![]() |
দেনাপাওনা ও নিরুপমা : মৃদুল শ্রীমানী |
( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে পণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই )
নিরুপমার কথা বড্ডো মনে পড়ে। সেসব দিনে অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিত রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ। কত বয়স নিরুপমার? সেদিনের সমাজ বাস্তবতা মাথায় রাখলে জোর বারো তেরো। তার বেশি কি করে হবে? ওই বয়সেই বিয়ের পণের টাকা গুঁজতে না পারার "অপরাধে" বাবাকে নিজের শ্বশুর বাড়িতে হেয় হতে দেখে প্রাণ কেঁদেছে মেয়ের। তার বাবাকে যারা বিপন্ন করে দিল, সেই শ্বশুর শাশুড়িকে আপন ভাবতে পারেনি নিরুপমা।
মর্যাদাবোধ থাকলে পারাও যায় না। অন্যায় দেখবো, আর চুপ করে বসে তারিয়ে তারিয়ে ঘটমান অন্যায় উপভোগ করবো, এ কেবল বিকৃত অসুস্থ মনের লোকের পক্ষেই সম্ভব। নিরুপমা মেয়েটা ছিল স্বাভাবিক। সোজাসাপ্টা ধরণের। সংখ্যাগুরু যেদিকে, আমি বাপু ল্যাজ গুটিয়ে সেদিকেই, এমত বিচারবোধ নিরুপমার নয়। প্রকৃতি যে যেকোনো স্বাভাবিক মানুষকে বিচার ক্ষমতা দিয়েছেন। তার জ্ঞান বল ক্রিয়া স্বাভাবিক করে রেখেছেন। শুধু নিজের সেই স্বাভাবিকতাকে ধরে রাখতে হয়। তা রাখলেই শুভবোধ আপনি এসে বোধের দুয়োরে কড়া নাড়ে। তাকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনতে হয় না।
নিরুপমা সেই স্বাভাবিক শুভবোধ থেকেই পণজনিত অত্যাচারকে মেনে নিতে পারে নি। শ্বশুরবাড়িতে তাকে যে প্রহার করা হত, তা আদৌ নয়। কিন্তু চেষ্টিত উপেক্ষা অবহেলা করা হত। বাপের বাড়ি যেতে বাধা সৃষ্টি করা হত। এটাই মৌলিক অধিকারের ওপর আঘাত। তার বাবা মেয়ের "সম্মান" পুনঃপ্রতিষ্ঠার মানসে বসতবাড়ি হাতছাড়া করেই পণের বকেয়া টাকা যোগাড় করলেন। এতে যে তার নিজের পরিবার কতদূর বিপন্ন হয়ে পড়বে, নিরাশ্রয় হয়ে পথে বসবে, এই বিচারবোধ পর্যন্ত ঘুলিয়ে গেছিল বৃদ্ধের। নিরুপমা এই জায়গায় নিজের বাপকে সমালোচনা করেছে। বলেছে - টাকা যদি দাও, তাহলেই অপমান। আমি কি একটা টাকার থলি?
টাকা যে নিরুপমার শ্বশুরের আদৌ প্রয়োজন ছিল, তা কিন্তু নয়। তার বরও টাকা নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত ছিল না। কেবল নিরুপমার বাবা মনে মনে আদরিণী মেয়ের অযত্ন আর অবহেলা, মানসিক নির্যাতনের আশঙ্কা করে নিজেকে আর নিজের ছেলেদের পথে নামিয়ে টাকা যোগাড় করলেন।
কিন্তু মেয়ে কি বাঁচলো? না বাঁচুক, চন্দন কাঠের চিতা আর মণ মণ ঘি তো জুটলো।
হিন্দু গৃহবধূর সেই বা কম কি?
আশ্চর্য, দেশ স্বাধীন হয়েছে, হিন্দু গৃহবধূর উপর শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন থামল কই? দেনা পাওনার ফাঁসে হিন্দু সমাজ আজও পাক খাচ্ছে। মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ করেছে চন্দন কাঠের চিতা।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন