বাংলা সাহিত্যে পিতা : মৃদুল শ্রীমানী


মৃদুল শ্রীমানী
বাংলা সাহিত্যে পিতা

 বাংলা সাহিত্যে পিতা নিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচনা মনের মণিকোঠায় রাখা আছে। সেই যে সন্তান হতে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কি ভাষায় তাঁর পিতাকে খবর দিলেন, তা ভুলতে পারি না। এঁড়ে বাছুরটি যে ধরণের অভদ্র ও অসভ্য হয়ে উঠে পিতার হাতে মারধোর খেতেন, তাও মনে পড়ে। আর সেই গৃহস্বামিনী রাসমণি দেবী, যিনি বালককে পিতার হাতের মারধর থেকে বাঁচাতেন। রাসমণি দেবীর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করেই নাকি ঈশ্বর বালবিধবাদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠেছিলেন।
পিতাকে ঈশ্বর ভক্তি করতেন। কিন্তু তা যুক্তিবিহীন ভক্তি নয়। ঠাকুরদাস বিধবা বিবাহে পুত্রের উদ্যোগের বিপ্রতীপ ছিলেন বলে ঈশ্বর বলেছিলেন, আপনি মারা গেলে এ ব্যাপারে জোরকদমে লাগব। পিতৃভক্তি আর কারে কয়?
@
পিতার কথা গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। শুনেছি অসাধারণ শিল্প উদ্যোগী প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর দেবেন ঠাকুরের সাংসারিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার মধ্যে হিসেবি বুদ্ধি পর্যাপ্ত পরিমাণেই দেখতে পেয়েছিলেন। জমিদারির আয় যেভাবে দেবেন ঠাকুর বুঝে নিতেন নায়েব গোমস্তা ম্যানেজারদের কাছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথ পিতার সাথে হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ওই সূত্রে একটি অংশ একদা স্কুলপাঠ্য ছিল। পিতার কাছে আকাশের গ্রহ নক্ষত্র চেনা, খুচরো পয়সার বাক্স সামলানোর দায়িত্ব পাওয়া আর সোনার হাতঘড়িতে দম দেবার সুযোগ পাবার কথা মনোহারি ভঙ্গিতে লিখেছেন কবি। ট্রেন ভ্রমণে টিকেট চেকারের অভব্য ও ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের জবাব তাঁর পিতা যেভাবে দিয়েছিলেন, সেটা বালকের মনে চিরস্থায়ী হয়েছিল।
শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী সংগঠিত করা ছিল রবীন্দ্রজীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূৰ্ণ কাজ, সেই জমি সিংহবাবুদের থেকে কিনে নিয়ে দেবেন ঠাকুর একটি মহাজীবনের গোড়া পত্তন করে গিয়েছিলেন।
@
সাহিত্যে পিতার কথা বলবো, আর পথের পাঁচালীর হরিহর রায়ের কথা মনে পড়বে না, এ হতেই পারে না। শ্রীমান অপূর্ব রায়ের পিতা হরিহর। অপুর দিদি দুর্গা, মা সর্বজয়া, আর এক বৃদ্ধা সম্পর্কিত পিসি ইন্দির ঠাকরুণ। এই নিয়ে অভাবী সংসার। হরিহর ব্রাহ্মণ। সুতরাং খেটে খেতে পারেন না। জমি জমাও নেই, যে ভাগে চাষ করিয়ে আয় করবেন। নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের কাছ দিয়েই রেল লাইন গিয়েছে। এতটা কাছ দিয়ে যে বাচ্চারাও দৌড়ে গিয়ে দেখে আসতে পারে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষিতের কর্মসংস্থানের সুবিধা হয় নি। হরিহর অধ্যয়ন নিয়ে থাকেন। পুত্রের মধ্যে চারিয়ে দেন পড়ার আগ্রহ। অপু খুব জিজ্ঞাসু আর কল্পনাপ্রবণ। শিশুপাঠ্য রামায়ণ মহাভারত তার একেবারে হৃদয়স্থ। কল্পনার চোখে বালক কর্ণ আর অর্জুনের যুদ্ধ একা একাই কাঠি দিয়ে লড়ে। বিজ্ঞানের তথ্যেও অপুর আগ্রহ। টেলিগ্রাফের তারে যে খবর চালাচালি হয়, সে তথ্য তার জানা। সুতো দিয়ে সে টেলিগিরাপের তার টাঙ্গায় বাড়ির উঠোনে। শকুনির ডিম নিয়েও আগ্রহ তার। তা দিয়ে নাকি উড়বার সুবিধা হবে। একটা চমৎকার সংসার যেন ধ্বস্ত হতে থাকে। সে কি সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকট, না কি হরিহরের বিষয়মুখী জ্ঞানের অভাব, না কি, একটা নিয়তি। এক অসহায় পিতা হয়ে হরিহর কেবলি দুঃখ পেতে থাকেন।
@
পিতার কথা বলব আর শরৎ সাহিত্যের "মহেশ" গল্পের গফুরকে স্মরণ করব না, তা হতে পারে না। গফুরের ছিল একটা মেয়ে, আর একটা বলদ। মেয়ের নাম আমিনা, আর বলদের নাম ভারি ভালবেসে সে রেখেছিল মহেশ। ভারি দরিদ্র গফুর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যাঁতাকলে পড়ে হাঁসফাঁস করছিল। সুপ্রাচীন কাল থেকে গ্রামে গ্রামে কিছু জমি রাখা থাকত গোচর হিসেবে। গরিব গৃহস্থ, যারা পালিত গবাদি পশুকে যথেষ্ট খড় ভূষি জোগাতে পারে না, তারা ওই গোচর জমির উপর নির্ভর করত। সেখানকার ঘাসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করত মহেশের মত গরিব বাড়ির পশু। হিন্দু ধর্মশীল জমিদার দুর্নিবার লোভের বশে ওই গোচর জমিটুকুও বন্দোবস্ত দিয়ে দিলেন। এদিকে গফুর জোলার জমির খড় নেই। মহেশ খায় কি? মহেশ এখানে মুখ দিতে যায়, সেখানে মুখ দিতে যায়। তাতে প্রতিবেশীদের বিরক্তির কারণ হয়। সরকারি খোঁয়াড়ে আটক হয় অবোলা বলদ। তাকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে গফুর কষ্টে পড়ে। সারা গল্প জুড়ে এক গভীর সামাজিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গফুর জোলা হিন্দু ধর্মধ্বজী লোভী জমিদারের কোপের শিকার হয়েছে মহেশকে আগলাতে গিয়ে। ট্র্যাজেডি এই যে পুত্রের মত করে যে মহেশকে ভালবেসেছে সেই গফুরের হাতেই মৃত্যু হল বলদটির। তার পর প্রায়শ্চিত্তের নামে হিন্দু জমিদারের উৎপীড়ন এড়াতে মেয়ে আমিনার হাত ধরে গৃহত্যাগী হল গফুর। চলে যাবে শহরে। কাজ নেবে চটকলে, যেখানে কোনো আব্রু নেই। মহেশ গল্প জুড়ে গফুরের পিতৃহৃদয়ের অসহায়তা।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.