এ এক অন্য রবিঠাকুরের গল্প
দেবব্রত মন্ডল
সালটা১৯২৪।গ্রীষ্মের এক অবসন্ন গোধুলিবেলা। সারাদিনে হাজারো ব্যস্ততার পর দিনের এই সময়টাই আর্জেন্টিনার প্লাতো নদী তীরবর্তী এই ছোট্ট শহরটা এক লহমায় হঠাৎ যেনো ক্লান্ত হয়ে পড়ে।সমস্ত দিনব্যাপী প্রচন্ড খরতাপের পর প্লাতো নদীর জলে রঙের খেলায় মেতেছে সুয্যিমামা আর অন্যদিকে ঘরে ফিরতে চাওয়া পাখিদের কলতানে এক অপূর্ব মোহমায়া সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র পরিবেশে।অন্যান্য দিনের মতোই সেদিনও স্রোতস্বিনী প্লাতো নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বৈকালিক শোভা উপভোগে ব্যস্ত এক বাঙালি।বস্তুতপক্ষে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময় খুব দ্রুত বদল ঘটছিল চারপাশের চালচিত্রের।বদলে যাচ্ছিলো বিশ্বরাজনীতির মানচিত্র পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোতে।আর এই পাল্টে যাওয়া সময়ের সঙ্গে তাল রেখে বদলে যাচ্ছিলো মানুষের দৈনন্দিন যাপন,তাদের আটপৌড়ে জীবন।স্বাভাবিকভাবেই তার আঁচ এসে লাগলো পরাধীন দেশ ভারতবর্ষেও।
তৎকালীন সময়ের দেশীয় রাজনীতির দিকে চোখ ফেরালেই দেখা যাবে ভারতবর্ষের বুকে স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন তখন পুরোদমে জ্বলছে।বাতাসে বারুদের গন্ধ তখনও টাটকা।যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তার ঠিক বছর কুড়ি আগে লর্ড কার্জনের রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়েছে বাংলা।এমন সময় এগিয়ে এলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। রাখী বন্ধনের ডাক দিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বর এক অনন্য স্বাক্ষর রেখে গেলেন তিনি।এমনকি ১৯০৫ সালের ১৬ ই অক্টোবর সেদিনের সেই উত্তাল সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে সাধারণ মুসলমান সহিস থেকে শুরু করে চিৎপুর মসজিদের মৌলবী রাখী পরিয়েছেন সকলকে, রয়েছে এমন নজিরও।এই ঘটনাটিই সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান মুখ হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এলো।এরপর ১৯১১ সালে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর সাইমন কমিশনের ভারতে আগমন অথবা জালিয়ানওয়ালাবাগের নারকীয় হত্যাকাণ্ড - ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির গ্রাফ যখনই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে তখনই গর্জে উঠেছে রবিঠাকুরের কলম।
এতো গেলো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বকবির জীবনের বিশ্লেষণ।কিন্তু কেমন ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কান পাততে হবে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে।আচ্ছা ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে কি সর্বদা সাহিত্য - সংস্কৃতির জয়ধ্বনি শোনা যেত?উত্তর হলো - না।ঠাকুরবাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে সাহিত্য - সংস্কৃতির গুনগানের সঙ্গেই বারংবার ঘুরে ফিরেছে অগুন্তি মৃত্যুর হাহাকার।যার সন্ধান পেতে হলে ইতিহাসের পাতা উল্টে আমাদের ফিরে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সে।মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মাকে হারান রবীন্দ্রনাথ।হারানোর সেই শুরু - এরপর সারাজীবনে একের পর এক হৃদয়বিদারক মৃত্যুর সাক্ষী থাকতে হয়েছে তাকে।
১৮৮৪ সালে মারা গেলেন কাদম্বরী।রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে জলঘোলার সূত্রপাত যা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল কাদম্বরীর আত্মহত্যা এবং সেই সূত্রে ' ভারতী' পত্রিকায় কবির একটি লেখা প্রকাশের মধ্য দিয়ে - " ....আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল তাহাকে মনে পড়ে,সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে....।"
দুর্ভাগ্যবশত বাঙালি পাঠকরা কবির সাহিত্যকর্মের তুলনায় তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে হয়তো বেশি উৎসাহিত।তাই হয়তো তার মৃত্যুর এতদিন পরেও কাদম্বরী - রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জল্পনার অবসান ঘটেনি।কাদম্বরীর মৃত্যুর বছর দশেকের মধ্যে মৃত্যু হয় কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর।এর পর একে একে মারা যান কবির ছোট ছেলে শমিন্দ্রনাথ এবং মেজো মেয়ে বেলি।মৃত্যুশয্যায় নিজের মেয়েকে শেষ দেখা না দেখেই চলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ রয়েছে এমন উদাহরণও।সুতরাং একথা বলা চলে ব্যাক্তিগত জীবনের নানা ঘাত - প্রতিঘাত এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিজের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে,যার ছাপ পড়েছিল তার সাহিত্যসাধনাতেও।তবে আজ কবির সাহিত্যজীবন নয়,আমরা মনোনিবেশ করবো তার জীবনের সম্পূর্ণ অনালোচিত একটি অধ্যায়ে।
সালটা ১৯১৩।ভারতবর্ষ পেলো একজন নোবেল লরিয়েটকে।সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নোবেল পেলেন রবীন্দ্রনাথ।ঘটনাচক্রে সেই বছরই ' গীতাঞ্জলি ' বইটির ফরাসি অনুবাদ পৌঁছলো এক আর্জেন্টাইন তরুনীর হাতে - নাম তার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।বইটি পড়েই রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রেমে পড়লেন এই তরুণী।এর কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ পৌঁছলেন আর্জেন্টিনা।শত নিষেধের বেড়াজাল টপকে রবীন্দ্রনাথের কাছে সেদিন পৌঁছতে পেরেছিলেন তার গুণমুগ্ধ ভিক্টোরিয়া।লেখার প্রেমে পড়েছিলেন আগেই আর এবার প্রথম দর্শনেই কোনো এক অজানা কারণে এই নিতান্ত বাঙালি প্রৌঢ়ের প্রেমে পড়লেন সেই বিদেশিনী কন্যা।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি তরুনীর সেই প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন? এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।অনেকের মতেই ভিক্টোরিয়ার এই প্রেম ছিল একতরফা।তবে এই প্রথম নয়।কবির যখন সতেরো বছর বয়স তখন এক মারাঠা তরুণীর প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন রবিঠাকুর।রবির বিদেশ যাত্রার সমস্ত ব্যবস্থা প্রায় পাকা।এই সময় ইংরেজি এবং বিদেশি আদব কায়দা শেখার উদ্দেশ্যে অন্নপূর্ণার সঙ্গে আলাপ হয় রবীন্দ্রনাথের।রবীন্দ্রনাথের দাদা সতীন্দ্রণাথ এবং অন্নপূর্ণার বাবা আত্মারাম উভয়েয় ছিলেন প্রার্থনা সমিতির সদস্য।সেই সূত্রেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে রবীন্দ্রনাথ আর অন্নপূর্ণার মধ্যে।যা গড়িয়েছিল প্রেম পর্যন্ত।ঠাকুরবাড়ির কাছেও গোপন থাকেনি তাদের মেলামেশা।কিন্তু সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পেরেই প্রবল আপত্তি তোলেন দেবেন্দ্রনাথ।এর প্রধান কারণ ছিল অন্নপূর্ণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে বছর দুয়েকের বড়ো।যদিও দাদা সতীন্দ্রনাথ এবং অন্নপূর্ণার বাবা আত্মারামের পূর্ণ সমর্থন ছিল এই সম্পর্কের প্রতি।রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সের এই প্রেমিকা ভালোবেসে একটি নাম চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে।রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসে প্রেমিকার নাম রাখলেন নলিনী।পরবর্তীকালের অনেক সাহিত্যকর্মেও নলিনীর নাম পাওয়া যায়।প্রথম প্রেমকে হয়তো কোনোদিনই ভুলতে পারেননি বিশ্বকবি।
রবীন্দ্রনাথের অমর সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা চলে।আলোচনা চলে তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা সম্পর্ক নানা ওঠাপড়াকে কেন্দ্র করে।আর এসবের মাঝেই আড়ালে চলে যায় রবীন্দ্র জীবনের এমন অনেক ভালোবাসার গল্প।আমরা কি তার হিসেব রাখি?
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন