বোবা : কাজী সাইফুল ইসলাম


  কাজী সাইফুল ইসলাম
বোবা



 প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখতাম, কলার বাগানে কাজ করছে আম্মা। কলার কাদি কাধে করে নিয়ে এসে রাখছে উঠনে। বেশ বড় একটি কলার বাগান ছিল আমাদের। ছোটবেলায় ভাবতাম, আব্বাই বুঝি সব করেছেন। পরে জেনেছিলাম, বাগানটি আমার নানার টাকায় কেনা।

একটির পর একটি কালার কাদি যখন তুলে দেয়া হতো মায়ের কাধে, তখন চোখেমুখে রক্তজমে থাকত তার। একটু ধীরে হাঁটলেই ভিষণ চটে গিয়ে আব্বা বলতেন- এই বোবারে বিয়া কইরা আমার সব গ্যালো। তাড়াতাড়ি হাঁট! গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে পা চালাতেন আম্মা। কোনদিন কলার ছড়া সহ উবুর হয়ে পড়ে যেতো আম্মা। তখন হাতের কাছে যা কিছু পেতেন তা দিয়েই আম্মাকে পেটাতেন আব্বা।

তখনও বাবার হাত থেকে আম্মাকে রক্ষা করার বয়স হয় নি আমার। আমি দৌঁড়ে এসে আম্মাকে জড়িয়ে ধরতাম। ভয় আর লজ্জায় থরথর করে কাঁপতেন আম্মা। আর দুগাল বেয়ে চোখের পানি নেমে যেতো বিষাক্ত সাপের মতো। সেদিন আর খাওয়া হতো না আম্মার। কিন্তু আমাকে সাথে নিয়ে বাবা খেতেন পেট ভরে।

সন্ধ্যা নামলেই পুরোপুরি বদলে যেতেন বাবা, গ্রিক মিথ দেবতা এরস হয়ে উঠতেন। এরস ছিলেন ভালোবাসার দেবতা। তখন আম্মাকে মনে হতো মধ্যযুগীয় যৌনদাসী। আর সকালের আলো ফুটলেই ক্রিতদাসীদের মতো হুকুম পালনে ব্যস্ত হতেন।
আমাকে নিয়ে আব্বার বাড়াবাড়ি রকমের আদর ছিল- ক্রিতদাসীর পেটে জন্মনেয়া কোন রাজপুত্রের মতো। যেন রোমান রাজা আর কালো-ক্রিতদাসীর অবৈধ সঙ্গমের জন্ম নেয়া সাদা শিশুটি। সন্তানটি তার সম্মান পেয়েছিল- রাজপুত্র। কিন্তু দাসী রানী হতে পারে নি কোন দিন। 

গভীর রাতে গোঙরানির শব্দ শুনতে পেতাম, গো গো শব্দে মনের কষ্টগুলো উড়িয়ে দিত বাতাসে, রাতের বাতাসে ঘুরত কষ্টগুলি। সূর্যের আলোতে আবার ফিরে এসে বসত গড়ত আম্মার বুকে। আম্মা ছটফট করত খাঁচায় পোষা পাখির মতো। আবার মনে হতো পাখিটির দুটো ডানাই ভেঙে দিয়েছি কেউ, কিন্তু পাখিটি প্রাণপনে চেষ্টা করছে উড়ে যেতে।

কিন্তু কোথায় যাবে?  কোথাও কিছু নেই। গোটা পৃথিবী জুড়েই পানি। ওই একটি মাত্র ঘর তুলে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা, সেখানেই পাখিটির বাস। আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে হা করে নিঃশ্বাস নিতেন মা। আর বারবার কি যেন বলার চেষ্টা করতেন, তার কিছুই বুঝতাম না আমি। শেষে নিজের চেষ্টায় লেখা শিখেছিলেন আম্মা। একদিন দুধমাটির পেনছিল দিয়ে আমার শ্নেটে লিখে দিয়েছিলেন- বড় হয়ে তুই ভাল মানুষ হবি।
সেদিন আম্মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম, আর বলেছিলাম- আমি ভাল মানুষ হবো। অনেক ভাল মানুষ হবো। আমার কথা শুনে সেদিন হেসেছিলেন আম্মা, তার হাসিতে ছিলো পবিত্রতা আর সুখ। তারপর আর কোনদিন দেখি নি সে রকম হাসি। এক জীবনে যে মানুষ এত কষ্ট সহ্য করতে পারে মানুষ, তা আম্মাকে দেখেই জেনেছিলাম আমি।

নক্ষত্রের রাতগুলোতে জেগে চাঁদ দেখতেন আম্মা, আর কি যেন ভাবতেন। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই, আঙুল তুলে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি দেখাতেন। হয়ত বোঝাতে চাইতেন- আমি যেন ওরকম উজ্জ্বল হই।

জোছনা আর বৃষ্টি খুব ভালবাসতেন আম্মা। বর্ষা ছিল আম্মার প্রিয় ঋতু। একদিন শ্লেটে আম্মা লিখেছিলেন- বৃষ্টির পানিতে নোঙলা ধুয়ে যায়, আর জোছনার আলোতে মনের নোঙরা দূর হয়।

তখন আম্মাকে একটু একটু বুঝতে চেষ্টা করতাম আমি। আম্মা যখন কাঁদতেন তখন মনে হতো এরচে’ করুণ এই পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না। মায়ের পিঠের দাগগুলোতে হাত বুলিয়ে দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠতাম। তারপর কান্না সামান্য দমে এলে বলতাম- আমি বড় হলে তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।

আমার কথা শুনে কান্না মাখা চোখে হেসে উঠত আম্মা। সেই কান্নাহাসি মাখা মায়াময় মুখ আমার বুকের ভেতর এমন ভাবে গেঁথে গেছে, যেন লোহা গরম করে মোহর মেরে দিয়েছে কেউ।
ক্লাসে একটুও মন ছিল না আমার, প্রায় প্রতিদিনিই স্যার বকতেন। তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না আমার। বার বার শুধু মনে হতো, আব্বা হয়ত আম্মাকে মারধর করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। স্কুল ছুটি হলে এক মুহূর্তও দাঁড়াতাম না কোথাও। এক দৌঁড়ে বাড়িতে এসে মাকে খুঁজে নিতাম। জিগ্যেস করতাম, বাবা তাকে মারধর করেছিল কি না? অদ্ভুত বিস্ময়ে লক্ষ করতাম, কোন দিনই বাবার প্রতি কোন অভিযোগ ছিল না তার।

প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা সবেদা গাছের গোড়ায় এক জগ পানি ঢেলে দিয়ে গাছের সাথে কথা জুড়ে দিতেন আম্মা। দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম- গভীর ভালোবাসায় ঠোঁট নাড়ছে, আর বারবার গাছের সবুজ পাতায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আবার কতোগুলো মরা পাতা নিয়ে পুতে দিতেন মাটির নিচে। আম্মার ঠোঁট নড়া দেখে মনে হতো গাছের ভাষা বুঝতে পারেন। একবার বৈশাখী ঝড় এসে গাছের একটি ডাল ভেঙে দিয়েছিল। সারারাত কেঁদেছিলেন আম্মা। অনেকদিন খুব মনখারাপও ছিল। তা নিয়ে বাবা খুব মেরেছিল আম্মাকে। আর বোবা বলে বকাঝকা করেছিল। আমাদের সংসারে ভাতের অভাব ছিল না। ছিল শুধু সুখের অভাব।

তখন থেকে ভাল আর সুখ শব্দ দুটির উপর লোভ হতো আমার। আম্মা লিখেছিলেন, ভাল মানুষ হলেই সুখি হওয়া যায়। কিন্তু ভাল মানুষ কি করে হতে হয় তা জানা ছিল না। খুব মনখারাপ হতো আল্লাহর উপর। আম্মাকে কেন বোবা বানালেন তিঁনি! আম্মা কত ভাল মানুষ। কথা বলতে জানলে নিশ্চয়ই আমাকে শিখিয়ে দিতেন- কি করে ভাল মানুষ হতে হয়।

আম্মার কষ্ট আর সহ্য হতো না। একদিন পাশের বাড়ির চাচিকে জিগ্যেস করেছিলাম, বাবা তো আম্মাকে শুধু বোবা বলে গালি দেয়, মারধর করে। তাহলে বিয়ে করল কেন! সেদিন চাচির কাছে শুনেছিলাম আসল ঘটনা। বাবা বিয়ে করেছিলেন টাকার লোভে। আর আম্মা তো দেখতে সুন্দরী ছিলেন। নানার টাকা দিয়েই আব্বার এতো টাকা হয়েছে। আগে তার কিছুই ছিল না। দিনমজুরের মতো কাজ করে বেড়াত হাটেবাজারে। টাকা আর নারীর প্রতিও আব্বার লোভ ছিল। যখন টাকা হলো, তখন প্রায় রাতেই বাইরে থাকতেন আব্বা। আর গোটারাত ধরে কাঁদতেন আম্মা।

তখন বুঝতাম না, আম্মা কেন কাঁদেন। বাবা বাড়িতে নেই, এতো সুখের খবর। পরে বুঝেছিলাম, নারীরা তার স্বামীর সব অত্যাচার সহ্য করতে পারে- কিন্তু অন্য মেয়েমানুষের বিছানায় রাত কাটাবে তা সহ্য করতে পারে না।  আম্মার কষ্টগুলো মিশে যেতো অন্ধকার রাতে, গাছের পাতায়, উঠনের ধুলোয় আর আমার মনের গলিঘুঁজিতে।

জায়নামাজে বসে দুহাত তুলে কাঁদতেন আম্মা। আমিও আম্মার পাশে বসে আল্লাহর কাছে প্রতিদিন বলতাম, আমাকে তুমি তাড়াতাড়ি বড় করে দাও।

আল্লাহ যেন আমার কথা শুনেছিলেন। বয়স অনুপাতে আমি একটু বেশিই লম্বা হয়েছিলাম। অন্য সবার চে’ বুদ্ধিও ভাল ছিল। হঠাৎ একদিন আর একটি বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এলো আব্বা। আম্মা সেদিন ক্রোধে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। সেই প্রথম আমি শুনেছিলাম বোবার কান্নার শব্দ। ঠিক করেছিলাম, আজ রাতেই আব্বাকে খুন করবো। কিন্তু কিছুই করা হয় নি।  ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিলেন আম্মা। আব্বার কোন গরজ ছিল না আম্মাকে বের করার।

শেষ পর্যন্ত অনেক রাতে দরজা ভেঙেছিলাম আমি। দেখি- মায়ের মুখে রক্তফেনা! আর আমার সে পুরনো স্লেটটি পড়ে আছে তার পাশে। তখনো আম্মার হাতে ছিল দুধমাটির ভাঙা পেনসিল। স্লেটে লেখাছিল- বড় হয়ে ভাল মানুষ হয়ো বাবা।

কি যেন হয়ে গেল আমার। কোথায় চিৎকার করে কেঁদে আকাশ ফাটাব, তা নয়। একফোটা পানিও ঝরেনি আমার চোখ থেকে। বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। অদেখা কারো ওপর অভিমানে ভরে উঠেছিল বুক। সেদিন কাঁদতে পারি নি বলেই হয়তো সারা জীবন ধরে কেঁদে চলেছি আমি। সেদিনই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আর কোনদিন কথা হয় নি আব্বার সাথে।

ঠিক করলাম, এ জীবনে আর কথা বলবো না। লোকে বলত, মায়ের শোকে বোবা হয়ে গেছে। আমাদের কলা বাগানে পাশেই ছোট একটি ঝুপড়ি তুলে নিয়েছিলাম। সেখানেই থাকতাম আমি। রাত গভীর হলেই শুনতে পেতাম কান্নার শব্দ। আর সকালের আলোতে খুঁজে বেড়াতাম রক্তের দাগ। মায়ের পা ফেটে ঝরেছিল কদিন আগেও।



Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.