ধরা যাক ‘পুরী সিরিজ’ কবিতার বইটির কথা। রচনাকাল ১৯৬২-১৯৬৪। প্রকাশ ১৯৬৪। গুটিকয় কবিতার একটা চটি বই। (কবেই বা তাঁর বই আকৃতিতে খুব মোটাসোটা ছিল বা আছে!) আমি এই বইটি প্রথম পড়ি, যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৬-৭৭ সালে। তার কিছু সময় আগে থেকেই, জীবনানন্দ সেরে এবং ছেড়ে পঞ্চাশের হু-হু রেল আমার মধ্যে চলেছে। একইসাথে যাপনের মিথ এবং তাঁদের কবিতার প্রচার-প্রসার, আলোড়ন মহানগরী ছাড়িয়ে মফস্বল বাংলাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কারো নাম না-করে এটুকু বলাই যায় তাঁদের অনেকেই একসময় তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করেও প্রতিষ্ঠানেই জুড়ে গিয়েছিলেন। কবি উৎপলকুমার বসু সেভাবে প্রতিষ্ঠানে জড়াননি, তাই তাঁকে পেতে হয়তো আমার কিছুটা দেরিই হয়েছিল। এই বইটা পড়ে সে-সময় আমার কী কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা আজ প্রায় তিরিশ বছর পর মনে করা সম্ভব নয়। আর সেসময়ে পাঠ-অভিজ্ঞতাই বা কতটুকু? কিন্তু এটা একটা ধারণা জন্মেছিল যে এই কবি অন্যরকম লেখেন, আর যাঁদের বেশি পড়েছি এতদিন, বেশি মাতামাতি, তাঁদের চেয়ে ইনি আলাদা। ঠিক মেলানো যায় না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে পাঠের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেছি ঠিক তখন থেকেই। আমার লেখা গদ্যে তিনি বেশ কয়েকবার এসেছেন উদ্ধৃতি সহ। (‘নতুনের সীমানা নতুনই ভাঙে’, ফেব্রুয়ারি ২০০৯; ‘আধুনিক বাংলা কবিতা ও আধুনিকতার পরে্’, মে-২০১৫; ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি’, আগষ্ট-২০১৫)। এখন এই সময় আবার তাঁর কয়েকটি কবিতার বইয়ের ওপর কথা বলতে গিয়ে সেই বইগুলির গভীর ও নিবিড় পুনর্পাঠ প্রয়োজন।
‘পুরী সিরিজ’ বইটির ‘উৎসর্গ’ কবিতাটিতেই ধরা পড়ে সেই বিচিত্রতার উদ্ভাস, আলাদা মননের চিহ্ন, ভাষাবয়নের ভিন্নতা, যেন ছোট্ট করে একটা বাঁক। পাঠকের কাছে পরিবেশন করার এক অন্যরকম ভঙ্গি। এর প্রথম পাঁচ পঙক্তি আর শেষ দুই পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে অগ্রসর হওয়াই সঠিক মনে করি।
“হস্তচালিত প্রাণ তাঁত সেই অধোজাগ্রত মেশিনলুম আমাদের হুর রে
‘বসন্তে এনেছি আমি হাবা যুবকের হাসি’
ছিল ভালোবাসা
ছিল অনিশ্চিত রেলডাক ছিল মেঘের তর্জন
ছিল আঠারো/উনিশ মাইল টিকিট অথচ বেড়ালাম অনেক অনেক অভিজ্ঞতা হল
----- ------ ----- ------ ------ ----- -----
আজ গন্ধক মেশানো জলে স্নান করে জেলঘুঘুদের আত্মা
আর কি চাইতে পারো কলকাতায় তাঁতকল ছাড়া তুমি চেয়েছ কবিতা”
এইরকম কবিতা সমসাময়িক আর কোনও কবির কাছে পাইনি আগে। ‘হাবা যুবকের হাসি’-টা কেমন, যা তিনি আমাদের জন্য এনেছেন? হাবার হাসি একেকজনের কাছে একেকরকম। দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে যার যেমন লাগে। সেই বিচিত্রতাই তিনি উৎসর্গ করতে চান পাঠককে। কবিতায় আগাপাশতলা কোনও টোটালিটি নেই। খণ্ড যেন। আপাত লিংক-লেস প্রতিটি ছত্র। ছবিগুলো ভাঙা, টুকরো-টাকরা, ভাব গঠিত হতে চেয়েও যেন পরের পঙ্ক্তির অনিশ্চয়তায় গঠিত হতে পারছে না। এবং এভাবেই কবিতার কিছু সুতো ছড়ানো, জালটি যেন তৈরি করে নেবেন পাঠক, তার মতো করে। শব্দ, শব্দ-বন্ধ, ও বসানোর কথা আসবে। ‘হস্তচালিত প্রাণ তাঁত’, ‘অধোজাগ্রত মেশিনলুম’, ‘হাবা যুবকের হাসি’, ‘অনিশ্চিত রেলডাক’ ‘আঠারো/উনিশ মাইল টিকিট’, ‘জেলঘুঘুদের আত্মা’ ইত্যাদি এটুকুর মধ্যে উল্লেখ্য। ‘হস্তচালিত’ না-লিখে অনায়াসে লেখা যেত ‘হাতেচালানো’, তিনি হস্তচালিতই ব্যবহার করেছেন। ‘প্রাণ তাঁত’। প্রাণ আর তাঁত সমার্থক যেন। লক্ষ্য করার বিষয় সাধু শব্দের পাশেই অনায়াসে জায়গা করে নিল চালু শব্দ। কিন্তু কোনও অসুবিধা সৃষ্টি করল না। না ভাবনা প্রয়োগের দিকে না শ্রাব্যতায়। ‘অধোজাগ্রত মেশিনলুম’-এও একই কথা। এখানে সাধুর পাশে বাংলায় চালু একটি ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। শব্দগ্রহণে বোঝা যাচ্ছে, কোনও ছুঁতমার্গতা নেই। আরও লক্ষ্য করার সাধু-শব্দটি আধাজাগ্রত নয়, অধোজাগ্রত। এমন ব্যবহার প্রচলের বাইরে। যেন মেশিনলুমটির নীচের দিকটা জাগ্রত। আধাজাগরণ নয়। খুব ছোট্ট কাজ, কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ‘অনিশ্চিত রেলডাক’। রেলডাক খুবই নতুন ধরণের প্রয়োগ। তায় অনিশ্চিত। ‘আঠারো/উনিশ মাইল টিকিট’। ইউনিট বা এককটা পালটে দেওয়া হল। যার প্রকাশ থাকার কথা ছিল অর্থের এককে, তা করে দেওয়া হলো দূরত্বের এককে। আর তাতেই ভাবনা এক ভিন্ন মাত্রা পেয়ে গেল। জেলঘুঘু শব্দটা কতই না প্রচলিত এবং ব্যবহৃত। কিন্তু তাদের আত্মা একটা বিমূর্ত চিন্তা। সেই আত্মা আবার স্নান করে। এইভাবে তাঁর কবিতায় এসেছে ভিন্ন উচ্চারণ। ভিন্ন মাত্রা, বহুমাত্রাও। কবিতার শেষ পঙ্ক্তিটি প্রনিধানযোগ্য। কলকাতায় আর কি চাইতে পারো, ‘তাঁতকল ছাড়া তুমি চেয়েছ কবিতা’। মনে তো করতেই পারি, তাঁতকল একটা এমন বয়নযন্ত্রের প্রতীক যাতে একঘেয়ে বা একইরকম কিছু যেমন বোনা যায় একটা নির্দিষ্ট চলনে, যেন পদ্য, আবার নানারকমের নক্সা ও কারুকাজও ফুটিয়ে তোলা যায় তাঁতীর পারঙ্গমতায়, যা কবিতা, যা চিন্তন বা ভাবনা, যা মুক্ত, স্বাধীন, ছাঁচছাড়া, নির্দিষ্টতায় না-ভোগা। অসীমযাত্রী। চাওয়া হচ্ছে বয়ন আর চিন্তন। অন্য কেউ অন্যরকম মনে করলে অন্তত আমার কিছু অসুবিধা নেই। উদ্ধৃত সাতটি পঙ্ক্তির একটু বেশিই কাটাছেঁড়া করা হলো, নিরুপায় হয়েই, যাতে এই বইয়ের কবিতার প্রাণভোমরাটি আবিষ্কার করতে আমরা ভুল না-করি। কেননা এমনই চিন্তা-চেতনায় আর বলনে-কথনে বইটি রচিত।"
![]() |
উমাপদ কর |
(স্বতন্ত্রতায় গন্ধক, এগিয়ে থাকায় ফসফরাসঃ কবি উৎপলকুমার বসু/ গদ্যাংশ/ প্রকাশিত ২০১৪/ প্রকাশিতব্য/ আবহমান পাঠঃ তেরো আকাশ/ উমাপদ কর।)
© উমাপদ কর
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন