দ্বারকানাথ থেকে বিপিনচন্দ্র ; শিল্পক্ষেত্রে বাঙালির নবজাগরণ
দেবব্রত মন্ডল
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ বলতেই আমাদের মনে পড়ে ঠাকুরবাড়ির কথা। রবীন্দ্রকাননের রাস্তায় কিছুক্ষন ইতিউতি হাঁটার পর চোখে পড়বে জোড়াসাঁকোর মোড়। এই জোড়াসাঁকোর মোড়ের অদূরেই অবস্থিত দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি।যা ছিল ঊনবিংশ শতকের বাংলার সাহিত্য শিল্পকলা সঙ্গীতের এক অন্যতম পীঠস্থান। সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ' ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা ' বইতে লিখছেন - "... চিৎপুরের আশপাশ থেকেই কয়েকটি পরিবারকে ঘিরে বয়ে চলেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁর স্নিগ্ধ হাওয়া যা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল পরবর্তীকালে।" বলাইবাহুল্য এই গুটিকয়েক পরিবারের মধ্যে ঠাকুর পরিবার ছিল অন্যতম।তবে এরই সাথে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো, ঊনবিংশ শতকে বাংলার সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি ঠাকুরবাড়ির হাত ধরে যে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল তারই মাঝে বারংবার আড়ালে চলে যায় বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব ব্যবসা - বাণিজ্যের ইতিহাসটি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে ঠাকুরবাড়ির মতো একটি আধুনিক পরিবারের জয়যাত্রার শুভ মহরত কিন্তু অনুষ্ঠিত হয় এই ব্যবসা - বাণিজ্যের হাত ধরেই।এই ইতিহাসের সুলুকসন্ধানের জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও বেশ কিছু বছর পিছনে।১৮৪২ সালের ৯ই জানু়য়ারি দ্বারকানাথ প্রথমবার বিলেত অভিমুখে যাত্রা করলেন - সেই শুরু তারপর একপ্রকার অপ্রতিহত ছিল দ্বারকানাথের জয়যাত্রা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে দ্বারকানাথের ব্যবসা - বাণিজ্যের কলেবর এতটাই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় যে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ভারত পর্যন্ত জাহাজ চলাচল এবং লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত রেলপথ বিস্তারের পরিকল্পনাও করেন।এই দুটি সামান্য তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয় ইংরেজদের আধিপত্যের দিনেও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের সাথে রীতিমতো টক্কর দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ।উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ বলতেই শুধুমাত্র সাহিত্য বা শিল্পরসিক বাঙালির যে চেহারা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়েও বাঙালির চিরাচরিত ' ঘরকুনো ' ইমেজটিকে নির্দ্বিধায় অগ্রাহ্য করে গেছেন তিনি।
তবে আজকের এই গল্প আদৌ দ্বারকানাথকে নিয়ে নয়।এই গল্পের সূত্রপাত কলকাতার বালিগঞ্জ ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী এলাকায় তৈরি একটি কারখানাকে ঘিরে।গল্পের নায়ক বিপিনচন্দ্র পাল।তবে সে কথা পরে তার আগে আমরা জানতে চেষ্টা করি জগদীশ্বর ঘটককে।কে এই জগদীশ্বর ঘটক?এক কথায় বলতে গেলে জগদীশ্বর ঘটক ছিলেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের জনক।তার হাত ধরেই ১৮৯৬ সালে তৈরি হলো রাইস হাস্কিং মিল।তবে ১৮৯৬ সালেরও বেশ কিছু বছর আগে জগদীশ্বর ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে ফেলেছেন তার নাম। হাস্কিং মেশিনের আগেই তিনি তৈরি করে ফেলেছেন জলচর সাইকেল।সেই ধারাকেই পরবর্তীকালে বয়ে নিয়ে গেছেন বিপিনচন্দ্র পাল।এই বিপিনচন্দ্র পাল তৈরি করেন মোটরগাড়ি ইঞ্জিন।এবং সেই ইঞ্জিন প্রথমবারের মতো তৈরি হয় কলকাতা শহরের বুকেই বালিগঞ্জ ফাঁডি অঞ্চলে।তার তৈরি ইঞ্জিনের নির্মাণকাজ এতটাই নিখুঁত ছিল যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। বিপিনচন্দ্র পালের তৈরি করা প্রথম গাড়িটির নম্বর ছিল ৩৫৯৭৭।বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গাড়িটির ক্রেতা।এমনকি মতিলাল নেহেরু থেকে মদনমোহন মালব্য এমন অনেক ব্যক্তিত্বই ছিলেন সেই ঐতিহাসিক গাড়ির সওয়ারির তালিকায়।
বস্তুতপক্ষে কলকাতা একসময় ছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী।ফলে সেই সময় থেকেই কলকাতার গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে ব্রিটিশদের কাছে।সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিপিনচন্দ্র পালের এই মোটরগাড়ি কারখানা ছিল ব্রিটিশ আনুগত্যের বিরুদ্ধে মোক্ষম এক জবাব।কারণ সেই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে ব্যবসা - বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের উপরেই অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিলেন ভারতবাসীরা, যাকে ছুঁড়ে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং বিপিনচন্দ্র পালের স্বদেশী কারখানা ছিল তারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঊনবিংশ শতকের ঠাকুরবাড়ির দ্বারকানাথের হাত ধরে শিল্প বা ব্যবসা - বাণিজ্যের ইতিহাসে বাঙালির যে ধারার সূচনা হলো তারই পরিপূর্ণ রূপ বিপিনচন্দ্র পালের স্বদেশী মোটরগাড়ি কারখানা।ইতিহাস হয়তো মনে রাখেনি জগদীশ্বর ঘটক বা বিপিনচন্দ্র মতো নায়কদের।কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের বুকে স্বদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন এও এক ভিন্ন ধারার নবজাগরণের স্বাক্ষর বৈকি!
তথ্যসূত্র - ' ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা ' - সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর
বর্তমান পত্রিকা
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন