উত্তরের লোক সংস্কৃতি, কিছু কথা : সূরজ দাশ


উত্তরের লোক সংস্কৃতি : কিছু কথা
একটি দেশের বা একটি জাতির আত্মপরিচয় তার লোকসংস্কৃতি৷ সাধারণ মানুষের ভাষা, জীবনবোধ, বিনোদন, সাহিত্য, পেশা – এ সব নিয়েই গড়ে ওঠে ‘লোকসংস্কৃতি'৷ এই সংস্কৃতির মধ্যে থাকে সহজিয়া সুর ৷ কোনো কৃত্রিমতা থাকে না লোকসংস্কৃতিতে৷ এটা সহজাত, সহজিয়া আর স্বাভাবিক বহতা নদীর মতো৷ পোশাকি সংস্কৃতির বিপরীতে এক শক্তিশালী সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা স্বকীয় সংস্কৃতি৷ এর কোনো বিনাশ নাই৷ আছে আধুনিক সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার উদারতার ইতিহাস৷ তাছাড়া এই সংস্কৃতির ভাষাও লোকজ ৷ যাকে বলা হয় লোকভাষা ৷
লোকজ গান, লোককথা, লোকজ খেলাধুলা, লোকজ আচার অনুষ্ঠান এই প্রতিটি বিভাগ প্রতিটি অঞ্চলে বেশ সমৃদ্ধ এবং এলাকা ভিত্তিক বিশাল বিশাল সম্ভার রয়েছে। লোককবিতা, লোকজ ছড়াও এর ব্যতিক্রম নয়। লোক নৃত্যের বেলায় একটু ব্যতিক্রম রয়েছে। লোকনৃত্য এলাকাভিত্তিক ভিন্নতা ধারণ না করে তা শ্রেণি পেশা ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভিন্নতা রয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও এর তাল এর প্রতি লক্ষ করলে তা দেখা যাবে কোথায় যেন তা এক সূত্রে গাঁথা রয়েছে। এক্ষেত্রে ভিন্নতার কথাই যদি বলি তাহলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কথা বলা যায়।

লোকসংস্কৃতির অজস্র উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্ত্তগত, মানসজাত, অনুষ্ঠানমূলক এবং প্রদর্শনমূলক। লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে সেসব বস্ত্তগত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত, যেমন: বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটির আবার বহুবিধ প্রকারভেদ আছে। যেমন কৃষক প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদন করে, তাঁতি সব ধরণের বস্ত্র, কুমার সব ধরনের হাঁড়ি-পাতিল, ছুতার কাঠের যাবতীয় আসবাবপত্র, কামার লোহার বিবিধ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নির্মাণ করে। ধোপা, নাপিত, সোনারু, কাঁসারু, শাঁখারি, ময়রা, চর্মকার, ঘরামি, জেলে, কাহার প্রভৃতি বৃত্তিধারী শ্রমজীবী মানুষ পেশাগত কাজে নানারকম হাতিয়ার ব্যবহার করে। গ্রামের মানুষ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য নিজেরাই উৎপাদন ও বিতরণ করে; এজন্য তাদের অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় না। কুমার নির্মিত মাটির দেবদেবীর মূর্তি এখনও মৃৎশিল্পের অনন্য নিদর্শন। তারা সখের হাঁড়ি, মনসার ঘট, লক্ষ্মীর সরা ইত্যাদি তৈরি করে অনন্য শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছে। ছুতার প্রাচীন কাল থেকেই কাঠের খাট-পালঙ্ক, দরজা, চৌকাঠ, নৌকা ইত্যাদি দক্ষতার সঙ্গে নির্মাণ করে আসছে। এক সময় বাংলার ময়ূরপঙ্খি, সপ্তডিঙ্গা, চৌদ্দডিঙ্গা প্রভৃতি সমুদ্রগামী নৌকার সুনাম ছিল। বাঁশ, বেত, কাঠ, পাট ও শোলা দিয়ে নানারকমের নিত্য ব্যবহার্য ও সৌখিন দ্রব্য তৈরি হয়।

মৌখিক ধারার লোকসাহিত্যকে মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর সঙ্গে কিছু চিত্রকর্মকেও যুক্ত করা যায়। অনুমান হলেও সত্য যে, মানুষ যখন থেকে ভাষা পেয়েছে তখন থেকেই কিছু না কিছু সৃষ্টি করে আসছে। উত্তর বাংলায় লোককাহিনী, লোকসঙ্গীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্যের প্রচলন আছে। উত্তরের মানুষ আবেগপ্রবণ জাতি। পলি দ্বারা গঠিত বাংলার নরম মাটি, শ্যামল প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য, কৃষি-অর্থনীতি, দীর্ঘস্থায়ী সামন্ত সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে উত্তরবাংলা লোকসাহিত্যের ভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছে। মুখ্যত কৃষকসমাজই লোকসাহিত্যের স্রষ্টা ও ধারক-বাহক। এর সঙ্গে গো-মহিষের রাখাল, নৌকার মাঝি-মাল্লা, গায়ক সম্প্রদায় বাউল, ভিক্ষোপজীবী ফকির-বৈরাগী ও পেশাজীবী বেদে-বেদেনিরা লোকসঙ্গীতের চর্চা করে থাকে। লোকচিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ওঝা ও মন্ত্রগুপ্তিরা মন্ত্রের চর্চা করে। সাপের ওঝা সর্পবিষের ও ভূতের ওঝা তথাকথিত ভূত-প্রেতাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করে। শিরালি মন্ত্রগুণে আকাশের মেঘ-শিলাবৃষ্টি পর্যন্ত বিতাড়িত করতে পারে বলে লোকসমাজ বিশ্বাস করে।

লোকগাথার মতো দীর্ঘ পালাগানে সমাজজীবনের বাস্তব চিত্রটি ধরা পড়েছে। প্রেমই গাথাগুলির মুখ্য বিষয়; তবে কিছু বীরত্ব ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্রও আছে। ছড়ায় আছে কল্পনা ও বাস্তবতার মিশ্রণজাত বিচিত্র বিষয়। চিত্রকলাকে বলা যায় বস্ত্ত-আশ্রিত মানস ফসল। আলপনা, পটচিত্র, ঘটচিত্র, দেওয়ালচিত্র, অঙ্গচিত্র প্রভৃতিতে রঙ-তুলির ব্যবহার আছে। ঘরের মেঝে, খুঁটি, দেওয়াল, কুলা, ডালা ইত্যাদিতে আলপনা দেওয়া হয়। ব্রতপূজা উপলক্ষে ব্রতের আলপনা দেওয়ার রীতি আছে। বর্তমানে অন্নপ্রাশন, বিবাহ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উপলক্ষেও পথে-প্রাঙ্গণে আলপনা দেওয়া হয়। এই আলপনা বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা। পটুয়ার পটচিত্র ও পটগীত বাঙালির ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি থেকে উদ্ভূত। নকশি কাঁথা সূচিশিল্পের মধ্যে পড়ে। এটি একান্তভাবে পল্লিরমণীর নিজস্ব সম্পদ। বিছানার চাদর এবং লেপ ও বালিশের কভার হিসেবে ব্যবহূত হলেও নানা চিত্রকর্মে শোভিত এসব কাঁথা নান্দনিকতা গুণে দেশ-বিদেশের শিক্ষিত সমাজেও সমাদৃত হয়েছে।

অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির মধ্যে লোকনাট্য, যাত্রা, নৃত্য ও খেলাধুলা প্রধান। অভিনয় ও অঙ্গক্রিয়া দ্বারা এসব রূপায়িত হয়। বাউল, গম্ভীরা প্রভৃতি গান, নাচ ও অভিনয় ত্রি-অঙ্গের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়। জারি গানের সঙ্গে জারি নাচ, সারি গানের সঙ্গে সারি নাচ, লাঠি খেলার সঙ্গে লাঠি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ এবং ঘাটু গানের সঙ্গে ঘাটু নাচ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলি সকল শ্রেণির মানুষের চিত্তবিনোদনের উৎস। হোলির গীত, গাজীর গীত, মাগনের গীত, বিবাহের গীত, হুদমার গীত ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষে নিজস্ব কিছু আচারসহ পরিবেশিত হয়। কতক গান পেশাজীবী গায়েন, বয়াতি ও গীদালরা পরিবেশন করে; আর বাকিগুলি বাড়ি-ঘরে, মাঠে-ঘাটে ও খেতে-খামারে নানা শ্রেণির মানুষ কাজ করতে করতে বা কাজের অবসরে গেয়ে শ্রান্তি দূর ও আনন্দ উপভোগ করে।

প্রথম জমি চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত নানা ধরনের লোকাচার আছে। এর কতগুলি প্রাকফসল, আর কতকগুলি ফসলোত্তর আচার। বৃষ্টির জন্য মেঘারাণী, হুদমা দেওয়া, বেঙ বিয়া, ফসল রক্ষার জন্য ক্ষেতবন্ধন, কাকতাড়ুয়া উৎসব প্রভৃতি প্রাকফসল আচার; আর লক্ষ্মীর ছড়, নবান্ন, মাগন প্রভৃতি ফসলোত্তর অনুষ্ঠান। 
শরীরচর্চা, আমোদ-প্রমোদ ও অবসরযাপনের জন্য লোকসমাজে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। জল, স্থল ও অন্তরীক্ষভেদে তিন ধরনের লোকক্রীড়া আছে। শ্রমসাপেক্ষ শরীরচর্চার খেলা ও শ্রমহীন আনন্দের খেলা হিসেবে অন্তরঙ্গন ও বহিরঙ্গনের খেলারূপেও এগুলিকে ভাগ করা যায়। হাডুডু একটি জনপ্রিয় খেলা। বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নুনতা, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি, মোগল-পাঠান, এক্কাদোক্কা, বউরাণী, কড়িখেলা, ঘুঁটিখেলা, কানামছি, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি খেলায় সকল স্তরের লোকজন অংশগ্রহণ করে। কতক খেলাধুলা শরীরচর্চা ও শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে স্কুলের বালক-বালিকারাও অনুশীলন করে।

সাধারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মুখে, কথায়, ভাষার ব্যবহারে, লেখায় এর প্রকাশ ৷ কোনো দেশের বা কোনো এলাকার সংস্কৃতির ধারা প্রধানত দুটি: নগরসংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতি লোকসম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস ও আচার-আচরণ, জীবন-যাপন প্রণালী, চিত্তবিনোদনের উপায় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি। এটা সম্পূর্ণই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি তাদের প্রকৃত পরিচয় বহন করে। আমরা মূলত এখানে কেবল উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি নিয়ে কিছুটা চর্চা করবো।  

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বসবাস করেন নানা ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ। এখানকার উচ্চবর্ণের মানুষেরা পূর্ব কিংবা দক্ষিণ বাংলার লোক। এর অধিকাংশটাই দেশ বিভাগের ফলে এখানে এসেছে। পূর্বেই যারা এসেছে তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদ্গোপ ও মাহিষ্য প্রভৃতি শ্রেণির মানুষেরা আছেন। আবার তপশীলী সম্প্রদায়ের অন্য শ্রেণির মানুষেরা আগে থেকেই আছে, পরবর্তীকালেও অনেক এসেছেন। তপশীলি জাতি ও উপজাতির সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের মধ্যে রয়েছে বাঙালি, অবাঙালি, বর্ণহিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ।

উত্তরবঙ্গ মূলত গ্রামপ্রধান ভূখন্ড। গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তা-ই উত্তরবাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত। প্রকৃতিনির্ভর এই উত্তরবাংলার মানুষের জীবনযাত্রা প্রধানত ঐতিহ্যমুখী, গতানুগতিক ও মন্থর। গ্রামবাসীরা তেমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না এখনো। তারা পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে উৎপাদন, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ধর্মকর্ম, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাকে অবলম্বন করেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। সরলতা, সজীবতা ও অকৃত্রিমতা এসবই উত্তরের লোকসংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

উত্তরবঙ্গের উপজাতীয় সংস্কৃতি এক অর্থে লোকসংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত, তবে কতক বিষয়ে পার্থক্য থাকায় তা পৃথকভাবে বিবেচিত হয়। উপজাতীয় সংস্কৃতি অধিক মাত্রায় রক্ষণশীল, পরিবর্তনবিমুখ ও ঐতিহ্যপন্থী। বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ও শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের অপরিবর্তনীয় অর্থনীতি ও অন্তর্মুখী মনমানসিকতার কারণে যেখান থেকে জীবনযাত্রা শুরু করেছিল, বর্তমানেও প্রায় সেখানেই রয়ে গেছে। একই রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসবাস করেও তারা বৃহত্তর লোকসমাজের সঙ্গে মিলেমিশে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে এগিয়ে না এসে বরং নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার নামে প্রাচীন সংস্কার, প্রথা ও ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে আছে। সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা না থাকায় তাদের সংস্কৃতিতে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো পরিবর্তনও লক্ষ করা যায় না।

অঞ্চলভেদে উত্তরবঙ্গে বহু প্রকার লোকসঙ্গীতের প্রচলন আছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন, ধামালি, পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা প্রভৃতি ধারার শতশত গান আজও প্রচলিত আছে। লৌকিক ও আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ এসব গানের বাণীতে জাতির অন্তর্জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। কতক গানে ধর্মীয় আবেগ জড়িত আছে; তবে অধিকাংশ গানই চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গীত হয়। খেমটা, পটুয়া ও সাপুড়ে গানগুলি জীবিকার সঙ্গে জড়িত। মেয়েলি গীত, সহেলি গীত, হুদমা গীত ইত্যাদিতে নারীসমাজের কামনা-বাসনার প্রতিফলন ঘটেছে। উত্তরবঙ্গের শহর ও গঞ্জে আজ নানান বহিরাগত সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সহাবস্থান লক্ষ্য করা গেলেও কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবনধারায় আধুনিক সংস্কৃতির চটুল চমক প্রাচীন লোককথা, লোকগান, লোকপালা, লোকনাট্য, লোকসঙ্গীত ও লোক-সংস্কৃতিকে এখনো পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে পারেনি বলে আজও কিছু কিছু লোক সংস্কৃতির মূল্যবান উপাদানের সন্ধান মেলে উত্তরবাংলার প্রায় সব জেলাতেই। 

আছে প্রবাদ-প্রবচন, খনার বচন, লোককথা৷ এরমধ্যে আছে প্রকৃতির কথা, ঋতুর কথা, ভালো-মন্দের কথা, জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় দিকের কথা৷ এ সবের সঙ্গে আছে বিজ্ঞানের সম্পর্ক, আছে যুক্তির সম্পর্কও৷ গ্রামীণ জনপদের লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে, তা বস্তুগত সংস্কৃতির উপাদান৷ যেমন বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র ইত্যাদি৷ মৌখিক ধারার লোকসাহিত্য মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত৷ লোককাহিনি, লোকসংগীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্য৷

অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির মধ্যে লোকনাট্য, যাত্রা, নৃত্য ও খেলাধুলা প্রধান৷ বাউল, গম্ভীরা, জারি গানের সঙ্গে নাচ, সারি গানের সঙ্গে সারি নাচ, লাঠি খেলার সঙ্গে লাঠি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ এবং ঘাটু গানের সঙ্গে ঘাটু নাচ ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ হোলির গীত, গাজীর গীত, মাগনের গীত, বিবাহের গীত, হুদমার গীত। 

উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া ও লোকজ সংস্কৃতি ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়া কোনো এক সময় উত্তর বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়ে আজ সর্বত্র পরিবেশিত হচ্ছে । হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল থেকে হাঁকাও গাড়ি চিলমারী বন্দর পর্যন্ত ভাওয়াইয়ার শেকড় শুধু বিস্তৃত থাকলেও এখন এর শেকড় চারিদিকে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। 'ওকি গাড়ীয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ী তুমি চিলমারীর বন্দরে', কিংবা 'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে' ভাওয়াইয়া গানের এই সুরলীলা ভাওয়াইয়া প্রেমিক মানুষের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে দোলা দেয়। গরুর গাড়ি কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলা থেকে প্রায় হারিয়ে গেলেও চিলমারী বন্দরে সেই গরুর গাড়ি আজ দেখা না মিললেও ভাওয়াইয়া গানে সেকালের আবহমান গ্রাম বাংলার সেই চিরায়ত লোকসংস্কৃতি বহমান। লোকসঙ্গীতে নদনদীর এই অভিশাপের প্রভাব লক্ষণীয়। এ ছাড়া এ অঞ্চলের ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া প্রধান আকর্ষণ ও আনন্দ হলেও এর পিছনে উঠে এসেছে স্বপ্ন ভঙ্গ ও বেদনার কথা। সেই বেদনা অন্তরের গভীরে গোপন রেখে এই অঞ্চলের মানুষ লোকসঙ্গীত, ভাওয়াইয়া, রাখালী আর কিষাণি গান গায় অবলীলায়।

খেতে খামারে কৃষি কাজে এবং অবসরে উঠানে বসে লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া, রাখালী আর কিষাণি গানের আসর জমিয়ে তোলে গায়কেরা। এ অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গান ছাড়াও পালা গান, কেচ্ছা বন্দি গান, রাজা মানিক চাঁদ, গুপিচাঁদ. রাজমাতা ময়নামতির স্মৃতিমাখা গানেও তারা জমিয়ে তোলে খেত খামার কিংবা উঠানের আসর। বর্ষাকালে নদনদীতে জল ভরে উঠলে নৌকা বাইচে সারি গান আর জারি গান তাদের মহাবিষ্ট করে । এমনো এক সময় ছিল, মানুষ সারারাত জেগে শুনতো জাগের গান, পালাগান, যোগীর গান, পাঁচটেঁকি, মোনাই যাত্রা, ভাসান যাত্রা, কৃষ্ণলীলা, বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গান ও ছোকরা নাচের গান। এ অঞ্চলের সেই সব সংস্কৃতি আজ কালের বিবর্তনে বিলুপ্তপ্রায়। উত্তর বাংলার প্রাচীন জনপদগুলোতে এখনো খুঁজে পাওয়া যায় প্রকৃতিভিত্তিক আঞ্চলিক বারোমাসি গান, নদনদীভিত্তিক ভাটিয়ালি, আর পালা গান । আরও পাওয়া যায় বাউল গান, কীর্ত্তন বন্দি, শ্যামা সংগীত গান, জারি ও সারি গান, মুর্শিদি, মারফতি, লালনগীতি, কবিগান, পল্লীগীতি, যাত্রাপালা, বিয়েরগীত, লাঠিখেলা, পুঁথিপাঠ, লোকনৃত্য, ও ধুয়া গান। এ ছাড়াও রয়েছে নিজস্ব ঘরনার গান, ছোকড়া নাচার গান, উদাসীনি গান এ অঞ্চলের মানুষকে আজও প্রবলভাবে উদ্ভাসিত করে। যদিও গাড়িয়াল ভাই ও মইষাল বন্ধু আমাদের চারপাশের চেনা জানা কোনো কেউ নয়। তারপরেও ভাওয়াইয়া গানে উজ্জীবিত করে গাড়িয়াল ভাই ও মইষাল বন্ধু কাছের কোনো আপনজনকেই টেনে আনে। তাই ভাওয়াইয়া আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

দক্ষিণ দিনাজপুরের রাজবংশী জনসমাজের লোকনাট্য খন পালাগান এখনো বিশেষ জনপ্রিয় । প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই লোকশিল্প । কিন্তু কালের নিয়মে হারিয়ে যাচ্ছে সেই শিল্প । উত্তর দিনাজপুর জেলার কিছু কিছু অঞ্চলে ‘খনগান’ খুবই প্রচলিত ও জনপ্রিয়। জেলার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন লোকনাট্যের মধ্যে এই ‘খনগান’ বা খ্যেনের গান নানান কারণেই বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে ।

দুই দিনাজপুরের গমীরা হল একটি লোকশিল্প । উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর অন্যতম উৎসব চড়কপূজা উপলক্ষ্যে চৈত্রমাসে গোমিরা খেলার গান হয়। চৈত্রসংক্রান্তির চার পাঁচ দিন আগে শুরু হয় গোমিরার খেলা ও গান এবং শেষ হয় চৈত্রসংক্রান্তির দিন বিশ্যাল খেলার মধ্য দিয়ে। দশ বারোজন যুবকের একটি দল মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেলা দেখায় ও গান শোনায়। তারা সকলেই শিবের ভক্ত এবং ‘খেলটুক’ নামে পরিচিত হয়। খেল্টুকদের পরনে থাকে সাদা ধুতি ও গেঞ্জি। চৈত্রসংক্রান্তির আগ পর্যন্ত তাদের স্নান করা এবং পোষাক বদলানো নিষেধ। গৃহস্থের বাড়ির বাইরের খোলানে তারা ঢাকের তালে তালে মাটিতে শুইয়ে, বসে, গড়িয়ে গড়িয়ে ও দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে গোমিরার খেলা দেখায়। খেলা শেষে কোন কোন বাড়িতে গোমিরার গানও শোনায়। ঢাকের তালে তালে একবার ডানে এবং একবার বামে গিয়ে হাতে তালি দিয়ে তারা নৃত্যসহ গান পরিবেশন করে থাকে। গোমিরার গান মাটিয়া তালযুক্ত মধ্যম লয়ের গান। এতে আদিরসের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।

নানা-নাতির রং-ঢংয়ে পরিবেশিত মালদার গম্ভীরার বর্তমান চরিত্র পুরোটার উত্তরবঙ্গীয়। নানা-নাতির কথা বলার ঢং ও ভাষা বিষয়বস্তু অঙ্গভঙ্গি হালকা নৃত্য সবই এখানকার মানুষ, তাদের জীবন, তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনাকে শৈল্পিক স্বার্থকতায় উপস্থাপন করে। আর ধর্মীয় গান ভজন, মহিমা, জারি-সারি, মুর্শিদী, ভক্তিমূলক কিংবা বিবাহের নানা পর্বের গান অথবা নবান্নে ধানতোলা, ধান লাগানো, ধান ভানা এসব জীবনমূখী সংস্কৃতিচর্চা উত্তরের জেলাগুলাতো সমান মাত্রায় বিদ্যমান। এছাড়া লৌকিক নানা সামাজিক পারিবারিক আচার অনুষ্ঠান বিয়ে, জন্মদিন এবং অন্যান্য বিষয়গুলোতো আছেই।

আলকাপ মূলতঃ মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের নিজস্ব লোকসংগীত। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও মালদহ, জেলায় এই গান বিশেষ জনপ্রিয় । এই গান পালা গানেরই একটি অঙ্গ। অনেকটা কবি গানের মতোই বিভিন্ন আসরে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। এইধরনের গানের প্রধান উপজীব্য হলো ছড়া ও গান। আলকাপ যে বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য তা হলো মুসলমানদের এই সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িক মিলনের সূত্র রয়েছে। লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নানান ধরনের বিষয় আলকাপ গানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তবে রাধাকৃষ্ণের কথা আলকাপ গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। লৌকিক জীবন নিয়ে যে ছড়া আলকাপের গানে স্থান পায় তা সব সময় শ্লীল হয় না। গ্রাম্য জীবনের সহজ সরলতা এই গানের সহজ বিশেষত্ব। মুসলমান সমাজের বিশাল অংশের মধ্যে একসময় এই গান আদৃত হলেও ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্য সংস্কৃতির চাপে এর প্রচলন কমে আসছে।

চোর চুন্নির গান উত্তরের লোকসঙ্গীতের জনপ্রিয় একটি ধারা। লোকবিশ্বাস আছে যে, আশ্বিন মাসের অমাবস্যার রাতে চোর যদি গৃহস্থের বাড়ি থেকে কোন জিনিস চুরি করে এনে পরের মাসের অমাবস্যার রাতে অর্থাৎ কালীপূজার রাতে সেই চুরি করা দ্রব্যটি গৃহস্থের অজান্তে তার ঘরে নির্বিঘ্নে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারে তাহলে সেই চোর সারাবছর সাফল্যের সঙ্গে চুরি করতে পারবে। চোর চুন্নীর গানের এই লোকবিশ্বাসটির সঙ্গে আদিম যাদুক্রিয়ার সম্পর্ক আছে এতে কোন সন্দেহ নেই। অন্য কারণও আছে, একসময় এ অঞ্চলে কার্তিক মাসকে বলা হতো মঙ্গার মাস। এসময় মানুষের অভাব অভিযোগ লেগেই থাকতো। অভাবের কারণে সমাজে চোরের উপদ্রপও যেতো বেড়ে। চুরি ছিলো এতদঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সমস্যা। এই সামাজিক সমস্যার ওপর ভিত্তি করেই চোর চুন্নী গানের উৎপত্তি। চোর ও চুন্নী দম্পতির কথপোকথনের মাধ্যমে উঠে আসে তাদের দাম্পত্য ও গার্হস্থ্য জীবনের চিত্র, সমাজের বাস্তব সমস্যার চিত্র।

চোর চুন্নীর উক্তি ও প্রত্যুক্তিমূলক গীতি-সংলাপ, হাস্য-কৌতুক, ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপের মাধ্যমে তারা অবতীর্ণ হয় সমাজের নিরপেক্ষ সমালোচকের ভূমিকায় । সমাজে ঘটে যাওয়া অতীতের কলংক কাহিনী, সমসাময়িক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির নিরপেক্ষ চিত্র চোর চুন্নীর গানে যথাযথভাবে ধরা পড়ে গ্রামীণ লোককবিদের রচনায়।
ধর্ম, মত ও পথ নির্বিশেষে যুগযুগ ধরে বিভিন্ন বর্ণ ও পেশার মানুষের একত্র বসবাস ও পরস্পর ভাবের আদান-প্রদানের ফলে গ্রামীণ জীবনে বিরোধ অপেক্ষা ঐক্যের সুরই বেশি ধ্বনিত হয়েছে। এজন্য ভারতীয় সংস্কৃতির মতো উত্তরবাংলার লোকসংস্কৃতিতেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে এবং এর মধ্যেই বাঙালির জাতিগত পরিচয় নিহিত রয়েছে।

( লেখাটি মৌলিক নয় । বিভিন্ন সুত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা এই রচনার অনেক অংশই ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। এই লেখাটি কেবল উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতিকে ছুঁয়ে দেখবার একটা প্রয়াস মাত্র । যদিও সম্পূর্ণভাবে উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি এখানে প্রতিফলিত হয়নি । পরবর্তীতে আরও বিস্তারিত আলোকপাত করবার ইচ্ছে আছে ।


Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

1 Comments:

বিশ্বনাথ লাহা বলেছেন...

যদিও লেখক এই প্রবন্ধটি পুরোপুরি মৌলিক নয় বলে স্বীকার করে নিয়েছেন তবুও বলতে হয় উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় লেখক এক কথায় অসাধারণ একটি লেখা পড়বার সুযোগ করে দিয়েছেন । আরো অনেক প্রত্যাশা রইলো কবি সূরজ দাশের কলমে ।