রুদ্রসাগর কুন্ডু |
কবি, কবিতা ও একটি সমীক্ষা
কবিতা সাহিত্যকে কতটা সমৃদ্ধ করেছে, এ কথা আজকাল প্রায়ই উঠছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে কবিতা একটি জনপ্রিয় অধ্যায়। ছাত্রজীবনে বেশিরভাগ বাঙালি অন্ততপক্ষে একটি দুটি কবিতা লেখার চেষ্টা করে। পরবর্তী সময়ে সে যদি সাহিত্যের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে পারে, তাহলে সে হয়তোবা আরো অন্যান্য বিষয়ে লিখতে শুরু করে। কবিতা দিয়ে শুরু এবং এই কবিতা লেখার মাধ্যমে, শব্দ চয়ন, শব্দের মাধুর্য, ব্যঞ্জনা এবং সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে অনুভব করার প্রয়াস করে।
কবিতা আমার দৃষ্টিতে সাহিত্যের স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ। কবিতা লেখার মাধ্যমে ভাষার ব্যবহার বাক্য গঠনের সৌন্দর্য এবং বিষয়ের, ভাবের প্রকাশকে সমৃদ্ধ করা যায়। সাহিত্য রচনার জন্য ভাষার যে কলা-কৌশল জরুরি, তা আয়ত্ত করার জন্য কবিতা লেখা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা।
কবিতা লিখলে মনের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস জন্মায়। সেই বিশ্বাস থেকে মানব জীবনের অনেক সমৃদ্ধি আসে। পোশাকের বদল হয়। আচরণের বদল হয়। স্বভাবের বদল হয়। কবিতা লিখলে সাধারণত মানসিকতার দিক থেকে মানুষ বিনয়ী হয়। ব্যক্তির মানবিক গুণগুলো প্রস্ফুটিত হতে থাকে। শিল্পের মান ও গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের জীবনশৈলী, জীবনের গমন পথের দ্বান্দ্বিকতা, সমাজের অন্তর্নিহিত দুঃখ যন্ত্রণা ও ভাবগাম্ভীর্য অনুভব করা সহজ হয়। সমাজের গোপন আর্তনাদ এবং ঘটে যাওয়া বহু ঘটনাকে কবি খুবই আন্তরিক ভাবে তার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। এবং তার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে আর তার শিক্ষা ও জ্ঞানের সমষ্টিতে তা ব্যক্ত করার চেষ্টা করে।
প্রকাশিত কবিতা দেখে আমরা সচরাচর কবিকে পরিমাপ করার চেষ্টা করি। আমার ধারণা এই মাধ্যমটি অত্যন্ত ভুল। কেননা, একজন কবির মনের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি বা তার প্রকাশ করার ইচ্ছে গুলি, ভাষা জ্ঞানের অভাবে অনেক সময় হয়তো পরিপূর্ণতা পায় না। এই যে তার ভাষা সংক্রান্ত জটিলতা, ভাষার যে দারিদ্র, তার জন্য তার ভেতরকার অভিব্যক্তিকে শিল্পমন্ডিত করে তুলতে পারে না। সে হয়তো বাক্য বিন্যাসের চাতুর্য প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু তার ভেতরকার কবিত্ব এবং তার যে সংবেদনশীলতা, তা হয়তো তার মধ্যে পরিপূর্ণ ভাবে রয়েছে।
আমার সঙ্গে এমন অনেকের আলাপ রয়েছে, যাদের শব্দ ভান্ডার কম। বাক্য গঠনের অভিজ্ঞতা কম। প্রকাশভঙ্গির দুর্বলতা রয়েছে। শব্দের ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা, উপমা প্রয়োগবিধি, ছন্দজ্ঞান; এমনসব শৈল্পিক ধারার গতিবিধিতে তিনি অভ্যস্ত নন। কিন্তু মন মানসিকতা চাল চলন অভ্যাসে পরিপূর্ণ একজন কবি। কথাবার্তায়, পোশাকে কিন্তু সে কবি। পরিণত কবিতা প্রকাশ করতে পারছে না তার ভাষার দুর্বলতার জন্য। প্রকাশভঙ্গির দারিদ্র্যের জন্য। সে যা বলতে চায়, তাকে সে রূপ দিতে পারেনা। তাহলে আমরা তাকে কি বলবো? কি বলবো, আর কী বলবো না, সাধারণত এই ধরণের শক্ত প্রশ্নের উত্তরে আমরা সোজাসাপ্টা হ্যাঁ বা না বলে এড়িয়ে যেতেও পারবো না।
কবিতা একটি বিশেষ মুহূর্ত একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মানসিকতার সময় কে প্রকাশ করে। ব্যক্তির ভেতরে ঘটে যাওয়া তুমুল প্রতিক্রিয়ার একটি সুশৃংখল ভাষার বুননে শৈল্পিক প্রকাশকে আমরা কবিতা বলে জানি।
কবিতা শুরুতে শুরুতে খুব সহজ মনে হয়। তারপর যতই দিন যেতে থাকে, ততই আমাদের কাছে কবিতা লেখাটা একটা শক্ত কাজ বলে মনে হতে থাকে। তার কারণ হলো, কবিতার ভিতর নিজেকে সমর্পণ করে আমরা যেভাবে বিলীন হয়ে যাই, সেই একই গতিতে আমরা আমাদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হতে পারি না। আমাদের ভাষা জ্ঞানকে সমানভাবে উন্নত করতে পারিনা। তারই ফলশ্রুতিতে, আমাদের ভিতরকার ঘটে যাওয়া অনুভূতিকে আমরা কবিতায় পরিপূর্ণতা দিতে পারি না। বা শিল্প সম্মত ভাবে কবিতার একটি পরিণত রূপ প্রকাশ করতে পারি না।
অবশ্য সকলের জীবনে এমনটা ঘটে না। আমাদের বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক কবি আছেন, যারা মনের ভেতরের ঘটে যাওয়া কবিত্ব শক্তির সঙ্গে প্রকাশভঙ্গির শব্দভাণ্ডার ও ভাষাকে সমানভাবে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অন্যতম। পরবর্তী সময়ে যারা এই তালিকায় অমর হয়ে আছেন, তাদের নাম উল্লেখ করলে এই লেখাটি অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে।
এই যে তাল মিলিয়ে চলা অর্থাৎ ভেতরকার কবি শক্তি এবং বাইরের প্রকাশভঙ্গির যে শক্তির সমান অগ্রগতি, এটাকেই আমরা বলতে পারি একজন পরিপূর্ণ কবির বাস্তব রূপ। সে কারণে বলব কারো প্রকাশিত কবিতা পাঠ করে সব সময় তার ভেতরকার কবি কে চেনা নাও যেতে পারে।
বাউল সম্রাট লালন ফকিরের কথাই ভাবুন। উনি যদি বাংলা ভাষা সম্পর্কে একজন বিদগ্ধ পন্ডিত হতেন, সাহিত্যের কলাকৌশল শব্দের ব্যবহারের পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারতেন, সাহিত্য নির্মাণের সঙ্গতিপূর্ণ নির্মাণশৈলী জানতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গানের রচনা হয়তো তিনি করে যেতেন। আমার এই মতামতটি একান্তই ব্যক্তিগত। এর গুরুত্বও আপেক্ষিক। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ভেতরকার কবি শক্তির সঙ্গে বাইরের শিক্ষা ও জ্ঞানের সামঞ্জস্য থাকলে অনায়াসে, সাহিত্য রচনায় যে কোনও সাহিত্যিক অন্যতম হয়ে উঠতে পারেন।
কেননা, কাব্যিক চিন্তা চেতনা এবং জীবনের অন্তর্নিহিত ভাব ব্যঞ্জনা, মানব জীবনের কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর তিনি জানতেন। সামাজিক যন্ত্রণা, বৈষম্য ও সমাজ বিকাশের অন্তরায় সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা ছিল, তাকে তিনি তার ব্যবহারিক ভাষার মাধ্যমে বাউল গানের রূপরেখা প্রকাশ করেছেন। অথচ দেখুন, তাঁর রচিত গানগুলোর উপর বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছেন সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমি প্রকৃত অর্থে কি বলতে চাইছি।
আমি নিজেও আমার সাহিত্যচর্চার বিশ্লেষণ করলে, আমার বক্তব্যের হুবহু মিল পাই। ভেতরকার কবিসত্তাকে তখনই আমি উপযুক্ত ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম যখন আমি নিজেকে ভাষা জ্ঞান সম্পর্কে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলাম। ভেতরকার মানুষের সঙ্গে, প্রকাশের ভাষা ব্যবহারের সামঞ্জস্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত, আমরা তার সাহিত্য সৃষ্টি বা শিল্প নির্মাণ কে বিশ্লেষণ করে যে নির্ণয় নেওয়ার চেষ্টা করি; তা আসলে একটি ভুল প্রক্রিয়া। আর আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এটাই আমি বলতে চেয়েছি।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন