অথ বিধবা কথা : পিনাকী চৌধুরী


অথ বিধবা কথা

পিনাকী চৌধুরী   

সময়টা হয়তো কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের সমাজে বিধবাদের অনেক লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয় ! মুখে যতোই আমরা নারী প্রগতির কথা বলিনা কেন, আমাদের সমাজে বিধবা মহিলারা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই থেকে গেছেন ! সুদূর অতীতের সেই সাদা কালো দিনে একশ্রেণীর সুবিধাভোগী উচ্চবর্ণের মানুষ বিধবাদের জন্য অনেক নিয়ম কানুন তৈরি করেছিলেন ! সমাজের কিছু সংখ্যক মুষ্টিমেয় হর্তাকর্তা মানুষ বিধান দিতেন যে, মাছ- মাংসতো দূর অস্ত, এমনকি বিধবাদের পেঁয়াজ, রসুন খাওয়াও চলবেনা ! নিয়ম করে বিধবাদের একাদশী ব্রত পালন করতে হবে , ইত্যাদি ইত্যাদি ! মোদ্দা কথা হল , একজন মহিলার স্বামী গত হলেই সেই মহিলাকে শাঁখা , সিন্দুর ত্যাগ করে কঠোর কৃচ্ছসাধন ও ত্যাগের মাধ্যমেই যেন তাঁর বাকি জীবনটা অতিবাহিত করাটাই যেন চল হয়ে গিয়েছিল তখন ! প্রতি পদেই যেন তখন বিধবাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো ! 
 
পিনাকী চৌধুরী 


পারিবারিক সম্মান এবং পারিবারিক সম্পত্তির কথা বিবেচনা করে তথাকথিত কিছু উচ্চবর্ণের সুবিধাভোগী মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের অনুমতি দেয়নি ! বাস্তবে সেইসব উচ্চবর্ণের মানুষের এহেন আচরণ যেন স্বেচ্ছাচারিতাই নামান্তর ছিল । মুখে কেউ টুঁ শব্দটি করতে পারতেননা ! কিন্তু সমাজে সেই প্রচলিত নিয়মে যেন বিষ বাষ্পে ভরে গিয়েছিল সমাজ ! প্রবল প্রতাপশালী এবং অবশ্যই ক্ষমতালোভী কিছু উচ্চবর্ণের পুরুষ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এইসব আইন বলবৎ করেছিলেন ! দিনের পর দিন চলতে থাকে বিধবাদের এই অবর্ণনীয় কষ্ট ! অবশেষে এলো সেই সন্ধিক্ষণ ! এক বুক সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ! বাস্তবে বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার ভারতে ১৮৫৬ সালে আইন প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে বিধবাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদির সামাজিক রক্ষাকবচ প্রদান করা হয় ।

 এখানে বলে রাখা ভাল যে, ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপস্থিতিতে প্রথম বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় ! সময় হয়তো কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের সমাজে  বিধবাদের অনেক কিছুই সহ্য করতে হয় ! হ্যাঁ, সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কার বাপের সাধ্য ? শহরের আনাচে কানাচে আজও একশ্রেণীর কুচক্রী মহিলা প্রতিবেশী সদ্য বিধবা হয়েছেন , এমন মহিলার কাছে জানতে চান যে, তিনি মাছ ভক্ষণ করেন কিনা ! সেই বিধবা নারীর পরনে যদি হালকা লাল রঙের শাড়ি দেখেন , তাহলেও হয়তোবা সেই কুচক্রী মহিলা বাঁকা হাসি হাসেন ! বাস্তবে এই বৈধব্য যোগ কপালের লিখন নয় , মানুষের নৈতিক অধঃপতনের ফলেই এবং অনুসন্ধিৎসার ফলে বৈধব্য  যেন মননে ! হ্যাঁ, যুগটা হয়তো বদলেছে, কিন্তু আজও আমাদের সমাজে বিধবাদের একঘরে করে রাখার সেই ট্রাডিশন অব্যাহত ! এমনকি কোনো অল্প বয়সী বিধবা মহিলা যদি আবারও বিবাহের প্রস্তুতি নেন , আমাদের সমাজের so called একশ্রেণীর মাতব্বর অবলীলায় বলে দেন উক্ত বিধবা মহিলার যৌনতার কথা ! 

হ্যাঁ, আমাদের সমাজে গতানুগতিকতার উর্ধ্বে উঠে বিধবা মহিলার যৌনতার কথা বলা চাট্টিখানি কথা নয়। বহুকাল আগে , কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমসাময়িক লেখক জগদীশ গুপ্ত তাঁর ছোট গল্প ' বিধবা রতিমঞ্জরী'তে তুলে ধরেছিলেন এক বিধবা মহিলার যৌনতার কথা , যে বিধবা মহিলা সংবাদ পত্রে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর বাসনাকে ব্যক্ত করেছিলেন  ! চারিদিকে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল তখন , অনেকেই গেলো গেলো রব তুলেছিলেন ! সেই গল্পটা নিয়ে তদানীন্তন সময়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল ! হ্যাঁ সেই ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত ! আজও নারীর, বিশেষত বিধবা মহিলার  যৌনতা নিয়ে ছুৎমার্গ রয়েই গেছে সমাজে ! হ্যাঁ , সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিধবা মহিলারা আজও অবহেলিত ও উপেক্ষিত ! 
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.