শান্তিনিকেতন : কবিগুরু, খোয়াই, জঙ্গল আর রাঙাবিতান : শান্তময় গোস্বামী

শান্তময় গোস্বামী

শান্তিনিকেতন : কবিগুরু, খোয়াই, জঙ্গল আর রাঙাবিতান 

শান্তময় গোস্বামী

এবার জন্মদিনটা ভেবে ছিলাম একদম অন্য রকম ভাবে কাটাবো , ভেবেছিলাম শান্তিনিকেতনে চলে যাবো খুব ভোরে।  সোনাঝুরি বা কোপাই এর ধারে বসে কাটিয়ে দেবো দিনের অনেকটা সময়, সন্ধ্যে নেমে আসবে ধীরে ধীরে তারপর নিজের ডেরায় ফিরে আসবো অনেকটা ভালোলাগা নিয়ে। সত্যি বলছি এই ভাবনা গুলো ভাবতে ভাবতেই কাটিয়ে দিয়েছি কয়েক মাসের অনেকটা সময়। যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করছি আমরা সেটা তো আমাদের কারোরই কাঙ্খিত ছিল না তাই না ! চারিপাশের এই দুঃসহ পরিবেশে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছি একটু একটু করে । এত হতাশ লাগছে একের পর এক খারাপ ঘটনার মুখোমুখি হয়ে , তা সত্যি মেনে নিতে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। 

প্রতিদিন রাতে ঘুমোনোর সময় এক নতুন ভোরের স্বপ্নের বীজ বপন করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি তা বুঝতেও পারি না ! কিন্তু ঘুম ভেঙে সব এলোমেলো হয়ে যায় আবার ! খবরের কাগজের হেডলাইনস , অনাহার , দারিদ্র্য , মৃত্যু মিছিল।  এ কোথায় চলেছি আমরা ? প্রশ্নের উত্তর আর খুঁজে পাইনা।  সব যেন একটু একটু করে ফুরিয়ে যাচ্ছে। না আসলে সব কিছু হয়তো এখনো ফুরিয়ে যায়নি , তাই তো বৃষ্টি হলে আজও জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিই জল।  নরম হাওয়ায় অনুভব করি সোঁদা গন্ধ।  বাড়ির পাশের পাখিদের বাসায় বেড়ে ওঠা রূপকথা দেখি।  কখনও রামধনু তো কখনও কুঁড়ি ফুটে সদ্য ফোটা ফুল দেখে আনন্দে ভরে ওঠে মন।

আমি এক নারী সমাজের একমাত্র পুরুষ সদস্য। “যশোদল” এর সারাদিনের হিসেব মাথায় রাখলে মোট ছয়জন নারী এই বাড়িতে রাজত্ব চালায়। তাঁদের একমাত্র হুকুমবরদার হয়েই আমার সারাদিনের সালতামামি। সবচেয়ে ওপরে বিরাজ করেন আমার মা। ৮২ বছরের সুস্থ এক বালিকা। সম্প্রতি মস্তিষ্ক জনিত DIMENTIA বা ভুলে যাওয়া নিরপরাধ ব্যাধির শিকার। তারপরেই আমার শ্রীমতী সঙ্গে কন্যা আর তিন কর্মসঙ্গিনী। মা পত্রিকা পড়েন, টিভি দেখেন কিন্তু করোনা বা লকডাউনের কথা মনে রাখতে পারেননা। বিগত ছয় মাসের মধ্যে বাহির তাঁকে করেছে দূর। বাড়ির নানান ঘরেই তাঁর হাঁটাচলা। কন্যার পড়াশুনোর জন্য শ্রীমতীকে কলকাতায় থাকতে হয়। এখন ছটফটে দুরন্ত মা-মেয়েকে ঘরবন্দী হতে হয়েছে সেই মার্চ মাস থেকে। তাঁরাও নাতিদুরস্ত বিরক্ত ও বাহিরগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। 

সেদিন খবরের কাগজ খুলতেই সুবাস ছড়াল সংবাদটা। মাননীয়া বেশ কয়েকটি সরকারী টুরিস্ট লজ খুলে দিচ্ছেন বাংলার ভ্রমণ পিপাসু জনগণের জন্য। সঙ্গে সেইসব টুরিস্ট লজের নাম ও ঠিকানা। বুকের বাঁদিকে হৃৎপিণ্ডের দ্রুত লাফানি টের পাচ্ছিলাম। আর সময় নষ্ট না করে ডেস্কটপ খুলে বসে খোঁজাখুঁজিতে বেশ খানিকটা সময়ের পরে দুটো ডাবল বেড লাক্সারি ডীলাক্স রুম বুক করে নিতে পারলাম।

রাঙাবিতান, শান্তিনিকেতনের কথা এর আগে বহুবার শুনেছি কিন্তু কোনদিনই বুক করতে পারিনি। এবার মা করোনার দয়ায় বেশ নিরুপদ্রবেই দুটো ঘর বুক হয়ে গেলো। একলা একলা যত সহজে ঘোরা যায়, সঙ্গে দু-একজন থাকলে তত স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করা যায় না। তাদের খাওয়াদাওয়া, স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে খেয়াল রাখতে রাখতে ভাবনাচিন্তার দফারফা হয়ে যায়। তার ওপর মেয়েরা মন্দিরে গেলেও টিপটপ হয়ে যেতে চায়। সাজুগুজুতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তার জন্য এত্ত সময় ব্যয় করা আমার পক্ষে রীতিমতো বাহুল্য। যাইহোক বাড়িতে ঘোষণা মাত্র হুল্লোড় ধ্বনিতে সাজোসাজো রব উঠলো। শিশুর মত খুশী আমার মা। শ্রীমতী বেশ সাবধানী। ম্যানেজারের ফোন নম্বর যোগাড় করে সাবধানতার যাবতীয় সংবাদ জেনে নিলেন। যোগাড়ে থাকলো অশীতিপর শাশুড়ির জন্য একটি হুইলচেয়ারও।  

শনিবার সকাল সকাল বেড়িয়ে দুপুরের মধ্যে পৌছাবো রাঙাবিতান। দুপুরের খাবারের অর্ডার আগে থেকেই দিয়ে রেখেছেন শ্রীমতী। চিত্তরঞ্জন থেকে ১২৮ কিলোমিটার দূরত্বের মাপে। আমার লাল টীয়াগো সেজে উঠলো সাবানশ্যাম্পু বিধৌত হয়ে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দুটো টোল ট্যাক্সের গেট পেরিয়ে আসবে দার্জিলিং মোড়  সেখান থেকে একদম সোজা রাস্তা পৌঁছে যাবে রাঙাবিতানের লালমাটির রাস্তা বিছানো সদরে। 

এইসব সাতসতেরো ঝক্কি সেরে অবশেষে শনিবার ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে বেরিয়ে পড়লাম বোলপুর-শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে। দার্জিলিং মোড়  দিয়ে বাঁদিকে ঢুকতেই চোখে পড়ল দু’দিকে সবুজ ক্ষেত। সবুজ যে এত সুন্দর হতে পারে সবজি বাজারে দাঁড়িয়ে আমি কোনদিনও আন্দাজ করতে পারিনি! শ্রীমতীর আবদারে বেশ কয়েকবার দাঁড়াতে হল রাস্তার পাশে। অগুনতি সেলফি তোলা হল। খানিক পথ যেতে না যেতেই কন্যার বায়না শুরু হল, “খিদে পেয়ে গেছে!” অগত্যা দাঁড়াতে হল  কাছের একটি দোকানে। একেবারেই সাদামাটা গ্রাম্য দোকান।  মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনি। বেঞ্চি পাতা গোটাদুয়েক। গ্রামের মানুষদেরই আনাগোনা। আমাদের শহুরে মানুষদের দেখে সসম্মানে তাঁরা আসন ছেড়ে বসতে দিলেন। দোকানি সযত্নে শালপাতার থালায় মটরশুঁটির কচুরি, ছোলার ডাল আর ল্যাংচা এগিয়ে দিলেন। জলযোগ সারতে সারতে আলাপ জমালাম দোকানির সঙ্গে। 

আলাপে জানলাম কাছাকাছি সব দোকানপাটই খোলা থাকছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও বিখ্যাত শনিবারের হাট এখনো বন্ধ। একদমই হাতে গোনা কিছু হোটেল অনুমতি পেয়েছে তাঁদের দরজা খুলে দেওয়ার জন্য। খাওয়া শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেই লাল টীয়াগোর কানে মোচড় দিতেই পৌঁছে গেলাম অজয় সেতুর দোরগোড়ায়।

অজয়ের সেতুর উপর এসে কেউ যদি গাড়ি দাঁড় না করান তাহলে বলতে হবে, হয় তিনি নিত্য এই জায়গা দিয়ে যাতায়াত করেন, রোজ এই সৌন্দর্য দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, নইলে নিতান্তই বেরসিক মানুষ! সেতুর উপর পায়ে চলা পথ ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা সেতুর রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।
অপূর্ব! দিগন্ত বিস্তৃত সোনালি বালুকাবেলা আর তার ফাঁক দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে অজয়! নামে ও গোত্রে সে পুরুষ।  মেয়েলি হলে বলতাম তন্বী! জলের স্রোতের দাগ দেখে মনে হচ্ছে যেন কত শত কালের সহস্র মানুষের পদচারণার চিহ্ন বুকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলেছে। ডানদিকে অর্থাৎ, পূর্বদিকে চেয়ে দেখি লালরঙা দীর্ঘ এক সেতু। তার ওপর পাতা দুটি রেলের লাইন।

গুগলদাদুর দেখানো পথে নিজেদের ঠিক করে নেওয়া সময়ের বেশ আগেই পৌঁছে গেলাম রাঙাবিতানের সদর দরজায়। গাড়ী ভেতরে রেখে নামতেই করোনা সংক্রান্ত বিধিনিয়ম মেনে এক অসাধারণ প্রকৃতির রাজ্যে প্রবেশ করলাম। রাঙাবিতানের এতো জনপ্রিয়তার ব্যাপারটা মালুম হোল একেবারে শুরুতেই মুগ্ধতার রেশ ধরে। দোতলা বাড়ি। ওপর তলায় আমি- শ্রীমতী- কন্যা আর এক তলায় মা ও মায়ের সবসময়ের সঙ্গিনী। প্রশস্ত ঘর টয়লেট ও বারান্দা বা ব্যালকনি। বিছানা ও সাজসজ্জাও বেশ আধুনিক ও রুচিসম্মত। মোটেরওপর বেশ লাগলো। করোনার জেরে রুমসার্ভিস। তারাও বেশ করিৎকর্মা। স্নান সেরে দুপুরের খাবার খেতে খেতে ২.০০ বেজে গেলো। এবার একটু গড়িয়ে দীর্ঘযাত্রায় ঝাঁকুনি খাওয়া শিরদাঁড়াকে একটু সোজা করেই দেখে নেবো রাঙাবিতানকে। শুনলাম ভালো করে বুঝে উঠতেই নাকি ঘণ্টা খানেক লাগবে। কাছেই “আমার কুটির” সেখানেও একটু যাওয়া যেতে পারে।

মোট তিনটি সুপার স্যুইট, বারোটি দোতলা এসি ডীলাক্স ও চব্বিশটি এসি কটেজের সংসার। আছে  ডান্স বলরুম থেকে এসি রেস্তোরা। কিন্তু মা করোনার অভিশাপে আপাতত বন্ধ। অসামান্য সব বাঁধানো রাস্তা, পুকুর, আমবাগান, ফুলের ও শাল পিয়াল মহুয়ার ছড়াছড়ি। সবজী চাষও হয়েছে গুছিয়ে। পেয়ারা, পেঁপে, জাম ও কাঁঠালে ফলের বাড়বাড়ন্ত। হাত বাড়ালেই হোল। রাতের আলোকিত রূপ সত্যি মোহময়ী। পুকুরের মাঝের রঙিন ফোয়ারাও মনোরঞ্জনে কখনো লাল তো কখনো নীল হলুদ সবুজ। 

সে রাতে বৃষ্টি এলো অঝোরে। মুরগিকষা দিয়ে রসনায় তৃপ্তি গুঁজে আর্দ্ররাতে ঘুমটা ভালই হোল। অনেকদিন পর তারিখ থাকতেই ঘুমাতে যেতে পারলাম। খুব সকালে নানান পাখীর ডাকে ঘুম ভাঙল। চোখেমুখে জল দিয়ে ক্যামেরা গলায় বেড়িয়ে পড়লাম। ৮.০০ নাগাদ ফিরে এসে দেখি সবাই উঠে পড়েছে। আজ আমরা সকালে কঙ্কালীতলা সতীপিঠ দর্শনে যাব। দুপুরে ফিরে এখানেই শাঁটাবো মাছেমাংসে।

এখান থেকে সতের কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর তীরে কঙ্কালীতলায় কঙ্কালীশ্বরীর মন্দির। শান্তিনিকেতন থেকে পিচ ঢালা রাস্তা চলে গিয়েছে প্রান্তিকের পথে। প্রান্তিক স্টেশনের গায়ের লেভেল ক্রসিংটি পার করে এগিয়ে চললাম সোজা। সবুজ ক্ষেতের বুক চিরে বয়ে চলা রাস্তাটি বেয়ে আমরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কোপাইয়ের তীরে মন্দির চত্বরে।

গ্রামটির নাম বেঙ্গুটিয়া। তবে দেবীর নামেই সবাই চেনে একে, কঙ্কালীতলা। আর পাঁচটা মন্দিরের সঙ্গে এর বিশেষ তফাত নেই। তবে মন্দিরের পাশেই একটি ছোটো অগভীর কুন্ড রয়েছে যেটি এই মন্দিরকে একটি বিশেষত্ব দিয়েছে। কথিত আছে, এই কুন্ডের ঈশানকোণে সতীর কোমরের অংশ পড়েছিল। মূল দেবীর অবস্থানও কঙ্কালরূপী শিলায়, এই কুন্ডেরই জলে। সতীর একান্ন পীঠের শেষ পীঠ এই কঙ্কালীপীঠ। কোপাই এখানে উত্তরবাহিনী। নদীটি বড়োই শীর্ণ। তবে পাড়ে পাথর বাঁধানো অংশ দেখে বোঝা গেল, সময় সময় নদী আছড়ে পড়ে দুই পাড় ভেঙে দিয়ে যায়। তাই এই সাবধানতা।

বৃষ্টির অঝোর ধারা স্নানে ভিজে টীয়াগো আমাদের পৌঁছে দিলো আবার রাঙাবিতানে। দুপুরে বেশ কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পায়ে পায়ে ছয় কিলোমিটার দূরের সোনাঝুরি বন ও খোয়াই এর কাছে পৌঁছলাম। খাঁ খাঁ খোয়াইকে দেখে মন খারাপ মনেই পুষে রেখে সন্ধ্যে নামার কিছু আগেই ফিরে এলাম রাঙাবিতানে। আজ আমাদের ছোট্টো ভ্রমণের শেষ রাত। জমিয়ে রবিকবির গান-কবিতার আবহে কখন যে রাত গড়াল খেয়ালই ছিল না। চটক ভাঙল খাবার দেওয়ার আহ্বানে। বৃষ্টির শব্দ, একটানা রাতপোকাদের গান আর ব্যাঙেদের কনসার্টে রাত গভীর হচ্ছিলো। আমাদের চোখেও নেমে আসছিলো হঠাৎই পড়ে পাওয়া ক্ষণিক সুখের উল্লাসের যবনিকা। কাল সকালটা কাটিয়েই রওয়ানা আবার সেই কর্মজীবনের জতুগৃহে !!!
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.