অভিসার : স্বপন কুমার মজুমদার

https://www.banglasahityo.com/

অভিসার


স্বপন কুমার মজুমদার


সে ছিলো বিজয়া দশমীর রাত। দূর্গা মায়ের প্রতিমা বিসর্জন হোয়ে গিয়েছে। থেমে গিয়েছে আনন্দ কোলাহল। নিঃস্তব্ধ নিশি । ক্লান্ত মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। শুধু আকাশে চাঁদের আলো আর তারাদের যেন পাহারা চলছে চারিদিকে। কিন্তু আজ ঘুম আসছে না পুলকের।

    সে শুধু মানসীর কথা ভাবছে। নবরাত্র প্রায়-ই সময় সে মানসীর সাথে কাটিয়েছে। অফুরন্ত আনন্দ অনুভব কোরেছে সে।

  দীর্ঘদিন ধরে পুলক মানসীকে ভালোবেসে আসছে । কিন্তু আজও সে মানসীর হাতখানা ধোরে বোলতে পারিনি " মানসী, তোমাকে আমি ভালোবাসি ।"
      
      দূর্গা পূজার খরচ বাবদ সে মানসীকে নগদ অনেক টাকা দিয়েছে । কিছু ইমিটেশনের গহনাও কিনে দিয়েছে । পরার জন্য নুতন সালোয়ার কামিজ এনে দিয়েছে । তবু কোথায় যেন পুলকের সন্দেহ থেকে যায় মানসী তাকে উজাড় কোরে দিতে চায় না ।

   কিন্তু এত কাছে পেয়েও পুলক তাকে উপভোগ কোরতে পারে না, এই জায়গায় সে বেশী অস্থিরতা বোধ করে। মানসী যে পুলককে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে না এমন নয়, কিন্তু সে যেন চায় না পুলকের সাথে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক ।

   পুলক মাঝে মাঝেই মানসী কে অঙ্ক শেখাতে ওদের বাড়িতে যাতায়াত করে । মানসীর বাবা-মা ওদের সম্পর্কে কোনো অনৈতিক কিছু দেখতে পান না। দেখবার চেষ্টাও খুব একটা করেও না। তারা তাদের মেয়ের উপর বিশ্বাস করে যে, মানসী কোনো ভুল পথে পা বাড়াবে না। তাই পুলকের বাড়িতে আসা-যাওয়ার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

     মানসীর অপরুপ রুপ সৌন্দর্য্যের মোহে পুলক নিজেকে আর যেন সামলে রাখতে পারে না । তার সব সময় মনে হয় একবার মানসীকে যদি বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরতে পারত ! যদি তার ঐ টোল খাওয়া গালে একটা চুমু দিতে পারত হয়ত খুশিতে ভরে যেত তার হৃদয়। কিন্তু মানসী যেন সব সময় সতর্ক থেকে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করে। তাতে পুলক মনে মনেই যেন একটু ক্ষুব্ধ হোয়ে ওঠে মানসীর প্রতি ।

    মানসী এখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী । সবে সে যৌবনের অনুভূতি পেতে শুরু করেছে ।পুলকের ভালোবাসা , আন্তরিকতা মানসীর মনে যে আনন্দ অনুভব করায় না, তা নয় । সে বোঝে পুলকের দৃষ্টিতে কামুকতার আভাস ফুটে ওঠে । কিন্তু মানুসী সে দৃষ্টি উপেক্ষা কোরে চলে । খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায় না।

    মানসীর এই গুরুত্বহীন ভাবনাকে পুলক সহ্য কোরতে পারেনা, ভাবে মানসীর জন্য সে অনেক কিছু কোরেছে। তার পিছে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছে বহুবার । কখনো মানসীর প্রয়োজন বোধে স্কুলের বই কিনতে শহরে গিয়েছে। মেলায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে । কত কিছু খাইয়েছে তাকে । কখনো আমলেট বিরানি ফুচকা ইত্যাদি। সব খরচ জুগিয়েছে পুলক ‌। কিন্তু দিন দিন মানসীর উপেক্ষা তাকে বিরক্তি ধরিয়ে দেয় । তাই সে অতিষ্ঠ হোয়ে ওঠে । তার যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে।

    আজ মানসীকে  কাছে পাবার জন্য পুলক যেন আরো অধীর হোয়ে ওঠে । সেই চিন্তায় পুলকের চোখে ঘুম নেই। সে তার কাম-বাসনাকে যেন আর দমন কোরে রাখতে পারছে না। দূর্গা মায়ের বিসর্জন শেষে সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । মানসীর পরিবারের সবাইও নিদ্রা মগ্ন অবস্থায়। কিন্তু পুলকের চোখে ঘুম নেই । সে আজ শেষ দেখে নিতে চায়।

   মানসীদের বাড়িতেই দূর্গা মন্দির ।  বাড়ির চারি পাশে সকল দোকানদার ঘুমিয়ে আছে । পুলক তার এক দোকানদার বন্ধুর মত দোকানে আশ্রয় নিয়েছে । তার মনের অভিসন্ধি আজ সে মানসীর কাছে তার শয়নাগারে যাবে । সে তার কাম-বাসনাকে চরিতার্থ করবার চেষ্টা করবে । পরিণাম যে কি হবে পুলক তা ভেবে উঠতে পারে না, ভাবতেও চায় না ।

    অনেক ভেবেছে সে । কিন্তু বেশি ভাবতে গিয়ে আজ পর্যন্ত সে  মানসীকে একটু জড়িয়ে ধরতেও পারিনি । তাকে তাঁর সম্মান বোধ টুকু তাকে বারবার থামিয়ে দিয়েছে । কিন্তু আর না । নয়টা দিন-রাত পাশাপাশি থেকে সে যেন তার কামলিপ্সাকে বেশি কোরে জাগিয়ে তুলেছে । নবমীর রাতে পুলক খোঁজ নিয়েছেন মানসী কোথায় শোয়, কোথায় ঘুমায়। কার পাশে বা থাকে । যদিও সে অনেক দিন তাদের বাড়ি যাতায়াত করে এ খবর সে রাখেনি। কিন্তু আজ সে সব খোঁজ পেয়ে গেলো । দশমীর দিন মানসী অনেক আনন্দ-ফুর্তি কোরেছে। বড় ক্লান্ত । গভীর ভাবে সেও ঘুমাবে । পুলক আজিগের রাত তাই হাত ছাড়া কোরতে চায় না। সে মানসীর কাছে যাবে। তার ঘুম ভাঙাবে। তাকে জড়িয়ে ভালোবাসার সুখ অনুভব করতে চায়।

    কিন্তু পুলকের ভয় যদি সে ধরা পড়ে । মানসী যদি হঠাৎ চিৎকার কোরে ওঠে। তবে কি হবে পুলকের !  যে সম্মানের ভয়ে সে আজ পর্যন্ত মানসী কে একটু ছুঁয়ে দেখেনি সে এমন একটা ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হবে কি কোরে !

     পুলক নিজেকে খুব শক্ত করে প্রস্তুত করে। তাকে যেন তার কাম উন্মাদনা স্থির থাকতে দেয় না । সে তার মনের ভয়টুক ঝেড়ে ফেলতে চায় । সে ভালোই জানে মানসীর বাড়ির সবাই গভীর ভাবে ঘুমাবে।

 

রাত প্রায় দটো বেজে গিয়েছে । পুলক তখনো বিছানায় বসে আছে । দেখলো তার দোকানদার বন্ধুটি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। সে খুব সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দেখলো চারিদিকে সব দোকানদাররাও ঘুমোচ্ছে । তাদের নাক ডাকা শব্দ শুনতে পাচ্ছে । চাঁদের আবচ্ছা আলোতে পুলক তখন ধীরে ধীরে মানসীদের উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে । ঐ তো মানসী আজ ভাই দুটির পাশে বারান্দায় ঘুমোচ্ছে । অপর বিছানায় তার বাবা-মা । সবাই যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে পুলকের । একবার ভাবছে সে এমন বর্বরোচিত ব্যবহার  কোরবে কেন। আর মানসীর যদি সম্মতি না থাকে তবে তো তাকে চিরদিনের মতো মানসীকে হারাতে হবে। তার ভালোবাসা হবে শত্রুতায় পরিনত। এ পরিবারেও সে আর ফিরে আসতে পারবে
না। কিন্তু চোরা কভু কি শোনে ধর্মের কাহিনী । পুলক কোনো ভাবে নিজেকে সংযত কোরতে পারছে না।

   সে অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রেখে খুব সন্তর্পনে
মানসীর পাশে এসে বসলো। জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলোতে দেখলো অপর বিছানায় তার বাবা মা ঘুমিয়ে আছে। পুলক এবার আস্তে আস্তে মানসীর বুকে হাত রাখবার চেষ্টা করতে লাগল । কিন্তু যেন সাহস কোরে উঠতে পারল না। পুলক এবার মানসীর পিঠের দিকে কাত হোয়ে শুয়ে পড়লো । অসাড় ঘুমে অচেতন মানসী ।

    পুলক এখন মানসীকে পাশ ফিরাবার জন্য তার হাত ধরে নিজের দিকে ধীরে ধীরে টানতে থাকে । অচেতন মানসী একটু 'হু' কোরে পাশ ফিরে শোয়। এবার মানসীর নিঃশ্বাস পুলকের মুখে উষ্ণ তাপ অনুভব করাতে থাকে । কিন্তু পুলক বুঝতে পারে না এখন সে কি কোরবে। মানসী যে অঘোরে নাক ডাকছে । একটা ঘুমন্ত মানুষ মৃতবত অবস্থায় শুয়ে আছে। এখন তো তাকে জড়িয়ে ধোরে সুখের অনুভব করা যায় না।

  পুলক ভাবে তবে কি  সে মানসীকে জাগাবে । তার সম্মতি ছাড়া কি ভাবে সে তার সাথে অনৈতিক কিছু কোরতে পারে! কিন্তু তাকে জাগাতে গেলে যদি সে চিৎকার কোরে ওঠে তবে কি হবে । পুলকের তো বাসনা মিটবে না। কিন্তু সে যে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না । এত নিকটস্থ হোয়ে সে মানসীর সমস্ত শারীরিক সৌন্দর্যের প্রতীক ঐ উন্নত বক্ষ যুগলের কথা ভেবে যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।  

   সে দাড়িম্ব ফলের মত উন্নত বক্ষের উপর আবার হাত রাখার প্রয়াস করে । কিন্তু কম্পন হস্ত থেমে যায় । তার সাহসে কুলায় না । আচমকা মানসী যদি জেগে যায় । পুলককে যদি ধূৎকার কোরে । ছি ছি কোরে ওঠে। যদি তাকে মেনে না নেয় ।

   তবু পুলক মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে । তার কম্পিত হাতখানা মানসীর বুকের দিকে আবার এগিয়ে নিয়ে যায় । আবার ফিরিয়ে আনে । পুলক যেন থর্ থর্ কাঁপতে থাকে । তার সাহসে কুলায় না । এবার বুকের মধ্যে তার দুরু দুরু কম্পন উঠেছে ।

    একি ! মানসী কি জেগে গিয়েছে ! আবার ' হু ' করলো কেন ! পাশ ফিরবার চেষ্টা কোরছে নাকি! যদি জেগে যায় ! পুলক চট কোরে উঠে বসে । চিৎকার করবার আগেই হয়ত সে দৌঁড়ে পালাবে এমনি ভাবতে থাকে। কিন্তু না, মানসী আড়মোড়া খেয়ে আবার নিশ্চুপ হোয়ে যায় । পুলক ভাবতে থাকে, হয়ত বা মানসী জেগে আছে । তাই কিছুটা সাহসে ভর কোরে পুলক বলে, মানসী আমি তোমার বন্ধু । তোমার কাছে এসেছি।

     কোই মানসী তো কিছুই বলে না ! তবে কি মানসীর ঘুম এখনো ভাঙেনি! কিন্তু পুলক এবার মনে মনে খুব অশান্ত হোয়ে ওঠে । সে মানসীর কপালে আস্তে আস্তে হাত রাখে । পুলক বুঝবার চেষ্টা করে, মানসীর ঘুমের গভীরতা কত।  হাঁ, এখনো মানসী ঘুমে অচেতন । কোনো সাড়া নেই। পুলক তার হাতখানা ধরে একটু একটু করে নাড়া দিতে থাকে।


 এবার মানসী ' হু ' করে ওঠে। পুলক আবারো বলবার চেষ্টা করে ' মানসী আমি তোমার দাদা পুলক । কিন্তু কিছু বলবার আগেই মানসী চট কোরে বিছানায় উঠে বসে। গলার স্বর একটু চড়িয়ে ভয়ভীতি কন্ঠে বলে, কে তুমি ! কে তুমি এখানে ?

    পুলক বেগতিক অবস্থা বুঝতে পেরে এক লাফে বারান্দা থেকে উঠানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর মানসী সজোরে চিৎকার কোরে ওঠে চোর চোর ।

   এমন সময় মানসীর বাবা-মা  জেগে গিয়েছে। ছোট ভাই দুটি ও জেগে গেলো। মানসী যেন থর্ থর্ কোরে কাঁপছে । একবার কানে হাত দিয়ে দেখলো তার কানের ঝুমকো দুটি আছে কিনা ।

    মানসীর বাবা ঘুম জড়িত কন্ঠে জানতে চাইলো কি হোয়েছে মা ! চেঁচিয়ে উঠলি কেন ? চোর চোর বলে চিৎকার করছিস কেন ? মানসী বলল, বাবা চোর এসেছিল বোধহয় । আমার কানের ঝুমকো নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারিনি । আমি জেগে গিয়েছি । চোর পালিয়েছে।

     এদিকে পুলক উঠানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পায়ে চোট পেলো খুব । সেই অবস্থায় সে দৌঁড়ে তার বন্ধুটির দোকানে ঢুকে পড়লো।  চোর চোর শব্দ শুনে অনেক দোকানদার জেগে গিয়েছে । অনেকে টর্চ নিয়ে চোরের খোঁজে মানসী দের বাড়ির চারি পাশে দেখবার বৃথা চেষ্টা করছে । আর পুলক তার বন্ধুটির সাথে মানসীদের উঠানে এসে দাঁড়ালো ।  ভাবখানা এমন ছিলো যেন সে ঐ পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে এসেছে। পুলক সাহসে ভর কোরে যেন কম্পিত গলায় জানতে চাইলো, মানসী চোর কোন দিকে গেলো । জোৎস্নার অস্পষ্ট আলোতে মানসী দেখতে পেলো পুলককে । ভাবল, হ্যাঁ পুলকের মতোই তো একটা ছায়ামূর্তি সে পালাতে দেখেছিলো । তবে কি রাতের অন্ধকারে অভিসারে এসেছিল পুলক । মানসী যেন নিঃস্তব্ধ নির্বাক হোয়ে গেলো।
      

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.