বুনো টগর ও একটি আত্মহত্যা : সন্দীপ কুমার ঝা

সন্দীপ কুমার ঝা

বুনো টগর ও একটি আত্মহত্যা


"জীবনে দারিদ্র্য আছে,কিন্তু জীবন দরিদ্র নয়"।-বিভূতিভূষণের তুলনায় সে কতটা,পাল্লা দিতে পারে জানিনা।শুধু পথের দুধারে তখন,দিগন্ত ছুঁয়ে ছিল সোনামুখী ধান,উথাল পাথাল।শিশিরের ভারে নুয়ে থাকা ধানশীষ,সেই সকালে যেন আদর করছিল নিজেকেই।

সোনালী রঙের এই দৃশ‍্যটাকে চিরে দিয়ে,কালো পিচের পথটা,বটতলায় যেখানে হারিয়ে গেছে,ঠিক সেখানেই একটা থমথমে জটলা।
বাইকের চাকা থামল দু এক মিনিট।
লক্ষ‍্য করলাম,পুলিশ ভ‍্যানে তুলে নিচ্ছে একটা নিথর বৃদ্ধের দেহ।

আত্মহত্যা!

ওপাশে কিছুদূরে রাস্তার ধারে ভাঙা বাঁশের বেড়া।তারই ধার ঘেঁষে দাঁড়ানো,গুটিকয় গ্ৰাম‍্যরমণী।চোখে মুখে জমাট ভয়।ফিসফিস।শুনলাম- গলায় দড়ি।নীচু স্বরের সেইসব ভয়ার্ত আলোচনা,আর শুনিনি।

সব শেষের পর,আর বোধহয় শোনার কিছু থাকে না।

সে জটলার সঙ্গেই রমণীদের গায়ে গা দিয়ে  দাঁড়িয়েছিল এক কিশোরীও।পনেরো অথবা ষোল।উদাসীন,নিস্পৃহ।অবুঝ সারল‍্য,হীরের কুচি হয়ে জ্বলছে,শ‍্যামলা মুখের উপর।জীবনের যে অঙ্কটা তখন,আশেপাশে প্রবল ভাবে জ‍্যান্ত হয়ে উঠেছিল,সেই জটিল যোগ বিয়োগের সঙ্গে তার যেন কোনও সম্পর্ক নেই। সে যেন এ গ্ৰহের  নয়।এমনি হালকা,এমনই অসচেতন।

তার হাতের মুঠোয় তখন গোটাকয়েক,-সকালের টগর।ধবধবে-স্নিগ্ধ, নির্মল।অন‍্যদের সন্ত্রস্ত গল্পের পাশে,সে কিশোরীটি টগরগুলি একে একে গুঁজে দিচ্ছিল,পিঠ করে দাঁড়ানো,রমণীটির আলগা খোঁপার উপর।আনমনে একের পর এক।তারপর আবার..টগরের আলপণা তখন ফুটে উঠছিল খোঁপার চারপাশ জুড়ে!

মৃত্যু আর ঐ ভীত ফিসফিসের পাশে দাঁড়িয়েও সে যেন তাদেরকে দেখছিল না।একমনে দেখছিল কেবল খোঁপাটিকে।দেখছিল আর হাসছিল।সঙ্গে হেসে উঠছিল তার ফুলের বুননটিও।

আমিও দেখছিলাম।
যে দৃষ্টিতে মেয়েটি জীবনকে দেখছিল,আমি দেখছিলাম,তার সেই দূর্লভ ভঙ্গীটিকে।

আত্মহত‍্যার আগে পর্যন্ত লোকটি,যে ভঙ্গীটাকে খুঁজেই পায়নি।একগলা ভয়ের মধ‍্যে রমণীরা,হয়তো তখনও যাকে খুঁজছিল,খুঁজে খুঁজে মরছিল,আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সেটাকেই।

যদিও সেই আশ্চর্য জীবনদৃষ্টিটা দাঁড়িয়ে ছিল,ঠিক তাদেরই পেছনে।গায়ে গা ঠেকিয়ে-কয়েকটা বুনো টগরের সঙ্গে,একটা অবুঝ মুঠোর ভিতর...
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.