তৃণা মুখার্জী
করোনায় লাভ-ক্ষতির বিচার করব বলে লিখছি না ।এই নিয়ে অনেকেই হয়তো অনেক রকম লিখেছেন বা লিখবেন । আমি নিতান্তই আমার বাড়িতে বসে যে অনুভূতিগুলো হয়েছে সেগুলি লিখবো। আর পাঁচজনের মতো আমিও ভাবতাম এই ব্যস্ত ও দৌড়ানো জীবনে কি ছুটি পাব না ?আর পাচ্ছিনা। মাঝেমধ্যে কান্না পেত।তারপর হয়তো ভগবান আমার মতো নিষ্পাপ মানুষের কান্না সহ্য করতে না পেরে ছুটির ব্যবস্থা করে দিলেন, তবে এই ছুটি আমার একার নয় ,সবার। সপ্তাহে রবিবার কেন একদিন হয় ,এমন ভাবা অলস ও বিশ্রাম খোঁজা মানুষেরাও অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্রাম পেয়ে গেল। তবে করোনার জন্য শুধু খারাপ হয়েছে বলবো না । প্রথম প্রথম তো ঘুমিয়ে ,খেয়ে ভালোই দিন কাটছিল ।যত দিন বাড়তে লাগল একজন আপাতত বেকার, পড়াশোনায় কসরত ও কিছু একটা করবো এমন ভাবনা পোষণ করা আমি, বাড়িতে বসে বুঝতে পারলাম, মা কতটা কাজ করে সারাদিন। পড়াশোনা ও মোবাইলে মুখ গুঁজতে এখন বিরক্ত লাগে ।গান শোনা , গান করা , নিজের মনের ভাবনাগুলোকে কথা দিয়ে লেখার চেষ্টা করি। এইভাবে এক মাস কাটতে চলল।বাইরে পুলিশের ডান্ডা খাওয়ার চেয়ে বাড়িতে মায়ের বকুনি অনেক ভালো,এটা ভেবে মনকে সান্তনা দিলাম। গ্রামে থাকি। করোনা নামক জীবাণুটি এখনো পর্যন্ত গ্রামের বিশুদ্ধ হাওয়াকে গ্রাস করতে পারেনি। লোকজনের মুখ না দেখলেও প্রকৃতির মুখ দেখা যাবে না, এমন কোথাও বলা হয়নি।তাই শরীর ও মন সুস্থ ও সতেজ রাখতে ভোরবেলায় বাবা-মার সঙ্গে প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। বাড়িতে এসে তেমন কাজ নেই ,কি করব ?বুঝতে বুঝতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায় । কিছু না করে , শুধু ভুলভাল ভেবেও যে সময় পার করা যায় তা আমি এই 'করোনা অবসরে 'বুঝেছি। মাথার মধ্যে বিভিন্ন ভাবনা ঘুরপাক খায় সারাদিন। নিজেকে নিয়ে সারা জীবন অনেক বেশি ভেবেছি। শুধু আমি কেন, আমার মত অনেক দেশবাসী, যারা অন্যকে সাহায্য করতে গেলেও ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে গর্বের সঙ্গে পোস্ট করে। করোনার বেশি প্রভাব পড়েছে ,ওই সব উন্নত মানুষের মধ্যে কিন্তু করোনা ভাইরাস তো নতুন ,মানুষের মনের মধ্যে যে জটিল ভাইরাস আছে তার চিকিৎসা কোথায়? নিজেদের স্বার্থের জন্য পরিবেশ দূষণ করেছি, নিজেদেরকে বাকিদের থেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছি । কিন্তু আসল কথা হল এটাই ,আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও উন্নত পরিকাঠামো যুক্ত দেশগুলি সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত।চিড়িয়াখানা ও সার্কাসের বন্দি পশুপাখিরা আজ হয়তো আমাদের দেখে হাসছে, এতদিন ওদের দেখে ,ওদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজ করিয়ে আমরা মজা পেয়েছি । আজ আমরা ওদের মতো বন্দীদশায়।এই ক'দিনের বন্দী দশায় আমরা হাঁসফাঁস ও ছটফট করছি। আর ওরা দিনের পর দিন এমন আবদ্ধ থাকে। বাইরে বেরিয়ে কুকুর ,বিড়ালদের খাবার দিয়েছি কিন্তু বারো মাস ওরা কোথায় খায়, সেটাও জানি না। আমার পাশের বাড়ির কাকু বর্ডারে দাঁড়িয়ে দেশ রক্ষা করছে।কাকিমাকে ফোনে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, করোনা আমাদের হয়না ।করোনা হয় তাদের যারা বিলাসিতা ও উচ্চশিক্ষিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে। গ্রামে বাইরে থেকে কেউ ঢুকলে ,সবাই মিলে তাদের মারতে যাচ্ছে। এদিকে বিকেল ও সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির সামনে বসে জটলা করলে দোষ হয় না। যারা বারো মাস খবর নেয় না ,তারাও এই সময় খবর নেওয়ার নাম করে সে কতটা জানে করোনা সম্পর্কে তা জানিয়ে মাথা খাচ্ছে। এত জ্ঞানী এরা সত্যি! বাড়িতে টাকা নেই, সবজি নেই ,চাল নেই । এক মাসের মধ্যে একবার বেরিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে গেছি, ও বাবা ! জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ফোন, জিজ্ঞাসা করছে কেন বেড়োতে গেলাম ,করোনা হয়নি তো ইত্যাদি কিন্তু একবারও জিজ্ঞাসা করেনি ,বাড়িতে খাবার আছে তো ,জল পাচ্ছি তো । আর একদল ফোন করে তারা কতটা ভীত, বাঁচবে কিনা তা নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করছে। তাও আবার বাড়িতে থেকে। অন্যদিকে তোমার পাশের বাড়ির জেঠু ও কাকুরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। একজন গরমে খাকি পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে , অন্যজন সামনে করোনা দেখেও হাসিমুখে আমাদের মতো সুবিধা বাদী মানুষদের সেবা করে চলেছে। আমরা কেন তাদের কথা ভাববো ? তাই না ।সত্যিই আমরা ব্যর্থ , কিছু কাজ না করে, শুধু বাড়িতে বসে থাকাতেও আমরা ব্যর্থ। গ্রামের সবজি বিক্রেতা ঠেলাগাড়ি নিয়ে সবজি বিক্রি করতে এসে দেখে, কেউ তাকে ভগবান ভাবছে আর কেউ যমরাজ ভেবে দূর করে দিচ্ছে। কিন্তু বিক্রেতার চিন্তা করোনা নয় ,তার চিন্তা বাচ্চা দুটো । করোনার জন্য অপেক্ষা নয় , তারা হয়তো না খেতে পেয়েই মারা যাবে ।অনেক কথা লিখে ফেললাম।আমার করোনার অভিজ্ঞতা তেমন রোমাঞ্চকর নয়। বাড়িতে বসে আছি, নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরিণত করার চেষ্টা করছি।এটা সত্যি এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই অনেকের জন্য অনেক কিছুই করছে। আলাদাভাবে আমি আর কতটুকুই বা করব, তেমন সামর্থ্য আমার নেই।আমি শুধু ভাবছি ,যখন আবার পৃথিবীতে সবকিছু ঠিক হবে ,তখন আমি কতটা সাহায্য করতে পারব সুন্দর পৃথিবী গড়ার জন্য ।যদি বেঁচে থাকি ,তাহলে হয়তো এখনকার থেকে নতুন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লড়াইটা আরো বেশি কঠিন হবে বলে আমার মনে হয় ।তাই এই 'করোনা অবসরে' নিজের ধৈর্য্য ,সহ্য ,পরিণত করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছি না।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন