মানুষের ধর্ম কী ? এই প্রশ্নটাই অবান্তর ! : সুকুমার সরকার

সুকুমার সরকার
মানুষের ধর্ম কী ? এই প্রশ্নটাই অবান্তর !

'মানবিকতা' কোনো ধর্ম নয় ; 'মানবিকতা' একটি বিশেষ গুন । ধর্মমতগুলির পরস্পর বিরোধী আচার-আচরণ ও প্রথা-পদ্ধতির বাড়-বাড়ন্ত থেকে এক শ্রেনীর মানুষ যখন বেরিয়ে আসতে চাইছেন ; তখন তাঁদের কথা ভেবেই কি এই 'মানবিকতা' বা 'মানবধর্ম' বিভিন্ন দরখাস্তের ফর্মে উল্লেখ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ?

বিষয়টি আপাত মধুর শোনালেও কেউ কেউ যেমন বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন , তেমনি বিষয়টিরও স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যাত হয়নি ।
প্রশ্ন উঠেছে , 'মানবতা' বা 'মানবিকতা' কি আলাদা 'ধর্মমত'(Religion) ? যদি হয়, তা হলে এই ধর্মমতের প্রবক্তা কে ? কবে থেকে চালু হলো ? এই মতের যাঁরা সমর্থক তাঁদের আচরণীয় বিধি কী ? ইত্যাদি ইত্যাদি। 

সেই সঙ্গে আর একটি প্রশ্ন ওঠাও স্বাবাভিক , তা হলো ' মানবতা' বা ' মানবিকতা' যদি আলাদা ধর্মমত হয় , তা হলে অন্য ধর্মমতগুলি কি মানবিক নয় ? তাদের মধ্যে কি মানবতা নেই ?
আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, বিভিন্ন ধর্মমতগুলির পরস্পর বিরোধী আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি , অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে এক শ্রেনীর যাঁরা নিজেদের 'নাস্তিক' বলেন , এই 'মানবতা' বা মানবধর্মের পরিচয় কি তাঁদেরকে উৎসাহিত করবে না ?
এ সবগুলি প্রশ্নই প্রাসঙ্গিক ! একটি জটিল সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে আর একটি সমস্যা সৃষ্টি করার চেয়ে , সমস্যার কারণ খুঁজে বের করে তার প্রকৃত সমাধান করাটা কি এই উন্নত বিজ্ঞানের যুগে মানুষ আশা করতে পারে না ?
------ অবশ্যই পারে !
প্রথমত , 'মানবিকতা' বা 'মানবতা' মানব প্রজাতির একটি বিশেষ গুন । এই গুন ধর্মমত, বর্ণ, গোত্র, দেশ , জাতি , ভাষা নির্বিশেষে যে কোনো মানুষের মধ্যে যে কোনো সময় , যে কোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে জাগতে পারে ! জাগলে আমরা বলি , মানুষটি মানবিক । তখন তাঁর জাত , ধর্মমত, ভাষা , দেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলি না ! আবার নাও জাগতে পারে । তখন তাকে বলি , মানুষটি অমানবিক ! এ ক্ষেত্রেও তার জন্য তার সংশ্লিষ্ট ধর্মমত বা দেশ বা জাতিকে দোষারোপ করতে পারি না । সুতরাং 'মানবতা' বা 'মানবিকতা'কে আলাদা ধর্মমতের জায়গায় বসানো উচিত হবে না ! সব ধর্মমতের মানুষদের মধ্যেই মানবতা আছে । মানবিকতা আছে । 

মানব প্রজাতি যে বিশেষ বিশেষ গুন বা সত্তাগত বৈশিষ্টের ( Comon characteristic) কারণে মানুষ ; 'মানবতা' বা ' মানবিকতা' তার একটি একটি আলাদা আলাদা গুন মাত্র । তার জন্য মানুষকে আলাদা করে চিহ্নিত করারও যেমন দরকার নেই ; তেমনি তার বিরুদ্ধে যাওয়ারও দরকার নেই । বিভিন্ন ধর্মমতের সঙ্গে মানবতাকে আলাদা পঙক্তিতে দাঁড় করানোর অর্থ , ধর্মমতগুলির অবমাননা করা । সেটা যেমন কাম্য নয় ; তেমনি বিভিন্ন ধর্মমতের পরস্পর বিরোধী প্রথা-পদ্ধতি বা আচার-আচরণ নিয়ে বিরোধ করাও ঠিক নয় । সেগুলিকে উত্সাহিত করাও ঠিক নয় । সে ক্ষেত্রে ধর্ম (DHARMA) আর ধর্মমত (Religion) -এর প্রকৃত সংজ্ঞা বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করে , যুক্তি সংগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানের পথ বের করা উচিত ।
বিজ্ঞানের পরিভাষায় কোনো বস্তু বা উদ্ভিদ বা প্রাণীর ধর্ম ( DHARMA) নির্ধারিত হয় তার সত্তাগত বৈশিষ্টের ওপর ভিত্তি করে । এতদিন সেই অর্থে মানব প্রজাতির সেই বিশেষ গুন বা বৈশিষ্টের ওপর ভিত্তি করে সমগ্র মানবজাতির জন্য ধর্মের কোনো সংজ্ঞা-বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়নি । এই না হওয়াটাই বর্তমান সময়ের প্রধান সমস্যা ।

ধর্মমত (Religion) গুলি বিভিন্ন সময়ে , বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন মনীষীর দ্বারা প্রবর্তিত । প্রবর্তন হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সময়ের , সংশ্লিষ্ট দেশের সমাজ বাস্তবতা বা বিশেষ কোনো সেন্টিমেন্টের কারণে । সেই বিশেষ সময়ে , বিশেষ দেশে , বিশেষ সেন্টিমেন্ট প্রসূত আচার-আচরণ এবং প্রথা-পদ্ধতিগুলির সমহারই আজকের বিভিন্ন ধর্মমত (Religion) । এ গুলিকে ধর্ম (DHARM) বলা ঠিক নয় । 

মানবপ্রজাতির ধর্ম ( comon characteristic) মানুষের জন্মের মধ্যেই নির্ধারিত হয়ে আছে । আলাদা করে তা আরোপিত করা যায় না । সুতরাং মানুষের ধর্ম কী ? এই প্রশ্নটিই অবান্তর !
এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলে রাখি , তা হলো , মানুষের ধর্মান্তরিতকরণ ব্যাপারটিও ঠিক নয় ।
মানুষের ধর্ম বা কমন ক্যারেকটারিস্টিক যখন প্রকৃতি প্রদত্ত বিশেষ গুন ; তখন কোনো মানুষের ধর্ম পরিবর্তন করার অর্থ তাকে উদ্ভিদ বা পশুতে পরিণত করা ।
তাই কিছু প্রথা-পদ্ধতি বা আচরণীয় বিশ্বাসের পরিবর্তনের নামে ধর্মান্তরিত করন আইনটিও বাতিল করা উচিত । বর্তমান ভারতবর্ষে এটাও একটি সমস্যা ।

মানুষের ধর্মান্তরিত করণ এবং বিভিন্ন দরখাস্তের ফর্মে মানুষের ধর্ম জানতে চাওয়ার এই অবৈজ্ঞানিক সিস্টেমগুলিই তুলে দেওয়া উচিত ।

ধর্মমত (Religion) জানতে চাইলেও চাওয়া যেতে পারে ; তবে বর্তমান উন্নত বিজ্ঞানের যুগে মানুষের মধ্যে পরস্পর বিরোধী প্রথা-পদ্ধতিসর্বস্ব এই সব ধর্মমতের উল্লেখ করে মানব প্রজাতিকে আর বিভক্ত না করাই ভালো । সে ক্ষেত্রে ধর্মের প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ধারিত করে , এটা বলা হোক যে , মানব প্রজাতির ধর্ম একটাই । মানুষের ধর্ম বহু নয় ! বহু হতেও পারে না ! 

সংজ্ঞা-বৈশিষ্টে না থাকলেও বিভিন্ন ধর্মমতের অনেক মানুষ এখন ধর্মমতগুলির কঠোরতা মানতে চাইছেন না । ধর্মমতগুলির নানান অযৌক্তিক বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে এসে অনেক মানুষই এখন মানব-সংস্কৃতির মিলনের বহুমুখী প্রথা-পদ্ধতি পালন করছেন । তার অর্থ এই নয় যে, তাঁদের ধর্ম পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ! আমাদের নেতা মন্ত্রীরা তো হামেশায় সে সব করছেন । আমরাও করছি । এ নিয়ে অনেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন বটে ; কিন্তু সেটাও ঠিক নয় । কেননা, মানুষের সংস্কৃতিটাই মিলনের সংস্কৃতি ; বিভেদের সংস্কৃতি নয় ! সুতরাং এ সবও আজকের যুগে ভেবে দেখার সময় এসেছে । 

প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি কথা বলে রাখি , আজ বিভিন্ন ধর্মমত যেভাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে নখ-দন্ত বের করে ধেয়ে আসছে ; সেই বিষাক্ত ফণী'র হাত থেকে মানুষ ও মানবতাকে বাঁচাতে ধর্মমতগুলির সংকীর্ণ পরিচয়ের উর্ধে উঠে মানুষকে প্রকৃত মানবধর্মের পরিচয়েই পরিচিত হতে হবে । এক মানব পরিচয়কেই হাতিয়ার করতে হবে ! আর এখনই তার উপযুক্ত সময় ।

সুকুমার সরকার
কালদিঘি , গঙ্গারামপুর
দক্ষিন দিনাজপুর
পিন কোড -- 733124
মোবাইল নং -- 7047550231
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.