আদুরে আলাপ : পিনাকী চৌধুরী

আদুরে আলাপ : পিনাকী চৌধুরী 
আদুরে আলাপ : পিনাকী চৌধুরী 
 
 
 নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে এই তমাল, কিন্তু পরিবারের তিনজন সদস্যদের কিন্তু এলাকায় একটা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বজায় ছিল ! সামান্য বেতনের এক স্কুল শিক্ষক ছিলেন তমালের বাবা অলোকেশ শতপথি ! অবসর গ্রহণের পরে তিনি বেশ কিছু দিন সংসার প্রতিপালেনের জন্য গৃহশিক্ষকতা করেছিলেন। নিপাট ভদ্রলোক , রোজ সকালে ধুতি আর বাংলা শার্ট পরে থলি হাতে নিয়ে বাজারে যেতেন ! আর তমালও সামান্য আয়ের একটা চাকরি করে ! তার মা সারাটাদিন সেলাইয়ের কাজ করে দু'টো পয়সা উপার্জন করেন , যাতে আটপৌরে সংসারটা কোনোরকমে চলে যায় ! ক্রমে ক্রমে বয়সের ভারে কিছুটা জর্জরিত হয়ে রোগগ্রস্ত হলেন অলোকেশ শতপথি ! তাঁর হাঁটা চলাও কিছুটা শ্লথগতির হয়ে গেল । অবশেষে তিনি শয্যাশায়ী হলেন ! অনেক ডাক্তার বদ্যি করেও তেমন কিছু সাড়া মিললো না ! স্বাভাবিক কারণেই তমাল আর তার মায়ের দুশ্চিন্তার যেন অন্ত নেই ! 
 
সর্বদাই তাদের যেন উৎকন্ঠা গ্রাস করলো । দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী অলোকেশ বাবুর সারা দেহে ঘা দেখা দিলো ! কথাবার্তা বলাও প্রায় বন্ধ !  নার্সিং হোমেও অলোকেশ বাবুকে ভর্তি করবার সামর্থ্য নেই তমালের !এহেন অসহনীয় পরিস্থিতিতে কিছুটা বাধ্য হয়েই তমাল স্থানীয় এক নার্সিং হোম থেকে একজন নার্সকে নিয়ে আসে ! তবে সর্বক্ষণের জন্য নয় , শুধুমাত্র অলোকেশ বাবুর দেহের ড্রেসিং করেই সেই নার্স চলে যেতেন । আর কুড়ি , বাইশ দিন অন্তর ক্যাথিটার পাল্টানোই ছিল সেই নার্সের কাজ ! তবে মিতা নামের ওই নার্সের টাকার খাঁই টা ছিল বেশ ছিল ! কিন্তু কিছু করবার নেই ! পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে নিতান্তই বাধ্য হয়েই অনেক কষ্টে সেই টাকাটা জোগাড় করে তমাল মিতার হাতে তুলে দিতো । তবে হ্যাঁ, এই মিতার ব্যবহারটা ছিল অমায়িক ! কিছুটা গায়ে পড়া মেয়ে মিতা ক্রমে ক্রমে তমালদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠলেন ! আর তমাল ও তার মা এই মিতাকে খুবই বিশ্বস্ত মনে করতেন ! আর অলোকেশ বাবু মিতাকে লেডি ডাক্তার বলে সম্বোধন করতেন। 
 
মিতাও কখন যেন সবার অলক্ষ্যে তমালকে গোপনে গোপনে ভালোবেসে ফেলেছিল ! তমালকে নিজের পরিবারের অনেক ব্যক্তিগত কথা বলে যেন মিতা শান্তি পেতো !আর তমাল মুখে কিছু না বললেও মিতাকে বেশ পছন্দ করতো ! তমলের ঘরের কোথায় কি থাকে, এমনকি টাকার ব্যাগটিও কোথায় থাকে, তাও কিন্তু মিতা জানতো ! একদিন মিতা তমালকে বলে " আচ্ছা, তমাল দা, আপনাদের এই বাড়িটা বেশ পুরোনো, তাইনা ? আর প্রতিটি ঘরের দরজা গুলোও কিছুটা মান্ধাতার আমলের "! তমাল স্মিত হেসে উত্তর দেয় " হ্যাঁ, আমাদের এই বাড়িটা অনেক দিনের পুরোনো ! আর ঘরের দরজা থাকাটাইতো তো সব নয় , চৌকাঠটা উঁচু যেন না হয় ! আরে বাবা, মনের দরজা জানালা খুলে রাখাটাইতো উচিত "! কথাটা শুনে মিতা মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ! আর মিতা যখনই অলোকেশ বাবুর ড্রেসিং করতো, তমালও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতো । একবার সেই ড্রেসিং চলাকালীন সময়ে মিতার একটি ফোন কল আসে, হাতে তখন মিতা গ্লাভস পরে রয়েছে, তাই স্বাভাবিক ভাবেই সে বলে " তমাল দা, আমার ব্যাগ থেকে স্মার্টফোন টা বের করে একটু আমার কানে ধরবেন প্লিজ "! 
 
তমাল তৎক্ষণাৎ ফোনটা রিসিভ করে মিতার পাশে দাঁড়িয়ে তার কানে ধরে, আর মিতাও দিব্যি ফোনে কথা বলে যায় ! ওদিকে অলোকেশ বাবুর সারা দেহের ঘা গুলো কিছুটা কমলেও, সার্বিক ভাবে অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে যায় ! অবশেষে একদিন প্রবল হেঁচকি তুলতে তুলতে অলোকেশ শতপথি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ! বাড়িতে তখন শোকের ছায়া । মৃত্যুর পরের দিন মিতা এসে শোকজ্ঞাপন করে রীতিমত কাঁদতে কাঁদতে বলল " আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, মেশোমশাই আর বেশি দিন নেই ! কিন্তু আপনাদের কিছু বলিনি । " যাবার সময় চোখ ছলছল করে ওঠে মিতার , কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে " তমাল দা, যোগাযোগটা রাখবেন কিন্তু । অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবেন !" তারপর অলোকেশ বাবুর শ্রাদ্ধ শান্তির প্রায় দিন পনেরো পরে একদিন তমাল হোয়াটস অ্যাপে মিতাকে ম্যাসেজ করে " অনেক দিন কোনো যোগাযোগ নেই, কেমন আছেন মিতা ?" কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি তমাল । তারও প্রায় দিন দশেক পরে একদিন তমাল হঠাৎ লক্ষ্য করে যে , মিতা হোয়াটস অ্যাপে তাকে রীতিমতো ব্লক করে দিয়েছে ! তমাল আর নিজেকে সামলাতে পারেনা ‌। 
 
সরাসরি তাকে এস এম এস করে " ছিঃ! এই ছিল আপনার মনে ! মিতা, আপনাকে আমি সম্মান দিয়ে, বিশ্বাস করেছিলাম । আর তার রিটার্ন আপনি ...."!  তার বেশ কিছু সময় পরে অবশেষে মিতা নিজেই তমাল কে ফোন করে " হ্যাঁ, তমালদা , আপনার ম্যাসেজ গুলো এখন দেখলাম । আমার সঙ্গে তো তমাল দা'র সেই সম্পর্ক নয় ! কি জানি, আমার বোনের মেয়ে বোধহয় ভুল করে কিছু করে ফেলেছে। দেখি, একবার দোকানে ফোনটা সময় করে নিয়ে যেতে হবে "! তমাল কথাগুলো শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয় । মিতা ফোনে বলতে থাকে " জানেন তমাল দা, আমার ওইসব বিশেষ দিনে ডিউটি করতে যে কি অসুবিধা হয় ! " এইরকম ভাবে প্রায় তিরিশ মিনিট ধরে মিতা তার চূড়ান্ত ব্যক্তিগত কথা তমালকে ফোনে বলতে থাকে ! আর কথার মাঝে মিতা বলে " তমাল দা, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো ?" মিতার প্রতিটি কথায় যেন তখন ঝরে পড়ছিল ভালোবাসার তীব্র আর্তি ! কিন্তু শেষমেশ মিতা খুবই শান্ত স্বরে বলে " তমাল দা, আমার নিজের দাদা কিন্তু মোটেও ভালো নয় । 
 
আমার অন্য এক জায়গায় বিয়ের ঠিক হয়েছে !  " কথাগুলো শুনে তমাল ফোন অন করা অবস্থাতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে ! বাচ্চা ছেলের মতন তমাল বলে " মিতা , আপনি কি শুধুই কাঁদাতে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে ?" এইবলে তমাল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা কেটে দেয় । তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর ! তমাল আর বিয়ে করে নি, চুলে পাক ধরেছে । ওদিকে মিতার তখন স্বামী ও এক মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার । অবশেষে আবার সব হিসেব নিকেষ যেন গুলিয়ে গেল । চৌরাস্তার মোড়ে হঠাৎই একদিন আবার মুখোমুখি দেখা তমাল ও মিতার ! কিন্তু একি ! 
 
মিতা একটা শতচ্ছিন্ন সালোয়ার কামিজ পড়ে হাতে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে ! অবাক হয়ে তাকিয়ে তমাল বলে " মিতা, আপনার এ কি অবস্থা ! কি হয়েছে ?" মিতা কাঁদতে শুরু করে , বলে " তমাল দা, জানি , আমি একসময় আপনাকে ঠকিয়েছিলাম ! আর তারই পরিণতিতে আমার আজ এই হাল ! জানেন তমাল দা, আমার মাতাল স্বামী রোজ রাতে আমাকে মারে ! আর বলে - তোকে আমি ওয়াটগঞ্জে একদিন বিক্রি করে আসবো ।" তমাল লক্ষ্য করে যে, মিতার চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে । সারা দেহেই সামান্য হলেও আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট ! মিতা বলে ওঠে " তমাল দা, আমি একদিন আপনাকে কাঁদিয়েছিলাম , আর তার দশ বছর পরে আমি হয়তো তাই কাঁদছি ! ভগবান আমাকে ক্ষমা করেনি তমাল দা ! আর আজ তাই আমি আমার এই ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে পথে নেমেছি ! আপনি একসময় আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, আর আমি সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করে , বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিলাম ! তাই শাস্তিতো আমাকে পেতেই হবে । মানুষের দীর্ঘশ্বাস ফেলা খুব খারাপ, খুব!".    
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.