ছিন্ন বীণা : মৃদুল শ্রীমানী

ছিন্ন বীণা : মৃদুল শ্রীমানী
ছিন্ন বীণা : মৃদুল শ্রীমানী

আমি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক । বাড়ির কাছের স্কুলটিতে শিক্ষকতা পেয়ে গিয়ে আমি আর ফিরে তাকাই নি। বীণার সাথে যখন বিয়ে হোলো আমার তখন বাবা বলেছিল আপনাদের মেয়ের মতো আমাদের ছেলেও ঠিক একদিন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে মাস্টারি পেয়ে যাবে । আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেখেছিলেন আমাদের নিজেদের বাড়ি । বাড়ির লাগোয়া বেশ খানিকটা জমিতে সেগুণ আর মেহগণি গাছ । গুঁড়ি তাদের বেশ মোটা হয়ে গিয়েছে। 

বীণা ফিজিক্স পড়েছে । কিন্তু গান আর আবৃত্তিতেই ওর বেশি আগ্রহ । আমার বাবা মা যখন ওর সাথে আমায় একান্তে কথা বলতে দিলেন, তখন বীণা জানতে চেয়েছিল - আমার গান গাইতে ভালো লাগে। বিয়ের পর আমায় গাইতে দেবেন তো ?আমি হেসে বলেছিলাম - সে কি, দেখো আমার বন্ধুরা গান শুনতে চেয়ে তোমায় পাগল করে দেবে। বীণা বলেছিল, না না, সে রকম নয়, ভোরে উঠে আমি রেওয়াজ করি কি না ... আপনাদের হয়তো অসুবিধে হবে ...

আমি মনে মনে বলেছিলাম - বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর তোমায় ভোরে উঠতেই দেবো না । আমাদের বিয়ে হোলো । বিয়ের পর আমি বন্ধুদের আমার বাড়ি আসা একেবারে বন্ধ করে দিলাম। কেননা, ওরা বীণার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকতো। আরে এত হাঁ করে দেখার আছে টা কি?

আসতো আমার একটি মাসতুতো ভাই । সে বেচারার বুদ্ধি শুদ্ধি কম। পড়াশুনাও করতে পারে নি সে জন্যে। মাসি সন্দেহ করে খুব ছোটবেলায় পাঁচের বাড়িতে কারো হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। ভয়ে সে বলে নি । চিকিৎসা হলে ছেলেটার পড়াশুনা হতো বলে মাসি আপসোস করে। বলে তোর মতো মাস্টারি না পাক, নিদেন পক্ষে কি কেরানিও হতে পারতো না! দেখতে শুনতে তো ছেলে আমার খারাপ নয়! তা ঠিক, ভাইটি আমার ভারি চমৎকার দেখতে। আমার বিয়ের পর আমার সেই ভাই আমার বউয়ের পায়ে পায়ে ঘোরে। আমি বীণাকে বললাম - ভাইকে নিয়ে ভেবো না । ও দেখতেই যা বড়ো। আসলে ওর বোধবুদ্ধি একেবারে ছেলেমানুষের মতো । পরে আমি কখনো কখনো দেখেছি ভাই আমার বীণার চুল বেঁধে দিয়েছে, ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে পয়সা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে চুলের ক্লিপ কিনে এনেছে।

বীণাকে বলেছিলাম ফ্ল্যাট কিনবো । বীণা শ্বশুর শ্বাশুড়িকে ছেড়ে যেতে চায় নি। বলেছিল - জ্ঞাতিরা আছেন, আত্মীয় কুটুম্বিতা রয়েছে । আমরা চলে গেলে বাবা মা সামলাবেন কি করে। আমি মুখ গোঁজ করে থাকতুম। বাবা মা বেশিদিন টিকলেন না । তখন বীণার বুদ্ধিতে আমাদের বাড়িতে প্রোমোটিং করিয়ে বেশ বড়োসড়ো একটা ফ্ল্যাট আর নগদ টাকা পেয়ে গেলাম। আমার স্কুল ছুটি হতো তাড়াতাড়ি । বীণারটা খানিক দূরে। বাস বদলাতে হয়। সময় লাগে। কাজের মেয়ে আমায় চা ধরে দেয় । আমি টিভি দেখি, কাগজ নাড়ি চাড়ি । তারপর বীণা এলে আমার আর ভালো লাগে না। ক্লাবে চলে গিয়ে ক্যারম পিটি। ফিরে এসে দেখি বীণা গানের রেওয়াজে বসেছিল ।
 
একদিন বীণার একটু দেরি হতে আমি জানতে চাইলাম - তোমার দেরি হোলো যে? ও হেসে বললো - এই একটু কাজ ছিল। কি রাজকার্য জানতে পারি? বীণা হাসল। সে ভারি সামান্য ব্যাপার। শুনলে তুমি হাসবে।
আমার হাসি পেল না। আমি খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম বীণা স্কুলে সায়েন্স একজিবিশন করবে বলে ছেলে মেয়েদের তালিম দিচ্ছে । কিন্তু বীণা আমায় এ কথাটা বলল না কেন? আমি প্রাইমারি মাস্টার বলে বীণা কি ভাবছে আমি বিজ্ঞানের কি কিছুই বুঝি না? আমার রাগ হোলো। একজিবিশন মিটে গেলেও বীণার তাড়াতাড়ি ফেরার নাম নেই । আমি খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম বীণা স্কুলে বাড়তি ক্লাস নিচ্ছে। আমার আরো রাগ হোলো। বীণা আমি তোমায় বিয়ে করেছি তোমার সঙ্গ পাবো বলে । ফ্যা ফ্যা করে রাস্তায় ঘুরবো বলে তোমায় বিয়ে করি নি।

বীণা কোনো জবাব দিল না দেখে আমি জানতে চাইলাম - কোচিং ক্লাশে পড়াতে ভালো লাগে তোমার? বীণা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি টেনে এনে বলল - গাঁ ঘরের গরিব ছেলেরা বিজ্ঞানের আইডিয়া গুলো পেয়ে নিজে নিজে চিন্তা করতে শিখে গেলে সমাজটা বদলে যাবে। বীণাটা পাগল। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখে। আমি ওর নাইটির একটা সাইড দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিই। কয়দিনই চোখে পড়েছে ওর নাইটির ওখানটা সেলাই খুলে গিয়েছে। মহারাণী সেলাই করার সময় পাননি। একদিন একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে হাজির। কে এটা ?

জানো, ওর মা ওকে ফেলে গিয়েছে। আমি ওকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করবো। তুমি জানো এসবের ঝক্কি কেমন? মিনতি করে বীণা বললো - লক্ষ্মীটি , তুমি অমত কোরো না। আমার বাবা মা ওর জন্যে দু লাখ টাকা ফিক্সড করে দেবে বলেছে। তোমার টাকায় হাত পড়বে না। আমি তো জানি বীণার বেতন হয় ব্যাঙ্কে , আর তার পাশ বই চেক বই সব গচ্ছিত থাকে আমার কাছে। আমি তাকে যেটুকু হাতখরচ দিই তাতে সে চালিয়ে নেয়। নতুন নাইটি কিনে দিই নি বলে অভিযোগ পর্যন্ত করে নি। বীণা কি ভাবে আমি একটা কঞ্জুস ?
 
যাই হোক, ওকে কিন্তু আমাদের বিছানায় শুতে দেব না। না না , বাবা ওর জন্যে একটা সিঙ্গল খাট দেবে বলেছে। খাট। সিঙ্গল? কোথায় রাখবে? আমার বেডরুম আমি শেয়ার করবো না। না না, মেয়েকে নিয়ে আমি পড়ার ঘরে শোবো । বললাম, তোমার কষ্ট হবে। আমার বলতে বাধল যে, তার শরীরটা রাতে আমার প্রয়োজন হয়। এভাবেই কাটছিল। বীণা শুচ্ছিল মেয়ের কাছে। মেয়ে ঘুমোলে বীণা আমাদের খাটের এককোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকত । স্কুলে যাবার সময় মেয়েকে নিয়ে যেত আর ফিরতো ফ্রি কোচিং সেরে।

আমি কয়েক প্রস্থ ক্যারম সেরে তাস ধরতাম। কখনো মোড়ের মাথায় গিয়ে লোকজনের চলাচল দেখতাম।
আজ বীণার যেন খুব বেশি দেরি হচ্ছে। কি জানি আর কারো সঙ্গে ... খুব তেতো লাগল মুখে ভেতরটা । কবার থুতু ফেলেও পরিষ্কার হলাম না। দেখলাম একজন মজবুত চেহারার লোকের সাথে বীণা আর তার মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে । মাথায় খুন চেপে গেল । আজ ওদের দফা রফা করবো । আজ বীণা চাবি নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে। থাকুক বন্ধ দরজার সামনে হা পিত্যেশ করে বসে। ফিরে দেখলাম আমার মাসতুতো ভাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে । জানতে চাইলাম - তুই এখানে?

স্কুল থেকে ফেরার সময় বৌদি আমায় দেখতে পেয়েছিল। বলেছিল - আমার মেয়ে হয়েছে , চল তোকে মিষ্টি খাওয়াবো। বাড়ি এসে দেখি তুমি নেই। দরজার বাইরে ওরা বসে আছে তোমার মুখ চেয়ে। আমায় খাওয়াতে পারলো না বলে দ্যাখো আমায় পঞ্চাশটা টাকা দিয়েছে । বৌদির ব্যাগে আর টাকা নেই। তুই নিলি টাকা? না নিলে বৌদি দুঃখ পাবে। তাই নিতে হল। ওকে পিছনে ফেলে আমি দ্রুত ওপরে গেলাম। দরজার গোড়ায় চোখ বন্ধ করে বীণা বসে আছে । জল গড়িয়ে পড়ছে বন্ধ চোখের পাতা গলে। দামি পালিশ করা বন্ধ দরজায় একটা শয়তানের চেহারা দেখতে পেলাম ।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.