চৈত্রের রোদ্দুরে গজানন হেঁটে যাচ্ছেন : চিরঞ্জীব হালদার


চিরঞ্জীব হালদার
চৈত্রের রোদ্দুরে গজানন হেঁটে যাচ্ছেন 
(আবহমান কবিতার ধারাবিবরনী)

এই প্রথম "ভ্রান্তি সন্ধক" কথাটা  চোখে পড়লো। বরংবলা ভালো দৃষ্টি আচ্ছন্ন হলো। আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারছিনা।গ্রন্থের দু'নম্বর পাতায় শব্দটা বেশ মোটা অক্ষরে লেখা। এই সাত সকালে আপনাদের বিরক্ত করছি এমন অপাংক্তেয় এক শব্দের কথা তুলে। যদি ভালবাসার সাথে  সজনেঘর বা বিড়াল ব্যাস সম্পর্কিত বোধ বিষয়ক গল্প বলি। আপনার রবিবারের সকাল মানে প্রিয় মুখ এর সামনে জম্পেস ধুমায়িত চা আর হাফ দামী বিস্কুট অথবা না শোনা সংবাদের প্রথম কুমারী পাতার গন্ধ। বা এই "সপ্তাহ কেমন যাবে"বা বিনোদন গোচের সংবাদে অত্মতুষ্টি খোঁজা। আর যাই হোক  আপনি যতই রসিক হোন ভালবাসার প্যানপ্যানানি শুন্তে চাইবেন না বরং সাপ্তাহিক বোকাবক্সের পুরানো গানের নস্টালজিয়ায় ভাসিয়ে দেবেন নিজেকে আর ভাববেন বাজারের সেরা কাতলার কানকো নিরীক্ষার কাজটা কেমন দেখিয়ে দেখিয়ে সম্পন্ন করবেন। 

শুন্য দশক ব'লে এক গালভারি বা গেরাম ভারি কথা চালু আছে, আপনি কি আমাল দেবেন। আচ্চা শুন্য
 দশকে লোকে কি বাজার থেকে লইট্টা মাছ কিনে বাড়ি আসেনি নাকি পর্দা ঢাকা রিক্সায় প্রেমিকার উষ্ণতা খোঁজেনি। নিথর সন্ধ্যায় বউ যখন পার্লার মুখী আপনি কি দেওয়াল কে জিজ্ঞেস করবেন আচ্ছা দেওয়াল আপনার প্রেমিকার নাম কি।) সেও কি আপনার মত নিরবিচ্ছিন্ন সাদা। আর পাঁচটা পাড়াতুতো বাড়ি টপকে প্রশ্রয়দাতার ছাদে আপনি অতর্কিতে আর্বিভুত হবেন লাটাই হাতে অলিখিত প্রেমিকার কাছে নায়ক সাজতে। যেখানে মেয়ে বেড়াল টা আপনার ঘুড়ি কে প্রেরণা জোগাবেন। আচ্ছা পাঠক আপনাকে জিজ্ঞেস করবো, সুদর্শন যুবক যখন বিড়ি টানে তখন তার প্রেমিকা অন্য কারো উপপ্রেমিকা হওয়ার ইচ্ছে পোষন করে।

আসলে প্রেম জীবনের এক ধারণা মাত্র। অরুণ কুমার দত্তের কবিতায় প্রেম আর অপ্রেমের দ্যোতনা এতো গূঢ় যে, মনে হয় আমাদের পূত কমলা মনস্কতা গুলো ঘনায়মান মিথ্যের প্রতিভু।
"আবার গর্জন শোনা যাচ্ছে নিতম্বের উপমা থেকে। শুরু হওয়ার পর বোঝা যায়নি অর্ধমৃত জোনাকির শরীরে একটা জড়ুল ছিলো। জড়ুল টিকে ফলভেবে কেহ তাকে ধারণ  করেছে। গলাধঃকরণ করেনি এই যা। যদিও শেষ মুহুর্তে আমি কোন শিকার বিষয়ক কোন কবিতা লখিনি।
শুধু এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে হৃদস্পন্দন
বিষয়ক পাঠ নিয়েছিলাম।"

আলোচ্য গ্রন্থ টি আমার স্বযাচিত উপস্থাপনা। তবে কোন লুজ বল  পরিচিত ভোলেভালা অরুণ বলে ছেড়ে দেবো না। না তাকে আলোচকের রুক্ষ আর কষা লালা থেকে দূরে রাখবো বা ব্যাঙাচির শিকারী সাপকে ময়াল বলে তোল্লাই দেবোনা। এই যে দলতন্ত্র মোসাহেবী "হ্যাঁ দাদা -না দাদা " র  খিদমদগার তত্ত্ব র কোন জায়গা নেই। কবি অরুণ কুমার দত্ত আজকাল ফেবুর কল্যানে দেখি দরাজ হাসি নিয়ে আজকাল এখানে ওখানে ছবি তুলছে। সেল্ফি হেলদি। কখনও সেরা আঁকিয়ের খেতাব এ ভূষিত হওয়ার ছবি ক্যামেরা বন্দী করছে। কবিতা টা লেখোনা বাবা রবীন্দ্রনাথ হতে সারাজীবন পড়ে আছে। বেড়াল আর সজনে গাছের ছবি অনেক  আঁকা যাবে।

আলোচ্য গ্রন্থের কবিতা গুলো২০১৯ এর বই মেলায় বের হলেও, ধারণা করা যায় অনেক আগের লেখা। কবিতার কথায় অরুণ জানিয়েছে  ৮-১০ বছর আগে লেখা। বইটির প্রকাশক "ইতিকথা" নাম -সজনেঘর ও ব্যাসবিড়াল। এক বর্ষনক্লান্ত বিকালে, অগ্রজ কবি শঙ্কর নাথ চক্রবর্তির টালা পার্কের ভদ্রাসনে তার আপাত লাজুক মুখশ্রীর সাথে দেখা ২০১৭ তে। তার অপ্রতিরোধ্য উপস্থাপনা তাকে চিহ্নিত করা ছিল কিছু ক্ষীন পত্রপত্রিকায়। তবে এই চেনা কি সঠিক, না বেঠিক,  তাও সন্দেহ ছিল-ই। জীবনানন্দ কি জানিতেন তিনি তিনিই।

অবশ্য শক্তির উত্থান থেকেই শক্তি। কিছু প্রকাশক আর কল্কাতা দাপানো বন্ধু  বেষ্টনীতে। অরুণ-এর সে ভাগ্য নেই। এই জানা কি স ম্পূর্ন, না, না-জানাটাই স্রেয়, কে শেষ কথা বলবে। পাঠক হিসেবে কাব্য পাঠক হিসাবে নবীনরা কোন দিশা দেখাবে বলে উদিত হচ্ছে কিনা,  এই আর্ত সন্ধান তার কবিতা পাঠের প্রথম দেখা থেকে সঞ্চারিত ছিল। এই সঞ্চারনা কতটা পুরিত হয় শেষমেশ, হয়কি?
এই সারমর্মে কত-জনা কবি থাকে আর কত-জনা খ্যাতিকামী অকবি, কে বলে দেবে।
এই গ্রন্থ পাঠে এমন কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। সেই অকবি, কবির তকমা আগলে রাখার হরেক প্রক্রিয়া চালু দেখি বাজারে। এমন বোঝার দায় কে বা বোধ করে। এই সব সত্যি কবিতা বোঝার সীমা আমার আলোচকের ভুমিকায় কতটা দিগন্তে লাট দেয়। এক সচেতন কাব্যপ্রয়াস এমন দ্যোতনা দিয়ে শুরু হলে, ভাবতে হয়, কবি অরুণকুমার দত্ত-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ কি ভাবাবে আর কেমন ভাবাবে।

রচনা কাল ২০১০-২০১৮.সূচিতে আটটি পর্ব। অদৃশ্য জলাভূমি থেকে মহেঞ্জোদরোর বাতাস। অরুণ দাঁড়িয়ে আছে এক পোষ্টমর্ডান বাতি স্তম্ভের নিচে  ধারালো আলো জড়ো করে। তা আপনাকে আলোকিত না করে পিছু হটবে না।
"আসল গল্পটা শুরু হচ্ছে না কিছুতেই! শুধু
কনসার্ট চলছে যুগ যুগ ধরে....."
কবিতাটি শেষ হ য় এক দীর্ঘ বাক্যের সমন্বয়ে। "অন্তত কোন রাওলাট পিতার অন্নদাপালিত সুরমাকে কথা দিয়ে
বলা বাহান্নপর্বের তুমিই ঋতু,সেমিঝুল মাটি পরে স্বরাটশাসিত এক্স".

সমগ্র কবিতার ভেতর এক দাঢ্য সময়ের কারুময় প্রতিভাস ও প্রান চিত্রময়তা। যা দুটো এক্সোটাইম পাখির অনুসঙ্গ বহন করে। যা অন্তরীক্ষ আর মাটির বির্মূর্ত অবয়ব ধর্মে ক্যালিপার্স মোমের পুড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে পাঠ এগিয়ে যাবে। প্রতি কবিতা আলাদা আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। এক একটি কবিতা অনুচ্চারিত স্বপ্নের দোসর। ভেবে দেখি গড় পাঠ আর নিবিষ্ট পাঠে মাঝ বরাবর কবিতা প্রেমী আটকে থাকবেন না। তিনি দু'পাতা পড়ার পর নির্ঘাত বই বন্ধ করে ঝিম  হয়ে ভাবতে থাকবেন কি পড়লাম কেন পড়লাম।

কোন কবি প্রথম কাব্য গ্রন্থে এত সফল স্যাটায়ারের ব্যবহারে সিদ্দি দেখাবেন তা ভেবে দেখার। উচ্চকিত নয় অথচ উপমান উপমেয়ের ব্যাবহারের স্তর ছাড়িয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ে অদৃশ্য ধর্মাবতারের বিচার কক্ষে।

"হে বিশালাক্ষি আমি আর তোমার আদরের বাপধন নই। হেইও বলে তুলে নেওয়ার পর আশমানও যেন ফেটে পড়ছেন চিৎকার প্রসব করছেন ধর্মাবতার। তার হিসির শব্দে  ধুয়ে যাচ্ছে তুলা দন্ড। অথচ আমি পলিটিক্স বুঝি না। একটা জড়ুল চিহ্ন সঙ্গে  করে এনেছি মাত্র।''
নিসর্গ কে আপনি হিসাবে সম্বোধন  বা আরশোলাকে তার বর্নময় কর্মফলের স্বীকৃতি স্বরূপ " আপনি "এক ভিন্ন ব্যবহারিক মাত্রা ছড়িয়েছে। তার অক্ষম তন্ময়তা দানা বাঁধে কোরকে কোরকে। খুপরিতে খুপরিতে।"..... আবার ও ঝুপুস বৃষ্টি নামে.....হৃদয়পুর থেকে হাঁটতে হাঁটতে হেঁটে
চললাম....."বিরতি বলতে বুঝি সিগ্রেট। এক ফর্সা জাদুকর মাঝে মাঝে ব্রহ্মান্ড থেকে চিৎকার করে ওঠেন। আমাকেও দু এক টান দিন ওই লোকটিও আমার মত ফেঁসে  গেছে।"

দেখা যাক ২১ পাতার শব্দরা কতটা ভেজাতে পারে
"বিনোদন খুঁজতে খুঁজতে প্রত্নতাত্বিকেরা আবিস্কৃত হচ্ছেন।এদিকে এক নভশ্চারী কে জিজ্ঞেস
করলাম আকাশে ঊড়তে উড়তে আপনি কতটা
আয়ত্ব করেছেন যৌনবিদ্যা"।
 
অনেক কাল পর মনে পড়ে গেল প্রথিত যশা এক কবি ইরাক ইরান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে দুই বায়ুযান কে আকাশে উড়তে দেখে সঙ্গম  আর বীর্য বর্ষনে অভিঘাত সফল মেলে ধরেছেন।আমাদের পুত চেত্নায় কামুকতার সফল শিল্পায়ন কবিতায়  জমাট বাঁধে।এই পর্বে অরুন মারাত্বক সফল আর সচেতন শব্দ চারণায়।


আমাদের অন্তসারহীন ভোগবাদিতায়,নশ্বর সম্পর্কের বহুমাত্রিক অক্ষর উদভাসে অরুনের কবিতা ঝিকির দিয়ে ওঠে" সমস্ত সাইবার যুদ্ধের পিছনে একটা ইদুর কেটে দিচ্ছেন জাল" আবার "আমার বিড়াল টিও আমাকে থাবা কাহিনির সিরিজ লিখে শোনাচ্ছে। ওহে কত কত রূপসী পতঙ্গ। তারপর কফি খেতে খেতে বিসেইসের কঙ্কাল পোর্টেট আঁকো। আর দু'জোড়া বিরতি বিষয়ক সিরিজ লিখে আমাকে শোনাও।"
এই অপূর্ব রিলিফ থিওরি তা তো জীবনানন্দের থেকে সফল ধার করা একদম নিগূঢ় খাতক। অরুন এক অ্যান্টিপয়েট্রি নির্মাণ করেন  তারপর।
এই মধ্য দুপুরে আমিও কি একিলিস। আর আমার সাইকেল চেপে হাওয়া হয়ে যাবে জোনাকী দিদিম নি".। এ এক পুরাণময়তা। তা এক আঁধার থেকে ছেনে নেওয়া  জোনাকী সঙ্গ।
 
পতঞ্জলী মেয়ে পর্বে লেখা.....
"উপপাদ্যে লেখা হলো শ্রমণ। মন্থনে যা উঠলো তা টল টল ক রছে যোনিতে। এসময় একজন মথই কেবল মাত্র বর্গযাত্রা করিতে পারেন"।
 এক অবিনস্বর শ্রমন স্বত্ত্বা থেকে প্রকৃতিপাঠে একমাত্র অবিভ্রমী কবিকে ফিরতে দেখা যায়। তখনও তার পূর্ন বিবেক অটুট, কালো কে কালো না বলে সময়ের নিরীখে আত্মনিদানের গল্প শোনান। তার দিকচিহ্নের সংশোধনাগারে জেগে থাকে "জলপাই জার্নাল" বা মহেঞ্জোদড়োর বাতাস"।
"এই এক বুধগাঁও। এখানে মশালধারীরাও উন্মাদ। এখানে নেপোর সম্রাজ্যবাদ। ইবনবতুতার নাতনী উলঙ হয়ে নাচেন। পারানীও ঈশ্বরী।
গদ্যের এক অদ্ভুত জাদুময়তা অরুণের কবিতার আশ্চর্য উপাদান। পাঠক কে ধরে রাখে।
" এবার ব্রইনকে ট্যাবু বলে ক্ষ্যাপালুম। তাহার সূচালো দাঁত। নাকের দু'পাশে ফোটানো হুল। জিভের উপর রূপোর পুঁতি বসানো। বললুম যাও
ব্রুইন তুমিও কালির মত জিভ কেটে হস্তিপৃষ্ঠে
পর্বত শিখরে আরোহন করো।"
আমাদের সব ট্যাবুগুলো বিবর্ন পাতার মত খসে যাবে আমরা তার অসহায় দর্শক মাত্র। খুব নিপুন শব্দ সন্ধানী না হলে এমন রূপবন্ধ নির্মাণ স ম্ভব নয়। যারাপারে তারা পারে। অরুণ সফল। তার এই অভিঘাত আমাদের অসহায় আর্তির মধ্যে ঠেলে দেয়। একজন নবীন কবি এর বেশী আর কিই বা করতে পারে। অরুণের কবিতায় কোন বিরতি নেই। তার বিরক্তিপ্রকাশ আমাদের থেমে যাওয়া শ্রম আকুল ঘুমকে না ভাঙিয়ে এক স্বপ্নেএ ইমারতের হাজারদুয়ারীতে ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ।
 
আমরা অপেক্ষায় তার পরবর্তী গ্রন্থের জন্য। আরো লেখা হবে, এক লক্ষ ঢোল ও করতালিপ্রস্তত রাখি।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.