![]() |
রীনা মন্ডল |
মৃত্তিকার চোখের কোনে, আজ বার বার জল টলমল করে- উঠছে । কোন ভোরে উঠেছে আজ। রাতে ভালো ঘুমও হয়নি কাল। কাজেও যেন মন লাগছে না কিছুতেই। কী যেন একটা ব্যাথায় বুকটা টনটন করে উঠছে শুধু ! আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী। পাড়ার ফাংশনে প্রতিবারের মত গাইবে না সে। কিছুতেই না। যে যতই পীড়াপীড়ি করুকনা কেন।
মনে পড়ে গেলো বছর তিনেক আগের কথা। সেদিন সে বসেছিলো দর্শকের আসনে। হঠাৎ এক গীটারের সুরে তোলপাড় করে উঠলো তার বুক!
"আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্ক ভাগী....।"
গানটা আগেও একবার শুনেছে সে। কিন্তু গীটারের সুরে তা এতো রমনীয় ভাবে ফুটে উঠেছে আজ, যে পরম বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেছে মৃত্তিকা। কে ছেলেটা? এত সুন্দর বাজায়! হাতে কি যাদু আছে?এত দরদ দিয়ে কিভাবে বাজায়? ওর নামটা যেমন করেই হোক জানতেই হবে তাকে।
পরে জেনেছিলো অবশ্য। পরের বার ঘোষাল বৌদির জোরাজুরিতে ওদের বাড়ি গেছিলো, বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষ্যে পাড়ার ক্লাবে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো, তারই রিহার্সালে। ছোটবেলায় গান শিখতো মৃত্তিকা। ভারী সুন্দর গানের গলা। প্রায় স্কুলের সব অনুষ্ঠানেই গাইতে হতো। অনেক গুলো প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছে। অনেক স্বপ্ন ছিলো জীবনে। বড় গায়িকা হবে সে। দিকে দিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু বিয়ের পর কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেলো। স্বামী তার রাশভারী মানুষ। গান বাজনা এসব তার কাছে ছেলেমানুষী। ঘরের বৌ, বৌয়ের মত থাকবে। মন দিয়ে ঘরসংসার করবে,ছেলে মানুষ করবে, স্বামীর সেবাযত্ন করবে। তা না করে দিনরাত গলা সাধবে? এ আবার কি!
তাই বড় শখ করে বাপের বাড়ি থেকে আনা হারমোনিয়ামটা বাক্সবন্দী হয়েই পড়েছিলো এতদিন অযত্নে ,অবহেলায় । মৃত্তিকার বোন সায়ন্তিকা সেবার যখন এসেছিলো তার কাছে বেড়াতে, তখনই কথা প্রসঙ্গে তার মুখে জানতে পারে পাশের বাড়ির ঘোষাল বৌদি, মৃত্তিকার গান গাইতে জানার ব্যাপারটা। জানার পরই ব্যাস! পিছনে লেগে পড়ে, এবারে ক্লাবের অনুষ্ঠানে গাইতেই হবে তাকে। সেই থেকে শুরু।
সেখানেই মৃন্ময়ের সঙ্গে আলাপ। এত সুন্দর গীটার বাজায় ছেলেটা! যে কোন গানই যেন মোহময় হয়ে ওঠে ওর হাতের ছোঁয়ায়! সবাই এত সুখ্যাতি করে তার। অথচ কোন অহংকার নেই । এত ভদ্র আর অমায়িক সে।সৌম্যকান্তি চেহারা। মৃত্তিকার ক্রমশঃ খুব ভালো লাগতে থাকে তাকে। মৃত্তিকার গানের গলারও খুব প্রশংসা করে মৃন্ময়। একটার পর একটা গান শোনানোর জন্য অনুরোধ করতে থাকে তাকে। মৃত্তিকারও বিরক্তি লাগে না। বরং ভালোই লাগে, তার আবদার রাখতে। ক্রমে দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠলো।
মৃত্তিকার জীবনে যেন কোথায় একটা ছন্দ ফিরে এলো। ফিরে পেলো সে তার হারানো স্বপ্নের জগতটাকে। একটা সৃজনশীল মন সব সময় মনে মনে তার একটা নিজস্ব জগত তৈরি করে নেয়। বিয়ের পর সংসারের চাপে, সেই জগতটা হারিয়েই গিয়েছিলো মৃত্তিকার। মৃন্ময়ের সংস্পর্শে আবার যেন রূপ নিলো সেটা। সুজনবাবু অবশ্য এখনও এ ব্যাপারে ঘোর বিরোধী। তাই তার সামনে সে চর্চা করে না এসবের। তিনি অফিসে বেরিয়ে গেলে, ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে নিয়মিত হারমোনিয়াম নিয়ে বসে মৃত্তিকা।মৃন্ময় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গানের স্বরলিপির বই জোগাড় করে দেয়। সেটা থেকে নতুন নতুন গান তোলে মৃত্তিকা। ঠিক ঠাকই চলছিলো সব। কিন্তু !
প্রতিবেশীদের মুখে তার গানের প্রশংসা শুনে গতবার পাড়ার অনুষ্ঠানে মৃত্তিকার গান শুনতে গেছিলেন সুজনবাবু। সেখানে সবাই মৃত্তিকাকে ঘিরে ধরে এত হৈচৈ করছিলো, যে সেটা মোটেও ভালো লাগেনি গৃহকর্তা সুজন পালের। বিশেষ করে মৃন্ময় নামে ঐ ছোঁড়াটাকে মোটেও ভালো ঠেকেনি তাঁর। মৃত্তিকার পাশে বসে তার এত গীটার বাজাবার কী ছিলো? মৃত্তিকা তো একাই পারতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে। যত সব আদিখ্যেতা! আর গানের মাঝে মাঝে দুজনার এত আলাপ আলোচনারই বা কী ছিলো? যত্তসব ন্যাকামো!
বাড়ি ফিরে মৃত্তিকার স্বরলিপির বইটা নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে তো আরোই মাথা খারাপ! সেখানে বড়বড় সুন্দর হস্তাক্ষরে মৃন্ময়ের নাম লেখা - কেন? হুঁঃ! আবার লেখা প্রীতি উপহার! নিকুচি করেছে পীরিতির! দাঁড়াও, বাড়ি আসুক, দেখাচ্চি মজা! কত রঙতামাসা আর কত পীরিত! তাই ঘর এত অগোছালো হয়ে থাকে আজকাল! সংসারের কাজকর্ম ফেলে গানবাজনা! বলি, এটা কি ক্লাবঘর নাকি? মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষের মত থাকবে! দাঁড়াও, আজই একটা হেস্তনেস্ত না করলেই নয়!
মৃত্তিকা বাড়ি ফিরতেই শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড! মাস খানেক চললো তার রেশ! একদিন মৃন্ময় বেচারা কী একটা জিজ্ঞাসা করতে আর একটা গানের বই দিতে বাড়ি এসেছিলো মৃত্তিকার। সুজনবাবু বাড়িতেই ছিলেন। ব্যাস ! আর যায় কোথায়! যারপরনাই অপমান করলেন মৃন্ময়কে। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেলো মৃত্তিকার। এত অপমান, শুধুমাত্র গান গাওয়ার জন্য! সংসারে কেবল দাসী বাঁদী হয়েই বেঁচে থাকতে হবে চিরটাকাল ! তার নিজস্ব জীবন, ভালোলাগা - বলে কিছু থাকতে নেই? এমনভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে তো মরে যাওয়াই ভালো! কিন্তু কী হবে ছেলেমেয়ে দুটোর? ওদের মুখ চেয়ে তো বাঁচতেই হবে তাকে। সেই থেকে গানবাজনা বন্ধ। মৃন্ময়ের সঙ্গে দেখা হলেও, আর কথা বলে না সে। মাথা নীচু করে চলে যায় মৃন্ময়।
বাইশে শ্রাবণ জোর করে ধরে নিয়ে গেলো তাকে মিত্র আর ঘোষাল বৌদি। কিন্তু গান গাইতে স্টেজে উঠতেই, সেখান থেকে উঠে চলে গেলো মৃন্ময়। বুকে কেন একটা শেল এসে বিঁধলো মৃত্তিকার! কোনমতে চোখের জল আঁটকে গাইলো সেদিন। বাড়ি ফিরে প্রতিজ্ঞা করলো, আর কোনদিন গাইবে না সে। মৃন্ময়ের প্রতি অভিমানে গুমরে কেঁদে উঠলো বুক ! তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া! কী অপরাধ করেছিলো মৃত্তিকা, যে মৃন্ময় এরকম করলো তার সঙ্গে? কত ভালোবাসতো সে তাকে! তার এই প্রতিদান? আর ওমুখো হবে না কোনদিন! হারমোনিয়ামটা তুলে রাখলো, উঁচুতে বাঙ্কের উপরে।আর হাত দেবে না ওটাতে কোনদিন! কিন্তু বাঁচবে কি করে মৃত্তিকা? গান যে তার প্রাণ! এত প্রতিবন্ধক থাকে কেন কারো কারো জীবনে?
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন