পেনশনের আবেদন
অমিয় কুমার চৌধুরি
অবশেষে লকডাউন পৃথিবীর বুক থেকে পুরোপুরি উঠে গেল প্রথম বারের মতো। করোনা ভাইরাসের উৎপাতকে আটকাতে ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। পুরোমাত্রায় প্রয়োগ শুরু হয়েছে। পৃথিবী শান্ত হয়েছে। মানুষ পরিচিত ছন্দে ফিরছে।
সরস্বতীর মনে আনন্দ ফিরে এসেছে। আগামীকাল থেকে আবার কাজে যাবে। রাতে মোবাইলে জানিয়েছে বৌদিমণিকে - সকালবেলা তুমি কোন কাজ করবে না। তারপর মনে মনে ভেবেছে, বৌদিমণির কষ্ট আর থাকবে না। বৌদিমণির কাছে আগাম দু'মাসের বেতন চেয়ে নেবে। আমাদের সংসারের গতি আগের মতই চলতে শুরু করবে।
আবার কাজে ফিরছে। আনন্দ না থাকা মন নিয়ে ভটভটিতে বসে আছে। ভটভটি চলছে নতুন উদ্যমে। দশ মিনিটের রাস্তা। সরস্বতী হালদার সংসারকর্মী। মাসিক ঠিকা চুক্তিতে কাজ করে। চুক্তিতে আছে , ঘরদোর ঝাড় দিয়ে জল দিয়ে মুছে দেয়া, এঁটো বাসন-কোসন মাজাঘষা, রান্নার জন্য তরকারি কাটাকাটি ও মাছ পরিস্কার করে ধুয়ে নুন-হলুদ মেখে দেওয়া। তারপর এককাপ চা আর একবাটি মুড়ি খেয়ে তবেই ছুটি। আরো দুই বাড়িতে চলবে কাজ।
তবে এভাবে নয়।
তাঁর বৌদিমণি সরকারি দপ্তরে কর্মরত। দাদাবাবু চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাদের দুই সন্তান বাইরে থাকে। লকডাউনের আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিল।
সরস্বতী কলিং বেল টিপলো। দাদাবাবু দরজা খুলে দিলেন। সরস্বতী অভ্যাসমতো ঘরে ঢুকেই ঝাঁটা নিতে গেল। সেখানে ঝাঁটা নেই। বৌদিমণির খোঁজে রান্নাঘরে গেল। দেখতে পেয়ে বলল, বৌদিমণি কেমন আছো?
- খুব ভালো আছি। তুই?
- ভালো। তবে কষ্ট আর নরক যন্ত্রণা দিয়ে এ ক'টা মাস কেটে গেল আরকি। বৌদিমণি ঝাঁটাটা কোথায়?
- আছে। তুই চেয়ারে গিয়ে বস। আমি যাচ্ছি।
সরস্বতী চেয়ারে না বসে এদিক ওদিক ঘুরে দেখছে। ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে। থালা বাসন পরিস্কার। অসন্তুষ্ট মন নিয়ে এবার ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দাদাবাবু বললেন, বস সরস্বতী, চেয়ারটায় বস।
সরস্বতী অন্য মনষ্ক হয়ে বসল। দাদাবাবুর নজর এড়ালো না। দাদাবাবুও অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। একটু পরেই আসল সত্যটা জেনে যাবে সরস্বতী। নিরবতা কাটানোর জন্য বললেন, তোদের পাড়ার খবর কী? ভাইরাসে ক'জন আক্রান্ত হয়েছে?
- আমাদের খবর ভালো। আক্রান্তের কোন খবর নেই।
- বাইরের রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা কেউ আসেনি?
প্রশ্ন শুনে থতমত খেলো সরস্বতী। একটু ধাতস্থ হয়ে বললো, তিনটি পরিবার এসেছে। তবে সবাই ভালো আছে।
পরবর্তী কথা বলার কোন প্রসঙ্গ না পেয়ে বললেন - তোর নাম সরস্বতী কে রেখেছে?
- ঠাকুরদা।
বৌদিমণি দু'হাতে দু'কাপ চা নিয়ে এলো। সরস্বতীর দিকে এককাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, বিস্কুট দেব?
- না, বৌদিমণি। থাক। তুমি সব কাজ করে ফেলেছো?
- হ্যাঁ।
- তাহলে? গতকাল মোবাইলে বলার পরও কাজ করলে যে?
- হ্যাঁ, অভ্যাস হয়ে গেছে। লকডাউন আমাদের অনেককিছু শেখালো।
- তার মানে?
- তুই আসতে পারছিস না। আমরা বাধ্য হয়ে সংসারের সব কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলাম। তোর দাদাবাবু আগে তরকারি কুটতে পারতো না। প্রথমদিকে অসুবিধা হচ্ছিল। তারপর অভ্যেস হয়ে গেছে। কি সুন্দর আর তাড়াতাড়ি কেটে দেয়। ঝোলের পটল কিভাবে কাটতে হবে আর চচ্চড়ির পটল কিভাবে কাটতে হবে সব জনে গেছে। শুধু বলতে হবে। তাহলেই হলো। নিজের ঘরদোর নিজেরাই ঝাঁট ও জল দিয়ে মুছে দেয়।
- এখনও কি এভাবেই চলবে? আমার কি দরকার নেই?
- হ্যাঁ, দরকার নেই।
এখন ছেলে মেয়ে, দু'জনে চলে গেছে। আমরা দু'জন শুধু। তাছাড়া, কাজও অনেক কমে গেছে।
- তুমি সব কাজ করতে পারো? হাঁটু ব্যথা, কোমরের ব্যথা? .......
- সব ভালো হয়ে গেছে। অভ্যাস, বুঝলি? কাজ না করে করে ব্যথার কবলে পরেছিলাম। এখন সব ঠিকঠাক। মিক্সিংএ মশলা করি না, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কাচি না। নিজেরটা নিজে করি। আর তোর দাদাবাবু আর বাড়ির বাইরে যায় না। যাবেও না।
- কেন?
- আবার যদি করোনা ভাইরাস ফিরে আসে? বয়স হয়েছে। তাই। ভালোই আছি।
- তাহলে, কাজের লোকের দরকার নেই! কিছুক্ষন চুপ থেকে হাসতে হাসতে সরস্বতী বলল - দাদাবাবু চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর পেনশন পায়। আমি কি পাবো না?
- ওটা সরকারি চাকরি করলে পাওয়া যায়।
- তা ঠিক। ওকথা এমনি বললাম। কিছু মনে করো না। চললাম।
দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সরস্বতী। দাদাবাবু স্ত্রীকে বললেন, সব ঠিক আছে বুঝলাম। যদি দু'জনের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ি? তখন কি হবে?
- তখনকার কথা তখন হবে। একটা উপায় ঠিক বের হয়ে যাবে।
সরস্বতী পাকা রাস্তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে ভাবছে, করোনা ভাইরাস বা লকডাউন বৌদিমণিদের অনেক উপকার করেছে। কিন্তু শিখতে পারেনি অনেক কিছুই।এবার দ্বিতীয় বৌদিমণির বাড়ি যাই। লকডাউন তাদের কি উপকার করেছে শুনি!
(১.৮.২০২০, সকাল, বু.পুর)
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন