![]() |
রিনা মণ্ডল |
ছোটবেলা থেকেই ডাকাবুকো ও পরম সাহসী স্বভাবের মেয়ে পৌলমী।স্কুল কলেজে বা পাড়াপড়শিতে, কারো প্রতি কোন অন্যায় ,জুলুম, অবিচার দেখলেই গর্জে উঠে প্রতিবাদ করে সে। পড়াশোনা,নাচ গান, এমনকি খেলাধুলাতেও সে বেশ পারদর্শী । ঠিক যেন একটা রত্ন!
সামনেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই, প্রায়দিনই অনেক রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয় তাকে।শীতের রাত, অনেকটা বড়ো। তাই অনেকক্ষণ জেগে পড়লেও কষ্ট হয় না বিশেষ । তবে প্রত্যেকদিন সকাল সকাল উঠে, ফ্রেস হয়ে, কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাতটায় নিজের আর বাবা মায়ের জন্য বেডটি বানিয়ে , তারপর তাঁদের ঘুম থেকে ডেকে তোলে পৌলমী ।
রেলস্টেশনের কাছেই তাদের বাড়িটা। তাই ট্রেনের বাঁশির আওয়াজে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো রেবতীর। দেওয়ালের উল্টো দিকে টাঙানো ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই রেবতী দেখে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজতে চলেছে । অথচ এখনো পৌলমীর কোন সাড়াশব্দ নেই ।
-----আজ কী হলো পৌলমীর ? এখনো চা নিয়ে এলো না? তবে কি অসুস্থ হলো নাকি মেয়েটা? পাশে ঘুমন্ত কর্তাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলে, তাকে ঠেলা মেরে জাগিয়ে ধড়মড় করে লেপ ছেড়ে উঠে দরজা খুলে পৌলমীর ঘরের দিকে প্রায় দৌড়েই গেলো রেবতী । গিয়ে দেখলো ,তার ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। বাথরুমে, বারান্দায়,কি রান্নাঘরে কোথাও পৌলমীর কোন চিহ্নটুকু নেই!
তার পড়ার টেবিলে নজর পড়তেই রেবতী দেখলো, একটা বই চিৎ হয়ে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। সে যে পড়া অসমাপ্ত রেখেই কোথাও উঠে গেছে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ দোতলা থেকে তরতর করে নীচে নেমে এসে রেবতী দেখলো, সদর দরজাটাও হাট করে খোলা। আর পৌলমীর স্কুটিটাও নেই সিঁড়ির নীচে । রেবতী তো কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। ততক্ষণে রজতও তার পিছু নিয়ে নীচে নেমে এসেছে। হাতে তার নিজের আর পৌলমীর মোবাইলটা। রেবতী সেটা দেখেই বলে উঠলো, যাঃ! পৌলমী মোবাইলটাও ফেলে গেছে ? ফলে যা হবার তাই হলো । ফোন করে যে তার খবরাখবর নেওয়া যাবে, সে উপায়ও রইলো না । তাই দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ ।
এইভাবে কেটে গেলো আরো আধঘন্টা। রজতের প্রেসার ততক্ষণে বাড়তে শুরু করেছে। দরদর করে ঘামছে রেবতীও। আর মনে মনে একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরকে ডাকছে । ইতিমধ্যে, হঠাৎ রজতের মোবাইলটা বেজে উঠলো টুংটাং করে ।রেবতী ভাবলো, না জানি কি দুঃসংবাদ শুনতে হবে এবার ! রজত উত্তেজনায় কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা ধরে হ্যালো বলতেই, ওপার থেকে ভেসে এলো পৌলমীর কণ্ঠস্বর ,
------বাবা আমি থানা থেকে বলছি। আমি এখন এখানেই আছি। একটা বিশেষ দরকারে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। তোমাদের জানানোর কোন অবকাশ ছিলো না।
আমি এখনই বাড়ি যাচ্ছি। বাড়ি ফিরে গিয়ে সব বলবো তোমাদের । তোমরা একটুও চিন্তা কোরো না।
রজত ও রেবতী পৌলমীর গলা পেয়ে আপাততঃ কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও, থানায় কেন গেছে সে , তা ভেবে কিছুই কুলকিনারা করে উঠতে পারলো না। আধঘন্টা পর স্কুটির আওয়াজ পেয়ে দুজনাই ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো। ধীরস্থির ভাবেই পৌলমী ঘরে ঢুকলো। কিন্তু তার বাবা-মায়ের যেন আর তর সইছিলো না। তবুও কিছুটা শান্তভাব দেখিয়ে, তাকে ধরে ধরে উপরে নিয়ে গিয়ে তার ঘরে এনে বসালো রেবতী । তারপর ধীরে ধীরে পৌলমী তাদের যা বললো তা হলো এই ---
তখন ভোর তিনটে। আমার পড়া প্রায় শেষ। এবারে উঠবো ভাবছিলাম। হঠাৎ কিছুর একটা গোঙানির আওয়াজ পেয়ে আমি ছুটে নীচে নেমে এসে বৈঠকখানার জানালা খুলে, বাইরের দিকে দেখি, কুয়াশার ঘন অন্ধকারে একটা কিশোরী মেয়েকে মুখ বাঁধা অবস্থায় দুজন লোক চ্যাংদোলা অবস্থায় জোর করে একটা সাদা গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে। মেয়েটাও গোঙাতে গোঙাতে প্রাণপণে হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু দুটো লোকের সঙ্গে সে একা কিছুতেই পেরে উঠছিলো না। তারপর অবশেষে তারা তাকে গাড়িতে তুলে দ্রুত সেখান থেকে চম্পট দিলো।
তাই দেখে আমার সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে গেলো! কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু বিবেক আমাকে ক্রমাগত খোঁচা দিচ্ছিলো এই বলে যে, নির্বাক দর্শক হয়ে না থেকে , এই জঘন্য ঘটনাটা ঠেকাতে আমার অবিলম্বে কিছু একটা করা উচিত। তাই সেই অবস্থাতেই তড়িঘড়ি স্কুটিটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম থানার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কিছুটা যেতেই একটা টহলদার পুলিশভ্যান চোখে পড়লো। তখন সেটাকে দাঁড় করিয়ে টহলরত পুলিশদের ব্যাপারটার সবটা বললাম। তারা ব্যবস্থা নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, যেদিক দিয়ে সাদা গাড়িটা গিয়েছিলো, সেদিকেই রওনা দিলো। তবুও আমি যেন আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। তাই স্বয়ং থানায় গিয়েই কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে পুরো ঘটনাটা জানালাম।
ততক্ষণে টহলদার পুলিশভ্যানটাও তাদের ধরে ফেলেছিলো। তারা ফোনে সব ট্রাফিক পুলিশদের সচেতন করে দেয়ায়, একজায়গায় সিগন্যালে তারা আটকা পড়ে। থানা থেকে অফিসার ওদের ফোন করে খোঁজ নিতে, সেটা জানা গেলো। তার বেশ কিছুক্ষণ পর পাকড়াও করা দুষ্কৃতী সহ, উদ্ধার করা মেয়েটাকে থানায় আনা হলো। লোকগুলোকে সঙ্গে সঙ্গে লকআপে ঢোকানো হলো। মেয়েটার তখন অচৈতন্য অবস্থা। কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো, স্টেশনের কাছে এক ঝুপড়িতে সে মায়ের সঙ্গে ঘুমাচ্ছিলো। মা বিশেষ দরকারে একটু বাইরে বেরোতেই ,সেই সুযোগে দুজন লোক তাকে মুখে চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে আসে।
তার বাবা নেই। বহুদিন আগেই মারা গেছে। তাই মায়ের সঙ্গে একলাই থাকে সে,সেই ঝুপড়িতে । স্টেশনের হোটেল গুলোয়, মা বেটিতে বাসন মাজে। তাতেই যা দুপয়সা উপার্জন হয়, মা মেয়ের সংসার কোনরকমে চলে যায়। লোক দুটো বোধহয় বেশকিছুদিন যাবৎ ওদের উপরে নজর রেখে ছিলো। আজ সুযোগ বুঝে তাকে কিডন্যাপ করে কোথাও পাচার করবার তালে ছিলো । আমি আজ তার গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে না পেলে, বোধহয় সে চিরদিনের মত অন্ধকার জগতের অতলে হারিয়ে যেত !
নিয়ম রক্ষার্থে থানায় আমাকে কিছু কাগজপত্রে সইসাবুদ করতে হলো। তাই আমার এতো দেরি হলো ফিরতে ।
সব শুনে রেবতী মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। রজত আর রেবতী খুব খুশি হলো তাদের মেয়ে একটা অভাগী মেয়েকে পাচারকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর মত একটা ভালো কাজ করায় । পৌলমীর জন্য তাদের একটা অহমিকাবোধ আগে থাকতেই ছিলো। আজ আরো একবার তারা যেন উপলব্ধি করলো- সত্যি করেই পৌলমী তাদের একটা গর্ব ! শুধু তাদেরইবা বলি কেন? দেশের গর্ব, দশের গর্ব ,জাতীর গর্ব ! এরকম মেয়েরই আজ আমাদের সমাজে বড়ো দরকার ।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন