে দিবে যখুন....
শুধু ঈদের দিনটার কথা মনে হলেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। যেখানেই কাজে যাক না কেন প্রতিবছর বৃদ্ধ বাবা,মা আর ভাইদের সংসারের সব দুঃখ কষ্ট বিভেদ ভুলে তারা কত আনন্দ করে। কত আগে থেকে তার প্রস্তুতি নেয় বসির। কষ্টের সংসারের টাকা বাঁচিয়ে এই সময় বউ নাজমুন তার হাতে কিছু তুলে দিবেই। সে কৃতজ্ঞতার কথা ভুলতে পারে না বসির।

খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন দিনই ছুৎমার্গ নেই বসিরের। নেই নাজমুনের ও। ছেলে মেয়ে দুটোও  এসব দেখেই বড় হচ্ছে। যখন যেমন জোটে তেমনটি খাওয়া অভ্যেস তাদের ও। কিন্তু সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের যে খাবার তাদের দেওয়া হয়েছে তা গরু ছাগলেরও অখাদ্য। গুমে যাওয়া চালের ভাত, পোকা ধরা কলাইয়ের ডাল, স্বাদ হীন তরকারি। বসিরের ছেলে মেয়েও বোধ হয় এই প্রথম  যেদিন ভাত না খেয়ে ফেলে দিল।...

করোনার আতঙ্ক, বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তা এই সব মিলিয়ে বসিররা এবার রোজা রাখতে পারে নি। অন্যান্য পরিবার গুলির অবস্থাও একই। কিন্তু ঈদের দিনটা অন্তত বাড়িতে কাটাবে ভেবেছিল বসির। ঈদের দিন সকালে স্নান সেরে ঈদের নমাজের শুরু এবং শেষে অতিরিক্ত তাকবিরের সঙ্গে নমাজ আদায় করল সে। যখন যেখানেই থাক না কেন নমাজের সময় কখন ভুল করে না। এ ব্যাপারে সে একটু বেশি নিয়ম নিষ্ঠ।

নামাজের পরেও মনটা প্রসন্ন হল না। আজ খাবার তুলনা মূলক ভাল হলেও গলা দিয়ে নামল না যেন। মাগরিব (সন্ধ্যার নামাজ )ও যথাসময়ে সেরে নিল। সন্ধ্যায় জব্বার, কুলসুমকে নিয়ে বসে নানা গল্প করতে লাগল। গল্পের মাঝে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কুলসুম। অন্যমনস্ক বসিরকে হঠাৎ চমকে দিয়ে জব্বার বলে ওঠে,
--আব্বু! আজ না ঈদ? উরা সব বুলছিল। তুমহি তো বল নাই?
--হ্যাঁ বাপজান, আজ খুশির ঈদ।
--তুমহি লতুন জামা দিব্যা বুল্যেছিলে দিলহে না কেনে-?
জব্বার বাপজানের কোলে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। হঠাৎ বসির কেমন যেন উদাস  হয়ে গেল। সে কোথায়? তার চেতনা যেন লোপ পেল। এক সময় তার দু-গাল বেয়ে টপ টপ করে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল জব্বারের গালের ওপর। হতচকিত জব্বারের কান্না থেমে গেল। বাপজানের মুখের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল সে। মাথাটা সামান্য ওপরে তুলে তার ছোট ছোট নরম দুটো হাত  দিয়ে আব্বুর 'চোখের পানি' মুছিয়ে দিল। তারপর আব্বুর কোলের মধ্যেই মুখটা গুঁজে দিল জব্বার। এক লহমায় সব দুঃখ, যন্ত্রনা, অপমান ভুলে গেল বসির। শহরের এই স্কুলঘরটায়,সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে বেহেস্ত নেমে এল যেন। দুহাত উপরে তুলে আল্লাহ তালার কাছে নিজের কৃতজ্ঞতা জানাল বসির। সত্যিই এমন খুশির ঈদ জীবনে আসে নাই। আর কখনো আসবে কি না কে জানে?......
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.