সাপ ও প্রচলিত সংস্কার : রীনা মন্ডল

রীনা মন্ডল

সাপ ও প্রচলিত সংস্কার


হাত , পা , চোখের পাতাহীন আকর্ষণীয় ও বিস্ময়কর সরীসৃপ প্রাণী সাপের আবির্ভাব প্রায় বারো থেকে চোদ্দ কোটি বছর আগে । পৃথিবীতে প্রায় ২৯০০ প্রজাতির সাপ দেখা যায় , যার মধ্যে মাত্র ৭০টি সাপ বিষাক্ত  আর এর মধ্যে ২৮টি সাপ সমুদ্রে বাস করে । প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী ভয় মিশ্রিত অনুপম সৃষ্টি এই সাপ সম্পর্কে বিশেষ করে এর আকার আচরণ ও গতিবিধি নিয়ে আমাদের সমাজে অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা , অন্ধসংস্কার , লোকশ্রুতি ও পৌরাণিক গল্প আছে । আবার সমাজের প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ যারা , সাধারণত পেশাগতভাবে কৃষিজমিতে অথবা অন্যান্য ক্ষেত্রে দিন মজুরের কাজ করে তারাই সর্প দংশনের শিকার হয় । তাই দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মনে গেঁথে থাকা ভ্রান্ত ধারণা দূর করাও কঠিন । অথচ সাপ কৃষকদের বন্ধু কারন একটি সাপ বছরে কমবেশি ২০০-২৫০ ছোট বড় ইঁদুর খেয়ে ফ্যালে , যারা বছরে কৃষকদের ২৫%-৩০% ফসল নষ্ট করে দেয় । প্রকৃতিগত সাপ নিরীহ অথচ ভীতু প্রকৃতির । ভয় পেয়ে এরা আত্মরক্ষার তাগিদে কামরায় । আর বিষাক্ত সাপের কামড়েই যে সবসময় মৃত্যু হয় তা নয় । সেটা নির্ভর করে কামড়ের সময় কতটা বিষ ঢেলেছে তার ওপর । অনেক সময় সাপ কামড়ালেও বিষ ঢালে না । আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার মোট সর্পদংশনের ৮০% নির্বিষ সাপের দংশন । সর্পদংশনের ৭২% মানুষের হাঁটুর নীচে এবং বাকি ২৮% শরীরের অন্য অংশে হয় । সর্পদংশনের সময়কাল সন্ধ্যাবেলা বা অন্ধকার হওয়ার পর ৬৮% এবং সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৩২% । সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় উপকূলবর্তী এলাকায় কেউটে , গোখরো , চন্দ্রবোড়ার দংশনেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে । সাপের বিষ প্রধানতঃ এনজাইম , প্রোটিন , এমিনোএসিড ও কিছু খনিজ ধাতব আয়নের মিশ্রণ যেমন ক্যালসিয়াম , সোডিয়াম , পটাশিয়াম , জিঙ্ক , ম্যাঙ্গানিজ । সাপের বিষকে প্রধানতঃ দুই ভাগে ভাগ করা যায় -
১) নিউরোটক্সিন - যা প্রধানত স্নায়ু প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ও
২) হিমোটক্সিন - যা প্রধানত রক্ত সংবহন তন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ।
কালাচ , গোখরো , কেউটে সাপের বিষ নিউরোটক্সিন ধরনের । এই বিষের প্রভাবে নার্ভগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । দংশনের কিছু পরে যন্ত্রণা শুরু হয় এবং আক্রান্ত জায়গা ফুলে যায় । দংশিত ব্যক্তির চোখের পাতা বুজে আসে , কথা জড়িয়ে আসে , জীভ আরষ্ঠ হয়ে যায় , শেষ পর্যন্ত খিঁচুনি ও পরে স্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় । হেলেসাপ , চন্দ্রবোড়ার বিষ হিমোটক্সিন ধরনের । এই বিষের প্রভাবে দংশনের পরেই আক্রান্ত জায়গা ফুলে যায় , শুরু হয় তীব্র যন্ত্রণা । ২০-২৪ ঘন্টা পর আক্রান্ত ব্যক্তির হৃদপিন্ড ও কিডনি অকেজো হয়ে যায় এবং মৃত্যু ঘটে । ভারতবর্ষে প্রথম সাপের বিষের প্রতিশোধক তৈরি হয়েছিল ১৮৯৫ সালে ফরাসি চিকিৎসক আলবার্ট কালমেট দ্বারা । পরবর্তীতে নতুন প্রতিষেধক পলিকেমিস্ট সিরাম মুম্বাইয়ের পরীক্ষাগারে ঘোড়াদের ওপর পরীক্ষা করে তৈরি করা হয় ।
সাপ বেঁজির লড়াই বহু প্রচলিত এবং এই লড়াইয়ে সাপের দংশনের পরেও বেঁজি নিজেকে সুরক্ষিত রাখে । বিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেঁজির দেহে গঠন পৃথক হওয়ার জন্য নিউরোটক্সিনকে প্রতিহত করতে পারে । আর তার জন্যই বেঁজির দেহে স্নায়বিক ক্রিয়ার কোন ব্যাঘাত ঘটে না । কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার জন্য ভারতবর্ষে সর্পদংশনের ঘটনা বেশি ঘটে । প্রতিবছর ভারতবর্ষে ৩৪-৫৪ হাজার মানুষ সর্পদংশনের শিকার হয় আর এর থেকেও বেশি পশ্চিম বঙ্গের মানুষ এর শিকার হয়ে থাকে । অবশ্য একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে সর্পদংশনের মত দুর্ঘটনা কমানো বা এড়ানো যেতে পারে । বিষাক্ত সাপ সাধারণত নিশাচর প্রকৃতির তাই রাত্রে চলা ফেরা করার জন্য বা রাত্রে যাওয়ার দরকার হলে যেমন মাঠে ঘাটে , ঝোপ ঝাড় , বাগান , গোয়ালঘরে অবশ্যই টর্চ রাখা দরকার । শীতকালে মাঠে ধান পাকার সময় ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ে । ইঁদুর সাপের প্রিয় খাবার । এসময় সাপ ইঁদুরের খোঁজে মাঠে চলে আসে । সে সময় মাঠে বা ধানের ক্ষেতে ইঁদুরের গর্তের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে । বর্ষায় সাপ বাড়ির উঁচু জায়গায় , গোয়াল ঘরে , ঘুঁটের গাদায় , খড়ের গাদার আশেপাশে আশ্রয় নেয় । এমন জায়গায় যাওয়ার দরকার হলে সতর্ক হতে হবে । সাপ ইঁদুর ধরার জন্য ঘরের মধ্যে ঢোকে এবং বিছানার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে । তাই রাতে শোবার সময় অবশ্যই মশারির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে । দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয় না এমন জিনিস রাখার ঝুড়ি , লোহার টিন প্রভৃতি জিনিস হাত দেওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে তবেই হাত দেওয়া উচিত । হঠাৎ সাপের মুখোমুখি হয়ে পড়লে ভয়ে ছোটা বা আতঙ্কিত না হয়ে পুরোপুরি নিস্তব্ধ ও নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে কারন সাপ দেখতে পায় না । বাতাসের কম্পন অনুভব করতে পারে শুধু ।

এর পরেও যদি সর্পদংশনের মতো দুর্ঘটনা ঘটেই যায় তবে মাথা ঠান্ডা রেখে , ভয় না পেয়ে , উত্তেজিত না হয়ে , শান্ত ও সংযত থেকে , কোনরকম কুসংস্কারে প্রভাবিত না হয়ে , আক্রান্ত ব্যক্তিকে সত্ত্বর সেই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে যেখানে AVS ( ANTI SNAKE VENUM SERUM ) উপলব্ধ রয়েছে ।

পশ্চিমবঙ্গে সচরাচর যে যে সাপ দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হল

নাম
আঞ্চলিক নাম
পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিষের প্রাণঘাতী মাত্রা

কালাচ
 কালসাপ , কানচিডি , শিখরচাঁদা
১মিগ্রা

শঙ্খ সুঁটি
শঙ্খিনি , রাজসাপ, দুমুখোসাপ
১০মিগ্রা

শঙ্খচূর
রাজগোখরো , সানসমনিচূড়া
১২মিগ্রা

গোখরো
খরিস , দুধে গোখরো
১৪মিগ্রা

কেউটে
কাল কেউটে , পদ্ম কেউটে
১৪মিগ্রা

চন্দ্রবোরা
রক্তছুটে , উলুবোরা , রক্তবেরা , খোলস
৪২মিগ্রা
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.