![]() |
সমাপ্তি চৌধুরী |
সমাপ্তি চৌধুরী
দ্বিতীয় - পর্ব
সময়ের সাথে সাথে চৈতির চরিত্রেও বদল ঘটেছে। চৈতি এখন আর অভিমানে চুপ করে সবকিছু সয়ে নেয় না। মাঝে মাঝে তার প্রতিবাদী সত্ত্বাও জেগে ওঠে। এখন সে বুঝে গেছে যে, তার অভিমানী সত্ত্বার কদর এখানে কেউ করবে না। তার লড়াইটা তাকে একাই লড়তে হবে। দুই বাড়ির বহু অভিযোগ, অনুযোগ সত্ত্বেও চৈতি দ্বিতীয়বার আর মা হতে চায় নি। কেননা ডাক্তারবাবু বলেছিলেন নীলাভর যেহেতু কিছু শারীরিক সমস্যা আছে, তাই চৈতির সন্তান হলেই একটা রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করবে। তাই আর নতুন করে কোনো সমস্যার মুখোমুখি সে হতে চায় নি। আর তাছাড়া খেয়ালী তার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে আছে, সেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। যদিও বাড়ীতে এ নিয়ে তাকে প্রচুর প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, তথাপি অভিমানিনি চৈতির কঠোর সত্ত্বার কাছে সবাই পরাস্ত হয়েছে।
সময় মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। সময়ের সাথে সাথে নীলাভও অনেক বদলে গেছে। নীলাভ এখন কিছুটা হলেও চৈতিকে বুঝতে পারে, বুঝতে চায়। সে দেখেছে মেয়ের জন্য কী অমানুষিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে চৈতি। এই লড়াইয়ে একটু একটু করে নিজেকেও সামিল করেছে নীলাভ,বাইরে থেকে হলেও সে পাশে থেকেছে চৈতির। ইন্টারনেটে ডাক্তারদের সাথে কনসাল্ট করেছে, স্পেশাল স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে, উন্নত কানে শোনার মেশিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বর্তমানে স্পীচ থেরাপি করে করে খেয়ালী এখন কিছু কিছু কথা বলতে পারে।
প্রথম যেদিন খেয়ালী 'মা' বলে ডেকেছিল, চৈতির শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু সেদিন আর বাধ মানেনি। অনেক বছর পর সেদিন চৈতি মেয়েকে নিয়ে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়েছিল, নতমস্তকে সব অভিমান অশ্রুধারার মধ্য দিয়ে ঝড়ে পড়েছিল।
স্পীচ থেরাপিস্ট ড:বাগচীর পরামর্শেই চৈতি তার মেয়েকে নিয়ে আজ এই একাডেমীতে এসেছে। "রুদ্র-বীণা" -- নামটা বেশ ইন্টারেস্টিং, চৈতি মনে মনে ভাবলো। এখানে সাধারণ শিশুদের পাশাপাশি বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদেরও খুব যত্ন সহকারে আবৃত্তি ও নাটকের তালিম দেওয়া হয়। চিকিৎসকের মতে এখানে নিয়মিত অনুশীলন করলে খুব তাড়াতাড়ি খেয়ালী অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে।
মেয়ের জন্য চৈতি যেখানে খুশি যেতে পারে, সবকিছু করতে পারে। একাডেমীর অফিসঘরে বসে চৈতি মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করছিল। দেওয়ালের পেন্টিং, অফিসরুমের অন্দরসজ্জা-- এগুলো যেন বড় চেনা লাগছে চৈতির,,,,,কেমন যেন এক আত্মিক টান অনুভব করছিল।
------------
'নমস্কার' , প্রতি নমস্কার করে মুখ তুলতেই,,,,,, এ কাকে দেখছে সে-‐- রোগা, অবসন্ন চেহারার এক মধ্যবয়স্ক মানুষ। মুখভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি বয়সের তুলনায় আরো বয়স্ক করে তুলেছে রুদ্রকে। এক লহমায় প্রায় কুড়ি বছর পিছিয়ে গেল চৈতির জীবন। পুরনো দিনের চেনা সব ছবি, সব অভিমান আবারো ভেসে উঠল চোখের সামনে।
কথোপকথনে চৈতি জানতে পারল রুদ্রর বর্তমান জীবনের কথা। যে নাটকের দল ও কেরিয়ারের দোহাই দিয়ে একদিন সে চৈতি কে ফিরিয়ে দিয়েছিল, তারাও নির্মম ভাবে রুদ্রর জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। নাট্যদলেরই কর্মী বীণা-র সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে দল থেকেই বিতাড়িত করা হয়। বিবাহিত জীবনও সুখের হয় নি। সন্তান না হবার অবসাদে বীণা আজ মানসিক ভারসাম্যহীন। জীবন তাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। চৈতি তাই আর অভিমান করে চুপ থাকতে পারে না।
রুদ্র জানতে পারে চৈতির এই একাডেমীতে উপস্থিতির কারণ। পরম স্নেহে খেয়ালীর হাতটা ধরে রুদ্র। তাকে পুরো একাডেমী ঘুরিয়ে দেখায়, তার মতো আরো অনেক ছোট্ট বন্ধুদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। চৈতি আশ্বস্ত হয়। এতদিনের জমে থাকা অভিমানের বরফ গলতে শুরু করে।
চৈতির সঙ্গে বীণার আলাপ হয়েছে। রুদ্র মাঝে মাঝে বীণাকে এই একাডেমী তে নিয়ে আসে, যাতে বাচ্ছাদের সঙ্গে থাকলে কিছুটা হলেও তার মন ভালো থাকে। চৈতিও মাঝে মাঝে সঙ্গ দেয়। রুদ্রর অনুরোধে চৈতিও এখন এই একাডেমীর সদস্য। বাচ্ছাদের শেখানোর মধ্য দিয়ে নিজের পুরনো ভালোলাগা গুলো যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
খেয়ালী এখন অনেকটাই সপ্রতিভ। স্পীচ থেরাপিস্ট ড: বাগচীর সাথে আজ বিকেল পাঁচটায় এপয়েন্টমেন্ট আছে। নীলাভ আজ নিজেই গাড়ি বের করেছে ওদের নিয়ে যাবে বলে। চৈতির ভালো লাগল। ডাক্তারবাবু খেয়ালী কে দেখে খুব এপ্রিসিয়েট করলেন, বললেন এখন সে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।
চৈতির মনে আজ খুশির জোয়ার, সেই জোয়ারে আজ নীলাভও গা ভাসিয়েছে। নীলাভ এখন সম্পর্কের মূল্য বুঝতে পেরেছে, বুঝেছে সময় না দিলে কোনো সম্পর্কই চিরস্থায়ী হয় না। চৈতিকে অবাক করে দিয়ে নীলাভ আজ গাড়ী নিয়ে সোজা পৌঁছে গেল বইয়ের দোকানে। চৈতি এবং মেয়ের পছন্দ মতো অনেক কবিতা ও নাটকের বই উপহার দিল তাদের। এক অপূর্ব ভালোলাগায় চৈতির সব অভিমান কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
জ্যোৎস্না রাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চৈতি ও নীলাভ। এক মনোরম ভালোলাগায় তারা আজ আচ্ছন্ন। চাঁদের হাসির বিচ্ছুরণ তাদের জীবনেও এনে দিয়েছে এক প্রগাঢ় প্রশান্তি। নিবিড় ভালোবাসায় নীলাভ চৈতির হাতটা ধরে। ঘরে ফিরতে ফিরতে চৈতির কানে গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে একটাই সুর----" তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম ।"
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন