রবীন্দ্রচেতনায় বিজ্ঞানসভা
ইন্দ্রনীল মজুমদার
বিজ্ঞানসভা- অর্থাৎ এমন একটি সভা যেখানে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হবে এবং যার পরিচালনা থেকে শুরু করে সমস্ত সদস্যগণ বিজ্ঞানমনস্ক বা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার অধিকারী হবেন। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি বহু বিজ্ঞানসভা রয়েছে যারা বিভিন্ন উপায় বিজ্ঞানের কথা প্রচার করে চলেছে, কুসংস্কারও অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করে চলেছে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই,পত্র-পত্রিকা,বুলেটিন ইত্যাদি প্রকাশ করে বিজ্ঞানচর্চাকে সাধারণের মধ্যে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও, বৈজ্ঞানিক সচেতনতা ও বৈজ্ঞানিক ভাবনা-চিন্তার বৃদ্ধি ঘটাতে বিজ্ঞানসভাগুলি নানান কাজকর্ম করে চলে। বর্তমান এই প্রবন্ধটিতে আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞানসভা নিয়ে চিন্তাধারার সাথে পরিচয়লাভ করব।
কবিগুরু একটি বিজ্ঞানসভা নিয়ে তাঁর চিন্তারধারা ও মতামত জানিয়েছেন তাঁর লেখা ‘বিজ্ঞানসভা’ প্রবন্ধটিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বিশেষ বিজ্ঞান অনুরাগী মানুষ যার প্রতিফলন তাঁর লেখা বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘বিশ্বপরিচয়’ থেকে তো বটেই এমনকি তাঁর নানান বিজ্ঞান প্রবন্ধে, বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠিপত্রে পেয়ে থাকি। তাই, বলতেই পারি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমস্ত বিষয়ের মতোই বিজ্ঞান ও তার প্রচার নিয়েও নানান চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। উল্লেখিত সেই প্রবন্ধটিতে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ শুরুতেই উল্লেখ করেছেন দেশের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স’-এর কথা।
তিনি লিখেছেন যে স্বর্গীয় মহাত্মা মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয় সরকারের(তৎকালীন ইংরেজ সরকারের) উৎসাহে ও দেশের লোকের আনুকূল্যে একটি বিজ্ঞানসভা স্থাপন করে গেছেন। এই দেশে বিজ্ঞান প্রচার করাই যার উদ্দেশ্য।এই বিজ্ঞানসভার কিন্তু দেশের অন্যান্য লোকহিতকারী সংস্থার মতো দরিদ্র অবস্থা বা নিঃস্ব অবস্থা নয়। এই সংস্থার নিজস্ব চালচুলো বা গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ দ্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, তৎকালীন পরাধীনতার যুগে দেশে বিজ্ঞানচর্চার ভালোরকম সুযোগ সুবিধা নেই। প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন কিছু ব্যবস্থা হলেও, সেখানে পরাধীন ভারতবাসীদের বেশি ভরসা রাখার জায়গা নেই কেননা ভারতীয় ছেলেদের বুদ্ধি নেই- ইংরেজ প্রভুদের থেকে এরকম খোঁটা খাবার সম্ভাবনা প্রবল। কবির এই কথাগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রেসিডেন্সি কলেজে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অধ্যাপক চদ্রভূষণ ভাদুড়ি, আলেকজান্ডার পেডলার সাহেব সহ ইত্যাদি দেশে বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথপ্রদর্শকদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানপাঠের সুব্যবস্থা হয়েছিল। তবে, সেখানে ইংরেজ অধ্যাপকদের কাছে ভারতীয় ছাত্ররা কেমনভাবে লাঞ্চিত হতেন তার নজির ওটেন সাহেবের ভারতীয় ছাতৃরদের প্রতি দুর্ব্যবহারের ঘটনা থেকে জানতে পারি। যাইহোক, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে, বিজ্ঞানচর্চার এই দুর্দিনের মাঝেও, বিদ্যাদুর্ভিক্ষের মাঝেও বিজ্ঞানসভা তার 'পরিপুষ্ট ভাণ্ডারটি' নিয়ে সুস্থভাবে বসে আছে।এই বিজ্ঞানসভার হলে মাঝে মধ্যে বিজ্ঞানের লেকচার দেওয়া হয় তা কবি শুনেছেন, কিন্তু কবির আক্ষেপ সেইসব লেকচারগুলি কলেজের লেকচারের মতো। কবির মতে, এ ধরনের লেকচারের বন্দোবস্তের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি কেন এ কথা বলেছেন? কেননা তিনি সর্বদা চাইতেন বিজ্ঞানের লেকচার হোক সাধারণ মানুষের জন্যে, তাদের মাতৃভাষায়। সাধারণ মানুষ যাতে খুব সহজেই বিজ্ঞানের কথাগুলো বুঝতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে, বর্তমানকালের বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ,পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ সহ বিভিন্ন বিজ্ঞানের সংগঠন এরকম বিজ্ঞানসভার বাংলায় আয়োজন খুব সহজ ভাষায়, সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারে তার জন্য উপস্থাপিত করে থাকে। তবুও কবি আশ্বস্ত হয়েছেন এটা জেনে যে এদেশে একটি বিজ্ঞানসভার অস্তিত্ব আছে এবং যার যন্ত্রপাতি, অর্থ কিছু হলেও আছে।
রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছেন যে, আমাদের যা নেই তার জন্য আমরা রাজার দ্বারে ধন্না দিয়ে পড়ি এবং চাঁদা জোগানোর জন্যে ঘুরে ঘুরে গলদঘর্ম হয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের যা যা আছে, তাকে কিভাবে কাজে লাগাব তা নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না বা দৃষ্টিপাত করি না। আমাদের এইসব অভাবের মধ্যেও এই যে বিজ্ঞানসভা ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কবি জিজ্ঞেস করার সুরে বলেছেন, এর কি ঘুম ভাঙাবার সময় হয় নি।
কবি আরেকটা ব্যাপারে আক্ষেপ জানিয়েছেন আর তা হল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো তৎকালীন যুগের দিকপাল বাংলার তথা দেশের বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানসভা কাজে লাগাচ্ছে কোথায়? এই দুই বিজ্ঞানের পণ্ডিত তখন সবে দেশবিদেশে যশোলাভ করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানসভা কি তাঁদের বিন্দুমাত্র কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিল? দেশের বিজ্ঞানসভা এদেশের বিজ্ঞানীদের মুখের দিকে যদি না তাকায় তবে তার বিন্দুমাত্র গৌরব বা সার্থকতার কথা কিছু থাকবে না বলে কবি মনে করেন। অর্থাৎ, একটি বিজ্ঞানসভার প্রধান দায়িত্ব হল দেশের বিজ্ঞান-সাধটদের কাজে লাগানো। তিনি এও জানিয়েছেন যে, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কয়েকজন অধ্যবসায়ী ছাত্রদের মানুষ করে তোলার ভার অর্থাৎ বিজ্ঞানচর্চায় আরও উৎসাহ দেওয়ার ভার ও বিজ্ঞানচর্চায় সাহায্য করার কাজ যদি বিজ্ঞানসভা গ্রহণ করে তবে সভা এবং দেশ দুজনেই ধন্য হবে। অর্থাৎ, কবির দৃষ্টিতে বিজ্ঞান ছাত্রদের বিজ্ঞানচর্চায় আরও উৎসাহিত করা ও তাদের গবেষণার পথ প্রশস্ত করাই হল বিজ্ঞানসভার কাজ।
এ তো গেল বিজ্ঞানসভার বিজ্ঞান প্রচারের প্রথম উপায়ের কথা। স্বদেশে বিজ্ঞান প্রচার করার দ্বিতীয় সদুপায় হল স্বদেশের ভাষাতেই অর্থাৎ স্বদেশের বা প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষায় বিজ্ঞান প্রচারের কাজ করতে হবে। জানা গেছে যে, তৎকালীন যুগে কোনো রোগ বা মহামারী হলে সরকার পক্ষ থেকে যে নোটিশ বা করণীয় সম্পর্কে যা নির্দেশ আসত তা থাকত ইংরেজি ভাষায় যা এদেশের মানুষ বুঝতে পারত না। ফলে কাজের কাজ কিছু হত না। দেশের কিছু শিক্ষিত মানুষ এইসব নোটিশ বা তার মর্ম বাংলায় বা দেশের অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করে দেশের মানুষকে বিশেষ করে নিরক্ষর, অশিক্ষিত মানুষকে বোঝাতেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আজীবন মাতৃভাষার পূজারী, মাতৃভাষা বাংলার একনিষ্ঠ এক সাধক। তাই তিনি বিজ্ঞান সহ সমস্ত বিষয়ের চর্চা মাতৃভাষায় করার উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর এ বিষয়ে যা মনে হয়েছিল তা তাঁর ভাষাতেই তুলে ধরছি।
"যতদিন পর্যন্ত না বাংলাভাষায় বিজ্ঞানের বই বাহির হইতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটির মধ্যে বিজ্ঞানের শিকড় প্রবেশ করিতে পারিবে না।"– মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে এক সুগভীর উপলব্ধি যা চিরন্তন।
তখনকার দিনে অনেকেই বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় সহ কয়েকজন বিজ্ঞান পণ্ডিত যাঁরা দেশের ভাষায়, দেশের লোককে বিজ্ঞানের কথা প্রচার করে চলেছেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁদের নাম চিরকাল লেখা থাকবে। কিন্তু বিজ্ঞানসভা বাংলায় বিজ্ঞান প্রসারের কাজ কিছু করছে কিনা সে ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সন্দিহান থেকেছেন।
দেশে বিজ্ঞান প্রচারের ক্ষেত্রে যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিজ্ঞানসভার করার দরকার অর্থাৎ "দেশের প্রতিভাবান ব্যক্তিদিগকে ও সুযোগ্য অনুসন্ধিৎসুদিগকে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ দান করা ও দেশের ভাষায় সর্বসাধারণের পক্ষে বিজ্ঞান শিক্ষাকে সুগম করিয়া দেওয়া"– এই কাজগুলির মধ্যে কোনোটাই বিজ্ঞানসভা পালন করছে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য এর জন্য বিজ্ঞানসভার সম্পাদক সহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেননি। তিনি মনে করেছেন যে, মন্দিরে প্রদীপ জ্বেলে রাখবার ভার তাঁদের উপর আছে মাত্র। কিন্তু, বিজ্ঞানসভা আমাদের সকলের। এই সভা যদি তার সমস্ত উপকরণ নিয়ে নিষ্ফল হয়ে পড়ে থাকে তবে তার জন্য আমরা প্রত্যেকেই দায়ী। কেননা, বিজ্ঞানসভাকে কাজে লাগানোর দায়িত্ব কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, বরং আমাদের সকলের। সেই বিজ্ঞানসভার চালিকাশক্তি আমরা সকলেই।
তখন আমরা পরাধীন জাতি ছিলাম তাই স্বকীয় শাসনের দাবি জানাতাম বা তা অধিকারের জন্য রাজদ্বারে প্রার্থনা করতাম। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন যে, বিজ্ঞানসভার মতো ব্যাপারগুলি বা প্রতিষ্ঠানগুলি যদি দেশের জমি জুড়ে নিষ্ফল হয়ে পড়ে থাকে তাহলে প্রতিদিন প্রমাণ হতে থাকে যে আমরা স্বকীয় শাসনের অধিকারী নই। কেননা, যে জিনিসটা আমাদের অধিকারে আছে তাকে যদি আমরা ঠিকমতো কাজে লাগাতে না পারি তবে যা নেই তা পেলে যে আমরা চতুর্ভুজ হয়ে উঠব– এটা বিশ্বাস করা কি যায়? এই একই কারণে বিজ্ঞানসভার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা কর্মশূন্য বা নিষ্ফল হয়ে থাকা আমাদের জাতির পক্ষে লজ্জার বিষয় এবং "নিত্য কুদৃষ্টান্ত ও নিরুৎসাহের কারণ।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এইসব ভাবনা-চিন্তা তাঁর অসীম দূরদর্শীতার প্রমাণ দেয়।
তাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিজ্ঞানসভাকে সচল রাখতে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এই সভা আমাদের সবার। তিনি বিজ্ঞানসভাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে প্রস্তাব দিয়েছেন যে, বিজ্ঞানসভা যখন আমাদের দেশের জিনিস, তখন একে হাতে নিয়ে এর দ্বারা যতদূর সম্ভব কাজ করিয়ে নেওয়াই হবে আমাদের কর্তব্য। কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, "স্বজাতির অন্তত একটা জড়তা ও হীনতার প্রত্যক্ষ প্রমাণকে দূর করিয়া দিতে যেন কিছুমাত্র বিলম্ব না করি।"
তা এই ছিল রবীন্দ্র ভাবনা-চিন্তায় একটি প্রকৃত বিজ্ঞানসভার দৃষ্টান্ত। আমরা তাঁর প্রস্তাব ও ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি আদর্শ বিজ্ঞানসভা স্থাপন করে আগামীদিনে মাতৃভাষায়, সাধারণ মানুষের জন্যে বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্থ করে দেশ ও জাতির উন্নতি ঘটাতে যদি পারি তাহলে তা হবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি আমাদের একটু হলেও ঋণ শোধ করা বা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিবসে আমাদের তরফ থেকে এক সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন