কবিতার ঘর : মৃদুল শ্রীমানী

কবিতার ঘর : মৃদুল শ্রীমানী
কবিতার ঘর : মৃদুল শ্রীমানী

আমি তখন উত্তরবঙ্গের সীমান্ত শহরটিতে কাজ করি।  যে বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল, সেখানে আগে থাকতেই ঘরোয়া কাজ করতেন মলিনা দিদি। আমার খাওয়ার ভার ছিল বাড়িওয়ালার পরে। আর আমার জামাকাপড় কাচার কাজ আমি সেই ছোটবেলা থেকেই করতে ভালবাসি। ঘর মোছার কাজটাও আমার অত্যন্ত প্রিয়। তাই ঠিক করেছি কাজের লোকের কোনো প্রয়োজন নেই। সে কথা শুনে মলিনা দিদির চোখে জল। সে এখন নতুন কাজ পাবে কোথায়। তা ছাড়া সরকারী চাকুরেদের কাছ থেকে নিয়মিত মাইনে পাবার সুবিধা। তার মিনতিতে আমি তাকে রাখতে বাধ্য হলাম। কিন্তু কড়া হুকুম দিলাম, সে যেন কদাচ আমার অন্তর্বাস না কাচে। 

তো মলিনা দি মন দিয়ে কাজ করে। একদিন আমায় বললো "দাদা, আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে।" শুনে তো আমি প্রমাদ গুণলাম। "কি আশ্চর্য , কেন বলো তো ? মলিনা দি বললো " আপনি কি চমৎকার কবিতা পড়েন যে। আমার ভাল লাগে।"
তাই? বলো দেখি কোন লাইনটা মনে আছে তোমার?
অমনি গড় গড় করে বলে দিল " ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া, পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।"
আমি তো হাঁ ।
দিদি, ছেলে বড়ো হয়ে গেলে তোমার আর কষ্ট থাকবে না দেখো।
হ্যাঁ, আমার ছেলে তোমার মতো ডাবলু বি সি এস পরীক্ষা দিচ্ছে জানো?
তাই। বেশ ভাল। তা ছেলেকে আপাতত একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে ছুটি দিতে বলো তোমায়।
"সে ছেলে কি মায়ের মুখ চায়!" শুকনো মুখে তাকায় মলিনা দিদি।
কেন মলিনা দি, কি হয়েছে?
দেখো না, সতের হাজার টাকা দিয়ে কম্পিউটার কোর্স এ ভর্তি হল এই সেদিন। দু দিন গিয়ে, তিন দিনের দিন আর যেতে চায় না। বলে কম্পিউটারের মাস্টার কিছু জানে না।
রাগ হল। গরিব বিধবা মায়ের পরের বাড়ি গতরে খাটা টাকা এভাবে অপব্যয়! নাঃ, ছেলেটাকে একটু শাসন করতে হয়!
অফিস যাবার সময় মলিনা দি কে বললাম, দিদি, তোমার ছেলেকে আমার কাছে কাল সকালে একটু আসতে বোলো তো।
এল ছেলেটি। বেশ লম্বা সুন্দর চেহারার ছেলে। গায়ে বেশ ভাল সুরভি মেখেছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, বাঃ, বেশ সুগন্ধ তো ? কোন ব্র্যান্ড?
নাম বললো ছেলে। বেশ দামি পারফিউম । বিজ্ঞাপনে চোখে পড়ে।
আর মনে পড়ে আমি এমন পারফিউম কেনার সাহস করি না। জোর করে মানসী কখনো কখনো কিনে দেন নি, তা নয়। তবে অভ্যাসে পরিণত হয় নি। পকেটে কুলায় নি আর কি!
ছেলে হেসে বলে আপনি ডাবলু বি সি এস এ সি গ্রুপ পেয়ে রেভিনিউ অফিসার হয়েছিলেন না?
হ্যাঁ ।
সে নাক সিটকে বলে "আমি হলে এ চাকরি নিতাম না।"
মরিয়া হয়ে বলি, ভাগ্নে, মাকে এই কাজ থেকে মুক্তি দাও।
ছেলে হাসে। ভারি উচ্চাঙ্গের হাসি।
আমার বদলির চাকরি। কয়েক দিন পরে আমার নতুন জায়গায় বদলি হলে খবর পাই মলিনা দি'র ছেলে ডাবলু বি সি এস এ "এ" গ্রুপ পেয়ে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের সেরা চাকরিতে যোগদান করেছে। আর নিজের শহরেই একটি সুদর্শনা কে বিয়ে করেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে জামাইকে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে।
মলিনা দি অবশ্য সেই কাজই করে চলেছে। যা সে আমার কাছে করতো। জানি না, এখন কেউ আর সে ঘরে কবিতা পড়ে কি না।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.