আমার লেখার উদ্দেশ্য : তৈমুর খান

তৈমুর খান
আমার লেখার উদ্দেশ্য

একা হয়ে যাই। উত্তর মেলে না। প্রতিবাদ করতে পারি না। বাহুবল নেই। নিজের গোপন কথা কার কাছে বলব ?
     এই সমাজনীতি, রাজনীতি, এই মানবনীতি আমাকে বিব্রত করে । মানতে পারি না এই প্রথাবদ্ধ চিরাচরিত ধর্মনীতিও । মানুষ কী মূল্য পায় এখানে ? কেন শুধু আমাকে 'মুসলমান' অথবা 'মুছুলমান' বলে ডাকে ওরা ? কেন আমি মানুষ নই ? কেন জাতের নামে , ধর্মের নামে আমাকে আলাদা করে দ্যাখে ? কেন আমার প্রণয়িনীকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে  ? 

        — এসবের উত্তর খুঁজতেই আমাকে লিখতে হয় । আত্মখননে আত্মদহনে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে হয় । না , চাঁদ ফুল পাখি নয় । জীবনের মর্মে মর্মে যে হলাহল ওঠে — তা-ই আমার লেখার উৎস। একদিকে প্রতিবাদ, একদিকে ভালোবাসা — মানবজীবনের অস্তিত্ব ঘোষণায় বেজে ওঠে প্রতিটি শব্দ ।
          হ্যাঁ, একদিন আমার কৈশোর ছিল। দিনের পর দিন উপোস অথবা আধপেটা । ঘাসকাটা অথবা গোরুচরা । সারাদিন পর শুধু কচুশাক সেদ্ধ। পুঁইশাক সেদ্ধ। জলসেদ্ধ। জাউ। ছেঁড়া নজরুল জীবনী।   'বিদ্রোহী' কবিতার কয়েক লাইন।  বারবার মুখস্থ। দারিদ্রের কঠোর শাসন, বিদ্রোহের কঠিন শপথ আমাকে উন্মাদ করে তুলেছিল। তখন থেকেই কবিতা হয়েছে প্রতিবাদ। হাতিয়ার। বর্ধিষ্ণু হিন্দুমোড়লের বাড়িতে সারাদিন কর্মশ্রান্ত । রাত্রে গোয়াল ঘরে রাখা ফুটো থালায় একপাই মুড়ি  ।   নির্দিষ্ট কাপে এককাপ চা । খাওয়ার পরে পুকুরঘাট থেকে মেজে আনার আদেশ।  ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্ব। অবহেলা। অন্তরাত্মা তখন থেকেই ফুঁসে উঠেছে। নীরব গর্জন করেছে। কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি। কবিতা জানে সেই অভিমান। কবিতা জানে সেই নিভৃতে কেঁদে ফেলা । 

           এখনও কৈশোর এসে সামনে দাঁড়ায় । যৌবনকে ফালা ফালা করে। যে মেয়েটি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ফুল দিয়েছিল, যে মেয়েটি প্রথম চুমু খেয়েছিল বসন্তের বিকেলে , যে মেয়েটি কথা দিয়েছিল 'ফিরে আসবই' —এখনও আকাশে বাতাসে তার কথা শুনতে পাই। তার স্নিগ্ধ মুখ মনে পড়ে। সে আসতে পারেনি। সমাজ এসেছে। হাতে অস্ত্র নিয়ে, জাতের দোহাই দিয়ে। নিয়মের শৃঙ্খল নিয়ে। ভীরু মেয়েটির চোখ শুকিয়ে গেছে। মুখে শব্দ ফোটেনি। আজও সে নাড়া দেয় আমাকে। না লিখে পারি না ওকে। 

             কত দিন পৃথিবীতে জাত থাকবে  ? কত দিন মানুষ মন্দির মসজিদ নিয়ে লড়াই করবে  ? কত দিন এই রেষারেষির রাজনীতি ? ভোট উৎসব ? কত দিন গুজরাত, ধানতলা, বানতলা বিরাজ করবে ? এতটুকু স্বপ্ন দেখার জায়গা নেই ? মানুষকে মানুষ ভাববার অবকাশ নেই  ? মেধা মননকে মূল্য দেওয়া নেই ? এইভাবে জন্তুর মতো দিন কাটে । আমাদের অতীত ঐতিহ্য মুছে যায়। মুছে যায় মানবিক সম্পর্ক — ভ্রাতৃত্ব প্রেম ইতিহাস। বিচ্ছিন্ন দীর্ণ দীন হতে হতে আজ আমরা এক ধ্বংসাবশেষ হয়ে যাই। 

         না লিখে পারি না এসব। স্বপ্ন-মৃত্যুর দুর্দান্ত শোক আমাকে কাতর করে। হাসপাতালে ধর্ষিতা মেয়েটির কথা ভুলতে পারি না। স্টেশনে পাচার হওয়া মেয়েটির কান্না আমাকে ছুঁয়ে যায়। গরিব বোনটির শতচ্ছিন্ন শাড়ি আমাকে নির্ঘুম করে। গলাটিপে হত্যা করা পুকুরে ভেসে ওঠা মেয়েটিকে আমার মনে হয় একুশ শতকের চাঁদ। একদিকে যন্ত্রণার এই বিষাদ করুণ মুখ — বঞ্চনা পীড়ন ধর্ষণ মৃত্যু সব সময় আমাকে তাড়া করে ফেরে। অন্যদিকে আত্মজীবনীর ধূসর ছায়া কী মর্মান্তিক ক্ষয় আর হাহাকার জীবনযাপনে যে অপূর্ণতা নিয়ে আসে তারই নিহিত তাৎপর্য হয়ে ওঠে। যে অনুভূতি, যে বিবেকের কণ্ঠস্বর, যে স্বপ্নলব্ধ মূল্যায়ন আমার কৈশোর যৌবনে অর্জিত হয়েছে — স্বাভাবিকভাবেই তা আমার লেখায় প্রতিফলিত । এই অনুভূতি, এই বিবেক, এই স্বপ্নকে আমি ঘুমিয়ে রাখতে পারি না। তাই লিখতে হয়, তাই লিখি।
         আমার জ্বর লিখি।  আমার মৃত্যু লিখি। আমার বেঁচে ওঠা লিখি। আমার পুনর্জন্ম লিখি। আমার অতীত লিখি। আমার ভবিষ্যৎ লিখি। আমার মন খারাপ লিখি। আমার মন ভালো লিখি। আমার প্রেম লিখি। আমার বিরহ লিখি। আমার প্রতিবাদ লিখি। আমার নারী লিখি। আমার ব্যর্থতা লিখি। না লিখে পারি না এসব।

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.