![]() |
একটি সিনেমার গল্প : চাষী সিরাজুল ইসলাম |
১.
ল্যান্ডফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো। শাহদাব ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই একট মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পেলো। মিস্টি একটা কণ্ঠস্বর। যে কোনো ছেলে এই কণ্ঠস্বর শুনে মেয়েটিকে না দেখেও প্রেমে পরে যেতে পারে। মেয়েটি বললো,
--হ্যালো এটা কী হাবিব ব্যাঙ্ক ? কাইন্ডলি একটু মানিক ভাইকে দেবেন।
শাহদাব বললো,
--এটা লোহানী টকিজ। ফিল্মের অফিস।
মানিক ভাই নামেতো এখানে কেউ নেই।
--সরি, বলে মেয়েটি ফোন রেখে দিলো।
লোহানী টকিজটা তখন গোপীবাগের আর কে মিশন রোডের ছায়া বিথীর উল্টো দিকের বাড়িতে অবস্থিত। শাহদাব ক্রমান্নয়ে পদন্নতি পেয়ে চার নম্বর সহকারী পরিচালক থেকে লোহানী টকিজের 'রৌদ্র ছায়া' সিনেমার প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেব কাজ করছেন। সেই সুবাদে শুটিং, ডাবিং, এডটিং না থাকলে লোহানী অফিসে এসে ছবির পরবর্তী শুটিং, আর্টিসদের সিডিউল নেয়া,ডাবিং এডিটিংয়ের অগ্রগতি প্রভৃতি কাজে ব্যাস্ত থাকেন। এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন। আর ক্রসকানেকশনের পর থেকেই ওই অদেখা মেয়েটি মাঝে মাঝে লোহানী অফিসে ফোন করে কথা বলে শাহদাবের সংগে। মেয়েটি নিজের পরিচয় না দিয়ে একটা রহস্যের জালে রেখে দেয় শাহদাবকে। নিজেকে ধরা দেয়না। ক্রসকানেকশনে পরিচয়েরর পর থেকে ল্যান্ডফোনে নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ অালাপ চালিয়ে যায়। দীর্ঘ আলাপেই শাহদাব এক সময় অদেখা মেয়েটির প্রেমে পরে যায়। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও মেয়েটি তার পরিচয় গোপন করে রাখে। নিজেকে একটা অবগুণ্ঠনে জড়িয়ে রাখে।
২.
এভাবে মেয়েটিকে না দেখে অার কতোদিন চলে ? শাহদাব মেয়েটিকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে মেয়েটিকে তাকে খুঁজে বেড় করতেই হবে।
শাহদাব একদিন রিক্সা থেকে নেমে লোহানী টকিজের অফিসে ঢোকার অাগে উল্টো দিকের সেই ছায়া বিথী বাড়িটার দোতালায় চোখ যেতেই দেখতে পায় শ্যাম বর্ণের ডাগর ডাগর হরিণাক্ষী একটা সুশ্রী তম্বী মেয়ে তাকে দেখছে। কাঁধে সাপের মতো বড় দুটি বেণী। সাদা জুঁই ফুলের মতো ধব ধবে সাদা পাকিস্তানি নায়িকা জেবার মতো স্লীম ফিট সালোয়ার কামিজ পড়া। অার চেহারাটা দেখতে অনেকটা মেঘে ঢাকা তারার সেই দু:খিনী রানুর মতো। শাহদাব বুঝে ফেলে এটাই ক্রসকানেকশনের সেই সুরেলা কণ্ঠের মেয়েটি। অফিসে ঢোকা মাত্রই ল্যান্ডফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে ওঠে। শাহদাব ফোনটা তুলে কানে নিতেই শুনতে পায় প্রতিদিনের মতো সেই একই মেয়েলি কণ্ঠস্বর। অালাপ শুরু হয় দু'জনের।
শাহদাব জিজ্ঞেস করে,
--একটু আগে বারান্দায় যে মেয়েটিকে দেখলাম,সেকি তুমি ?
--কোন মেয়ে ? আমিতো বারান্দায় ছিলাম না। আমি তোমার ধারে কাছেও নেই। আমাকে দেখলে কোথায় ? আমিতো থাকি সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে।
--হুম বুঝেছি! তুমি কিছু লুকাচ্ছো? সাত সমুদ্র নদীর রাজকন্যে হলেও তুমি একটু আগে বরান্দায় দাঁড়ানো সেই মেয়ে ? এতোদিনে বুঝেছি তুমি আমার খুব ধারে কাছেআছো বলেই আমার সব দেখতে পাও। তোমার আলাপ চারিতায় ওঠে আসে আমার নিখুঁত বর্ণনা, আমার প্রেমকাতর চোখ,নায়োকচিত মুখ, চুল..সব কিছু। আচ্ছা বলোত আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে তোমার কী লাভ ? দিনের পর দিন নিজেকে আড়াল করে রেখেছ। নিজের পরিচয় দিচ্ছনা,সামনে আসছোনা! সত্যি-ই যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে আর রহস্য করোনা। খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসো। পরিচয় দাও। ধরা দাও। আমরা পায়রা হয়ে উড়ে যাই দূর আকাশে । আমাদের কেউ যেন খুঁজে না পায়। রাতের চিলে কোঠায় শুয়ে আমরা আকাশ দেখবো আর অজস্র তারা গুনবো। ওদিকে রোম পুড়ে যেতে থাকবে। তোমার নিরু বাঁশী বাজাতে থাকবে। এমন প্রেম তুমি চাওনা ডার্লিং? বন্যা,সত্যি আমাকে আর কষ্ট দিওনা। তোমাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। পাগল হয়ে আছি প্রিয়তমা । তোমাকে করস্পর্শে ছোঁবো একবার। দেখবো, তুমি কী গ্রীক দেবী..... নাকি ঝুল বারান্দায় একটু আগে দেখা মেঘে ঢাকা তারার সেই রানু?
৩.
মেয়েটা চুপ করে থাকে। মেয়েরা চিরজীবন-ই এমন। সহজে নিজেকে খোলাসা করেনা। নিজেকে মেলে ধরেনা। ধরা দেয়না। কবিতার রহস্যের মতো নিজেকে আড়াল করে রাখে। শাড়ির অবগুণ্ঠনের মতো জড়িয়ে রাখে নিজকে। একটা অপার রহস্যের ঠাস বুননে নিজেকে সাদা ডিমের ভেতর কুসুমের মতো লুকিয়ে রাখে। প্রেমের ব্যাপারে এরা হয় খুব সতর্ক। বড্ড হিসেবি। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর শেষ পর্যন্ত মেয়েটি মুখ খোলে,
-হ্যাঁ প্লাবন, ধরে নাও অামিই মেঘে ঢাকা তারার তোমার সেই রানু। তোমার গ্রীক দেবী...। আমি জোসনা রাতের স্বপ্নযাত্রা। তোমার ধবল রাত। আলোকিত স্বপ্ন আকাশ। তুমি ঠিকই আমাকে বারান্দায় দেখেছো। আমি-ই তোমার ক্রসকানেকশনের সেই মেয়েটি। আমিই তোমার বন্যা। আমিতো প্রতিদিন আমাদের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখি। নায়ক দীলিপ কুমারের মতো তোমার হেয়ার স্টাইল। চোখমুখ। হাটা চলা সব তোমার দীলিপ কুমারের মতো। হে রাজপুত্তর ! তুমি দীলিপ কুমার হলে না কেনো ?
এ কথা শুনে অছির ভেবে পায়না , সে যে দীলিপ কুমারের অন্ধভক্ত, এই মেয়ে জানলো কী করে ?
আসলে কাকতালীয় ভাবে দীলিপ কুমার তাদের মধ্যে এসে গেছে। এই প্রথম মেয়েটি তার আসল নাম বললো কানিজ সালমা। ক্রসকানেকশনে মানিক নামে যাকে প্রথম দিন খুঁজেছিল,সে তার বড় ভাই। পাকিস্তান হাবিব ব্যাঙ্কে চাকুরী করে। বাবা কে কে আহমেদ। সে কুমিল্লার চিওড়ার শিল্পপতির মেয়ে। কিছুদিন আগে দুরারোগ্য ক্যান্সারে মা মারা গেছেন। মা হারা মেয়ে সে।
মা হারা মেয়ে শুনে, মেয়েটার জন্য বড় মায়া জমে ওঠে শাহদাবের। প্রাণ কেঁদে ওঠে। চোখে জল চলে আসে মাঝে মাঝে। মেয়েটা কতো দু:খি ভাবে! মনে হয় মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দেয়। এভাবেই মেয়েটাকে আরো বেশী করে ভালোবেসে ফেলে শাহদাব।
তারপর থেকে দু'জনের একটু আধটু করে দেখা সাক্ষাৎ হতে লাগলো। আর টেলিফোনে চললো মেরাথন কথোপকথন। দু'জনেই দু'জনকে পেতে মরিয়া হয়ে উঠলো। এক সময় এই প্রেমের কথা ছায়া বিথী বাড়ির সবাই জেনে গেলো। শাহদাবের সংগে কানিজ সালমার বিয়ে হোক বাড়ি কেউ- ই চাইলোনা। কারণ সিনেমার লোকের সংগে বিয়েতে কে কে পরিবার রাজি নয়। সালমা শিল্পপতির মেয়ে। তার বিয়ে হবে কোনো শিল্পপতির সংগে বা কোনো ধণী পাত্রের সংগে। খোঁজ নিয়ে জানলো, শাহদাবের কিছু নেই। বৃত্ত বৈভব কিছুনা। না বাড়ি। না গাড়ি। সে সিনেমার সহকারী পরিচালক বৈ অার কিছু নয়। বড়লোকের মা মরা অাদরের দুলালিকে সে কি খাওয়াবে ? কী পড়াবে?
৪.
কাজী বাড়ির লোকেরাও কম জাননা। তারা অবাধ্য সালমাকে বুঝাতে না পেরে একদিন করাচি পাঠিয় দেন। শিল্পপতি বাবা কে কে অাহমদ সালমাকে করাচি নিয়ে যান। যদি বুঝিয়ে শুনিয়ে সালমার মন ফেরানো যায়। আর এ দিকে সালমার খোঁজ না পেয়ে পাগল হয়ে ওঠেন শাহদাব। অনেক খোঁজ করেও সালমার হদিস করতে পারেন না। ফোন করলেও সালমা ধরেন না। ছায়াবিথীর অন্য কেউ না কেউ সে ফোন ধরে। ফোন করলে রং নাম্বার বলে রেখে দেন। শাহদাব বুঝতে পারেন তার সালমা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। তাকে সে অার পাবেনা। সালমা বড় লোকের মেয়ে। শিল্পপতির মেয়ে। পরিবারের আদরের মেয়ে। তাকে জীবন সাথী হিসেবে মনে হয় আর পাবেনা। নানা দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হয়না। খেতেও পারেন না। কাজ করতে তার ভালো লাগেনা। কিচ্ছু ভালো লাগেনা তার। সে উন্মাদ হয়ে ওঠে।
মজনুর মতো পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায় ঢাকার পথে প্রান্তরে। শুটিং ডাবিং তার কিছুই ভালো লাগেনা। ঠিক এমনি সময় সে একটা চিঠি পায়,
প্রিয় প্লাবন,
আমি এখন ঢাকায়। আমাকে বাবা চিকিৎসার নামে করাচিতে নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে অনেক বুঝানো হয়েছে, আমি জেনো তোমাকে ভুলে যাই। তোমার জীবন থেকে যেন সরে আসি। কিন্তু প্রিয়, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার জীবন। আমার মরণ। আমি বাবাকে রেখেই করাচি থেকে পালিয়ে এসেছি। তুমিতো জানো বাবা কতো কঠিন মানুষ । ইস্পাতের মতো শক্ত। তাকে কি টলানো যায়, না গলানো যায়। তবু তাকে ফাঁকি দিয়ে প্লেনের টিকিট করে করাচি থেকে পালিয়ে এসেছি শুধু তোমার জন্য। আমরা ঘর বাঁধবো বলে। আমি এই প্রাসাদ ছেঁড়ে তোমার পর্ণকুটিরে থাকবো। আমি ছায়াবিথী ছেঁড়ে চলে আসবো যে কোনো সময় যে কোনো দিন। তুমি প্রস্তুত থেকো। ইতি-
তোমার প্রাণপ্রিয় বন্যা ।
৫.
কথামতোই কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছিল কানিজ সালমা। বড় মগবাজারে খালাত বোনের সাথে থাকেন শাহদাব। সেখানে অত্যন্ত গোপন এবং সতর্কতার সাথে এসে হাজির হন সালমা। কেউ যেনো ব্যাপারটা জানতে না পারেন এবং সালমার বাবা, ভাই, বোনরা যাতে টের না পায় সালমা এখানে আছে সেভাবেই সালমাকে সতর্কতার সহিত আগলে রাখা হয় এবং সেদিন-ই বন্ধু বান্ধবদের সহযোগীতায় অনাড়ম্বরভাবে কাজী ডেকে শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে হয়ে যায় দু'জনের।
সেদিন আকাশে স্বপ্নের মতোই পূর্ণিমা ছিল। ছিল তারাভরা রাত। দুটো মানব মানবী সমাজের, পরিবারের রক্ত চক্ষুর আড়ালের বাইরে বেরিয়ে এক বৃন্তে দু'টি ফুল হয়ে ফুঁটে উঠেছিল। অন্য আর দশটা বিয়ের মতো সানাইয়ের সুরে,ফুলেল শুভেচ্ছায় তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা হতে পারতো। আনন্দ আর খুশীতে অভিসিক্ত হতে পারতো তারা। কিন্তু সে ভাগ্য তাদের হয়নি। সেই মায়াবী পূর্ণিমার জোসনাতেও তাদের জন্য ফোঁটেনি কোন গোলাপ কিংবা কোনো রজনীগন্ধা। নিরাভরণ সাদামাটা ছিল তাদের ফুলশয্যার রাত। ফুলশয্যার রাতটি ফুলে ফুলে মিষ্টিময় না হলেও দু:খকে তারা জয় করেছিল। জয় করেছিল পাহাড়সম প্রেমকে। ঘুচিয়ে দিয়েছিল ধনী গরীবের পার্থক্যকে। গুড়িয়ে দিয়েছিল ধনী গরীবের অহংবোধ। দেখিয়ে দিয়েছিল প্রেম পরাভব মানে না। শরৎ চন্দ্রের কথাকে ভুল প্রমাণিত করে, ওরা দেখিয়ে দিয়েছিল বড়প্রেম শুধু দূরেই ঠেলেনা, কাছেও টানে।
৬.
শাহদাবের বিয়ের খবরটা চারিদিকে আগুনের মতো ছড়িয়ে পরে। এ বিয়েতে কেউ কেউ খুশী হয়। কেউ কেউ মন্দলোকের মতো উঠে পরে লাগে। কেউ কেউ যেমন ধরুন ক বলতে থাকেন,
---অছির বড়লোকের মেয়েকে ভাগিয়ে বিয়ে করেছে। ওর যোগ্যতা আছে নাকি ওই মেয়েকে বিয়ে করার ? ক্যামনে ভাগালো বড় লোকের মাইয়াডারে?
খ বলেন,
--আরে মিয়া, ফুসিলিয়ে ফাসলিয়েতো কতো কিছুইতো করা য়ায়। এটা সেইরাম কেস। বুজলেন না মিয়ারা ?
গ,ঘ,ঙ রা সবাই সায় দিয়ে বলে ওঠেন,
--ঠিকই কইছেন ব্রাদার। হো হো করে হাসেন সবাই।
আর অন্যদিকে নানান কথা বাতাসে উড়িয়ে দেয় দূর্জনেরা । সারা ঢাকায় চাউর হয়ে যায়, টপ অব দ্যা টাউন হয়ে ওঠে শাহদাব সালমার বিয়ের কথা। হিংসুটেরা এ বিয়েকে বাঁকা চোখে দেখতে থাকেন। মেনে নিতে কষ্ট হয় তাদের। এক কথায় দু'কথায় গ্রামে থাকা শাহদাবের মায়ের কাছে টেলিগ্রামের মতোই পৌঁছে যায় পুত্রের বিয়ের খবর । শাহদাবের গ্রাম্য এক মামা,ইনি অাবার গ্রামের বিডি মেম্বার। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ ধ্বজাধারি। সে শাহদাবের মা শাহানাকে গিয়ে বলেন,
--শুনছনি শাহানা, তোমার শাহদাবরে তো পুলিশে খুঁজতাছে !
-- মা শাহানা ভয় পেয়ে বলে,
--কেনো মিয়াভাই ? শাহদাব কী করেছে। পুলিশ কেনো তারে খুঁজছে ?
-- আরে তোমার পোলা বড়লোকের মাইয়ারে ভাগাইয়া বিয়া করছে। শুনো
নাই। শিল্পপতির মাইয়া। তারা কী ছাড়বো ? দিসে কেস দিয়া। মেয়ে ভাগানোর কেস।
--তাহলে, এখন কী হবে মিয়া ভাই ?
-- কী আর হইবে। জেল জরিমানা হইবে।
বারোশিকের ভাত খাওয়ন লাইগবে অার কী? কী দরকার ছিল বড় লোকের বেটিরে ভাগাইয়া বিয়া করার ? বামন হইয়া চাঁদে হাত দেয়ার ?
বলে লাঠিটা হাতে নিয়ে দ্রুত কলপাড়ের দিকে চলে যান তিনি। মা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। আল্লাহর কী কাম সেদিন দুপুরেই ঢাকা থেকে বাড়ি অাসেন মা শাহানার আরেক মামাতো ভাই মতিন মুন্সী। সে আবার শাহানাকে আস্বস্ত করে বলেন,
--বুজি,দুষ্টু লোকেরা কে কী বললো কান দিবেন না। শাহদাব খুব বড় ফ্যামিলিতে বিয়ে করেছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্প পরিবারের মেয়ে। সবাই একডাকে ওদের চিনে। মেয়ের বড় ভাই আবার আমার সহকর্মী। আমার হাবিব ব্যাঙ্কেই বড়পোস্টে চাকরী করে। শাহদাবের ব্যাপারে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে ছিল। আমি বলে দিয়েছি,
--শুনো মানিক,অছির আমার-ই ভাইগ্না। সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে। হয়তো টাকা পয়সার দিক থেকে তোমাদের মতো নয়। কিন্তু তারে ফেলে দিতে পারবানা। সে ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন অব ইস্ট পাকিস্তানের এমডি হামিদ উল্লাহ সাহেবের ভাইগ্না। বিক্রমপুরের পোলা। আশি টাকা তোলা। তারে ফেলবা ক্যামনে মিয়া ?
এসব শুনে মা কিছুটা শান্তনা পান। মা শাহানা শয্যাগত স্বামীকে সব খুলে বলেন। তিনি সব শুনে চুপ করে থাকেন। কিছু বলেন না। খুক খুক করে কেশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকেন।
৭.
এদিকে পরের দিন মা শাহানা দেখতে পান তার মেজ ছেলে শাহবাজ হুট করে বাড়ি এসেছে। শাহবাজর মাকে বলেন,
শাহদাবদার হাতে টাকা কড়ি নেই। কাল ঢাকার একটি হোটেলে শাহদাবদার শশুড় মসাই বিয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন মেয়ের । আজ-ই তাকে ঢাকা ফিরে যেতে হবে। দুলাভাই বাড়ি আছেন তার কাছ থেকে টাকা নিতেই শাহদাবদা তাকে পাঠিয়েছেন। দুলাভাই মানে,শাহদাবদার ভগ্নিপতি। সে ব্যবসায়ী লোক। অবস্থা সম্পন্ন। নেত্রকোনা থেকে অবসর কাটাতে গ্রামের বাড়ি এসেছেন। সেটা জানতেন শাহদাব।জানেন তারকাছে পাঠালে এই দুর্যোগ মহুর্তে কিছু টাকা হয়তো পাওয়া যাবে। তাই ভাই শাহবাজকে পাঠিয়েছেন টাকা নেয়ার জন্য। দুলা ভাইর বাড়িতে গিয়ে সব খুলে বলাতে বিয়েতে খরচের জন্য শ্যালক শাহবাজকে মোটা অঙ্কের একটা টাকা দিয়েদেন সংগে সংগে। সেদিন-ই শাহবাজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু সংগে জুটে যায় তার ছোট ভাই শাহতাফ। তার সখ সে তার নতুন ভাবীকে দেখবে। তাই সেও শাহবাজের সংগী হয়। বর্ষাকাল। তারা দ্রুতগামী একটা ছৈয়ানৌকায় শ্রীনগর লঞ্চঘাট পৌঁছে,সেখান থেকে লঞ্চে ঢাকায় ফিরেন রাতেই। বাসায় ফিরে শাহতাফ দেখেন তার নতুন ভাবী সাদামাটা একটা সূতি ছাপা শাড়ি পড়ে হাটু গুটিয়ে তাতে মুখ ঠেকিয়ে বসে আছেন খালাত বোন ফোয়ারা আপার রুমে। বউ বউ লাগছেনা তাকে। আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই লাগছে তাকে । কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়না। শুধু পরিচয় হয় মাত্র।
পরদিন বিকেলে মতিঝিলে অবস্থিত হোটেল পূর্বাণী সংলগ্ন পূর্বরাগে এক চা-চক্রের মাধ্যমে দু'পক্ষের বেশ কিছু আত্নীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের উপস্থিতে শাহদাব সালমার বিয়ে পরবর্তী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। পরদিন সিনে পত্রিকা চিত্রালীতে ফলাও করে শাহদাব সালমার বিয়ের খবর বের হয়। বড় করে ছাপা হয় দুজনের যুগল সাদা কালো ছবি।
সালমার পরিবার এ বিয়ে মেনে নিলেও পরবর্তীতে তারা অার সালমার সংগে যোগাযোগ রাখেনি। তেজী মেয়ে সালমাও আর বাবার বাড়ি ফিরে যায়নি। প্রাসাদ ছেড়ে বড় মগবাজারের শাহদাবের ভাড়া করা পর্ণকুটিরেই সালমার জীবন সুখে কেটে যেতে থাকে। তখন সময়টা ছিল উত্তাল উনসত্তর। সালমা শাহদাবের বিয়ের আগে আগে গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল ঢেউয়ে স্বৈরাচারি আয়ুব খানের পতন হয়ে গেছে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন