চৈত মাসের খা খা দুপুরে ফসলের ক্ষেত ফেটে হা করে আছে। রোদের ঝা ঝা তেজে আমের বনে আমের বোলগুলি চোখ কুঁচকে চেয়ে আছে টকটকে মাঁদার ফুলের দিকে। চরমুগরিয়ার পার্শ্ববর্তী কুমার নদের পানি শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। গাঁয়ের বউ-ঝি’রা হাঁটুঅবধি ছায়া তুলে থপাস থপাস কলসিটাকে ডানে-বামে পানির উপরে বাড়ি মেরে টলটলা পানি নিয়ে কোমর দুলিয়ে ঘরে ফেরে। ডানপিটে ছেলে-মেয়ের দল অÐি-অÐি খেলে পানিকে ঘোলা করে দেয়। কুমারকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় এক লাফেই ওপার চলে যাওয়া যায়। এই নদের সাথে আদুরকাটার খালের সংযোগ। নদের জল শুকালে খালের জলও শুকায়। আদুরকাটার খালের জল শুকিয়ে হাঁটুর কাছে চলে এসেছে। চোখ মেলে তাকালে পরিস্কার পানিতে ছোট ছোট মাছেদের চলাফেরা স্পষ্ট দেখা যায়। বর্ষার মৌসুমে আদুর কাটার খালেরও যৌবন আসে। যৌবনের উছলে ওঠা পানিতে দু’কুলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হয়। এখন সেই যৌবনে ভাটি পড়েছে। খালের মাছেরা এবং জলজ প্রাণিরা একে একে চলে যা”েছ কুমার নদে। শুকিয়ে যাওয়া খালে কে আর থাকতে চায়? একে একে যখন সবাই চলে যা”েছ তখন স্বামী বেলে মাছ আর স্ত্রী বেলে মাছ খালের শুকিয়ে যাওয়া পানিতে ঘুরে বেড়া”েছ। স্বামী বেলে মাছ নির্বিকার এবং নিশ্চিন্ত। স্ত্রী বেলে মাছ শংকিত এবং চিন্তিত। সে মোটামুটি বুঝে গেছে এখানে আর বেশিদিন টেকা যাবে না। এখানে থাকা মানে নিশ্চিত মৃত্যু। কয়েকদিন গেলেই হাঁটুজল পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। জল ছাড়া মাছেদের বেঁচে থাকার প্রশ্ন ওঠে না। অথচ এই সহজ সত্যটা স্বামী কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। তার ধারণা মৃত্যু জিনিসটা পূর্ব নির্ধারিত। কার কখন, কোথায় এবং কীভাবে মৃত্যু হবে তা পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে আছে। অতএব মৃত্যু নিয়ে অযথা শংকিত হবার কিছু নেই। যতসব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা!
রাত দ্বিতীয় প্রহর। অষ্টমী চাঁদের নরোম আলো আকাশের গা বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে খালের স্ব”ছ পানিতে। স্বামী বেলে মাছ আর স্ত্রী বেলে মাছ ছোট্ট গর্তে শুয়ে আছে চুপচাপ। স্বামী বেলে মাছ শুয়ে শুয়ে জোছনা দেখছে। খাসা জোছনা পড়েছে আজ। এই জোছনা পূর্ণিমার জোছনার মতো স্ব”ছ না। খানিকটা ঘোলাটে। সবুজ শ্যাওলা পড়া কলমি ঝোপে ঘোলাটে জোছনা পড়ে চারদিক ছয়লাব করে দি”েছ। হাওয়ায় দুলতে থাকা কলমিরা যেন খুশিতে বুদ্বুবুদ্ তুলে ফিসফিস গল্প করছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে স্বামী বেলে মাছ চেয়ে চেয়ে দ্যাখে, তুলোর মতো উড়তে থাকা মেঘÑ মেঘের ভিতরে সমুদ্রের ঢেউÑ কেশর ফুলিয়ে ছুটে চলা শাদা শাদা ঘোড়া। তার মন আদ্র হয়ে ওঠে। আহা পৃথিবীটা কী সুন্দর! এই ছোট্ট খাল সত্যিই সুন্দর! স্ত্রী বেলে মাছের কিš‘ এই খাল মোটেই ভাল ঠেকছে না। তার একটাই চিন্তা কীভাবে স্বামীকে বুঝিয়ে খাল থেকে চলে যাওয়া যায়। সে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করে। খাল আর নদের সংযোগ¯’ল প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ভোর নাগাদ সেখানে হয়ত পুরোপুরি চর পড়ে যাবে। যা করার করতে হবে আজই। যেভাবেই হোক স্বামীকে রাজি করাতে হবে। স্ত্রী বেলে মাছ নীরবতা ভেঙ্গে বলে, শুনছো! স্বামী বেলে মাছ উদাস ভংগিতে বলে, হু। স্ত্রী বেলে মাছ যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেÑ এখানে থাকলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত। ভোর হলে আর বের হওয়া যাবে না। অতএব চলো এখনই খাল ছেড়ে চলে যাই। আবার যখন খালে পানি আসবে তখন আমরা ফিরে আসবো। স্বামী বেলে মাছের তাতে কোন বুঝ হয় না। বরং সে দৃঢ় কণ্ঠে তার বিশ্বাসের কথাই বলে যায়Ñ শোনো, মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চয় আমরা কিছু জানি না। অতএব এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করা আমার কাছে বোকামি ছাড়া কিছু না। তাছাড়া এই খাল ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ই”ছা হয় না। এর সাথে আমাদের কত স্মৃতি! এই যে আমাদের গর্তের সামনে চাঁদের আলো এসে লুটোপুটি খা”েছÑ ঢোল-কলমিগুলি হাওয়ায় কোমর দোলা”েছ, তার গায়ে জমে থাকা শ্যাওলাগুলি দ্যাখো ক্যামন ঝুলে ঝুলে নাচছেÑ কাশবনের ঘন ঝোপ, যেখানে আমরা মাঝে মাঝেই বেড়াতে যাই আর খুশিতে বুদ্বুদ্ ছাড়িÑ এগুলো যেন একান্তই আমার। এই খাল ছেড়ে সবাই চলে গেছে। এসময় একে ছেড়ে যেতে আমার খুব খারাপ লাগবে। আজ তোমাকে আর একটা কথা বলি, আমার বিশ্বাস এই খালে এখনই আমাদের মৃত্যু হবে না। সেটা কীভাবে হবে তা জানিনা। আমার ধারণা বিশ্বাসের একটা পিওরিটি আছে। প্রকৃতি সেই পিওরিটি নষ্ট করে না। এটা দেখার জন্য হলেও আমার এখানে থাকা দরকার। আর সবচাইতে বড় সত্য হলো খাল ছেড়ে আমার যেতেই ই”ছা করে না। তোমার ই”ছা হলে তুমি চলে যেতে পারো। সম্ভবত আমাদের আবার দেখা হবে। স্ত্রী বেলে মাছের বিশ্বাসে অতো জোর নেই। সে সোজা সাপ্টা ধরনের। সে জানে বিপদ আসলে আত্মরক্ষা করতে হয়। এই সময়ের আত্মরক্ষা একটাই, কুমার নদে চলে যাওয়া। কিš‘ স্বামীর আত্মবিশ্বাসে সে কিছুতেই চির ধরাতে পারে না। এজন্য তার রাগ হয়। মাঝে মাঝে ই”ছা হয় একাই চলে যাবে। কিš‘ শেষ সময়ে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। স্বামীর সাথে তার কত স্মৃতি! জন্মের পরপরই তারা প্রায় একসাথে। একবার যখন স্ত্রী বেলে মাছ মানুষের পাতা জালে আটকে গেল, তখন স্বামীই তাকে উদ্ধার করেছিল। রাত প্রায় শেষ শেষÑ আর কিছুক্ষণ গেলেই জেলে আসবে জাল উঠাতে। এদিকে ফাঁস থেকে স্বামী তাকে কিছুতেই ছুটাতে পারছে না। তখন ধীর, ¯’ীর আর শান্ত স্বামীর চোখেমুখে কী ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছিল সেই দৃশ্য কোনদিই ভোলা যাবে না। সেই বেচারাকে একা ফেলে চলে যাওয়া যায় না। স্ত্রী বেলে মাছ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সে-ও থেকে যাবে। বিশ্বাসের জোরে নয়, ভালোবাসার জোরে।
শুক্লা দ্বাদশীর যুবতী আলোয় চারদিক ঝকঝক করছে। আদুরকাটার খালের জায়গায় জায়গায় শুকিয়ে গেছে আবার কোথাও কোথাও খাঁদা হয়ে পানি জমে আছে। চাঁদের আলোয় এরই এক খাঁদায় স্ত্রী আর স্বামী বেলে মাছকে দেখা যা”েছ স্পষ্ট। রাত তৃতীয় প্রহর। আলম নামে এক লোক গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে। খালের পাশেই তার খড়ির বেড়ার ঘর। গাঁজা আর গান দুইটাই আলম ভালোবাসে মনে-প্রাণে। শফিক মাদবরের বাগানে রোজই গাঁজার আসর বসে। আসর শেষে ঘরে ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যায়। ফিরতি পথে আলমের টলোমলো কণ্ঠ ভাসেÑ নাইরে আমার সাধন ভজন... চিরদিন তাই কুপথ গমন...। খাল পার হয়ে যাবার সময় আলম খাঁদার পানির সামনে এসে থামে। আস্ত একখানা চাঁদ পানিতে পড়ে আছে। আলমের ই”ছা হয় সে চাঁদ ধরবে। খাঁদার পানিতে হুটোপুটি করে আলম চাঁদ ধরতে পারে না। ধরে দু’টা বেলে মাছ। মাছ নিয়ে খুশি মনে তার খুপরি ঘরের ঝাপ খুলে বউকে ডাকে, বউ, ওঠ। দ্যাখ কি জিনিস আনছি! আহা ওঠ না সোনা! বউ বিরক্ত গলায় বলে, এতো রাইতে আর চিল্লা-চিল্লি কইরগোনাতো! পোরত্যেক রাইতে চিল্লা-চিল্লি ভাল্লাগে না। ঘুমাও। আলমের উৎসাহ তাতে কমে না। সে ডাকাডাকি করতেই থাকেÑ আহারে দ্যাখ না সোনা! মাছ নিয়া আসছি। এক্কারে জ্যাতা মাছ। এই দ্যাখ ক্যামন লাফায়। আলমের উ”ছাস আলমের বউকে সাড়া দেয় না। তার উ”ছাস এখন ঘুমে। সে ঘুমের ঘোরেই বলে, কলসির মোধ্যে পানি আছে। জিঁয়াইয়া থোও। সকালে ভাজমানে।
রাত প্রায় শেষ শেষ। আলমও ঘুমঘরে তলিয়ে যায়। নিঃশব্দ রাত্রিতে ছোট্ট খুপরি ঘরে তাদের গাঢ় নিঃশ্বাস ভাসে। স্ত্রী বেলে মাছ আর স্বামী বেলে মাছ কলসির পানিতে সাঁতার কাটে। স্ত্রী বেলে মাছের বুক ঠেলে কান্না আসে। সকাল হলেই নিষ্ঠুর মানুষেরা তাদের কেটেকুটে খেয়ে ফেলবে। এই পৃথিবীতে আর থাকা হবে না। সে গভীর অভিমান এবং ক্ষোভ মিশ্রিত কণ্ঠে স্বামীকে বলে, তোমার উদ্ভট ধ্যান-ধারণার জন্যই আমাদের মরতে হল। স্বামী বেলে মাছ নির্ভার ভংগিতে বলে, মরতে হলো বলছো কেন। আমরা তো এখনও বেঁচে আছি। মরতে তো একদিন হবেই। সেটা যে কাল সকালেই সে কথা তোমাকে কে বললো? এইরকম সময়ে স্বামীর সাথে স্ত্রী বেলে মাছের তর্ক করতে মন চাইছে না। তারও বিশ্বাস করতে ই”ছা হয় তারা বেঁচে থাকবে। আহা সে যদি স্বামীর মত এত সহজে বিশ্বাস করতে পারতো!
পূব আকাশে কচি সূর্য উঁিক মেরেছে। তার আলো এখনও চারিদিকে ছড়ায় নি। একটা স্যাঁতসেঁতে নরোমভাব ফুটে আছে। খোপ থেকে মোরগের ডানা ঝাপটানোর শব্দ আসে। আলমের বউ ঘুম থেকে উঠে ঝাপ খুলে দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। দুই হাত দুইদিকে প্রসারিত করে মুখ হা করে আলসি দেয়। দুই হাত দিয়ে অবিন্যস্ত চুলের গোছা মুঠি করে গিঁট দেয়। তারপর প্রতিদিনের অভ্যেস মতো কলসি কাঁখে পানি নিতে কুমার নদে যায়। গতরাতে ঘুমের মধ্যে যে কলসিতে সে মাছ রাখতে বলেছিল সে-কথা মনে থাকে না। মধ্য আঙ্গুলে চিকচিক বালি নিয়ে দাঁত ঘষে কুলকুচা করে। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে মুখ ধোয়। কিনারে রাখা কলসি নিয়ে ছায়াসমেত শাড়ি হাঁটু অবধি তুলে জলে নামে। কান্ধা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কলসি ধোয়। জলে ডুবিয়ে কলসির ভিতরে পরিস্কার করে। সে-সময় খুব স্বাভাবিকভাবে স্ত্রী বেলে মাছ আর স্বামী বেলে মাছ নদের জলে মিশে যায়। থই থই জলে নতুন জীবন পেয়ে স্ত্রী বেলে মাছ ডগমগ চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। স্বামী বেলে মাছ নির্লিপ্ত যেন এমনটাই হবার কথা ছিল।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন