সংগ্রাম : মনসুর আলী গাজী


       
                                                                             

    সংগ্রাম

          তুহিন ছেলেটার ছোটবেলা থেকেই ভাগ্য খারাপ। ও কোনোদিন ওর বাবার আদর স্নেহ ভালোবাসা পেল না। ওর জীবন বাড়িতে আর ওর বাবার জীবন পথে পথে। সারাদিন ঘুরতে থাকে এখানে ওখানে। যা পায় তাই খায়। ছেঁড়া প্যান্ট ছেঁড়া জামা পরে রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনের মতো ঘুরে বেড়ায়।
    এই তো সেদিন বাজারের মোড়ে পড়ে থাকা একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে তুলে নিয়ে চেটে চেটে খাচ্ছিল। দোকানদার বলছিল, “এই পাগল, যা এখান থেকে, যাহ্।“
    কি আর করবে বেচারা, ওখান থেকে আস্তে আস্তে সরে এল। নাহ্, এ জগতে প্রবীণের দুঃখ কেউ বুঝল না। ভালোবেসেছিল একজনকে এপক্ষের বিয়ের আগে। তার সাথে বিয়েও হয়েছিল। কিছুদিন পর বিচ্ছেদ। প্রবীণ তখন সুস্থ। তারপর ওর বাবা—মা অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিলেন। প্রবীণদের সংসারে নতুন অতিথি এল। তুহিন জন্মাল। তারপর কোথা থেকে কে কি খাইয়ে দিয়েছে প্রবীণকে, যার জন্য আজকের ওর এই পথজীবন, যদিও এর সত্যতা সম্বন্ধে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ কিছু নেই, লোকমুখে যতটা শোনা যায়, এই আর কি.... ।
     তুহিনদের সংসারে তুহিন আর ওর মা ছাড়া আর কেউ নেই। লোকের বাড়ি বাসন মেজে যা পায় তাই দিয়ে যেমন সংসার চলে তেমনই সংসার তুহিনদের।
      এই তো সেদিন কিছু না খেয়েই কলেজের জন্য রওনা দিল ও। এমনই দারিদ্র্য বিরাজ করে ওদের সংসারে।
      সুরেন্দ্রনাথ কলেজের বাংলা অনার্স ফাইনাল ইয়ারের সবচেয়ে ভালো ছেলে কে এই প্রশ্ন যদি ওঠে তাহলে সবার আঙুলটা যাবে তুহিনের দিকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে যথাক্রমে আটান্ন এবং উনষাট শতাংশ নম্বর আছে ওর। পাশাপাশি একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তুহিনের সুনামও আছে।
       আজ তুহিন ওর মাকে বলল, “মা, থার্ড ইয়ারে ভর্তির আটশো টাকা কলেজে এখনো বাকি। আজকে নোটিশ দিয়েছে পরশুর মধ্যে ওটা দিয়ে দিতে হবে।“
       তুহিনের মা সুমিতা বলেন, “কিন্তু বাবা, আমার কাছে এখন তো মাত্র দুশো টাকা আছে। কি হবে বল্ তো?”
       “কি করব তাই তো ভাবছি।“, বলতে বলতে মাথা চুলকোয় তুহিন।
       কোনও উপায় না পেয়ে ডাল আর পুঁইশাক চচ্চড়ি দিয়ে অল্প করে দুটো ভাত খেয়ে ঘুমোতে চলে যায় তুহিন। দুকামরা মাটির ঘরে ওরা ঝড়, জল, রোদ সব পার করে দিয়ে এসেছে এতদিন। ঘরটা তুহিন আর ওর মা মিলে তৈরি করেছিল আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে।
       রাতে তুহিনের মনে হতে লাগল — “ওর কি লেখাপড়া হবে না! শুধু টাকার জন্য! নাহ, অভিষেক স্যারকে একবার বলতে হবে। দেখি কি বলেন স্যার।“
     অভিষেক স্যার তুহিনের স্কুলের শিক্ষক। বাংলা লেখার জন্য তুহিনকে একদিন বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তুহিন, তুই যদি এই সাবজেক্টটা নিয়ে পড়িস তুই অনেকদূর এগোতে পারবি। তোর লেখার হাত আছে।“
      সেদিনের কত উপদেশ তুহিনকে ভুলিয়ে দিয়েছিল সে সমাজে এক গরিব ভিখারিনীর ছেলে। সে যেন হৃদয়ে ধনী হয়ে উঠেছিল।
      “মা, আমি একটু অভিষেক স্যারের বাড়ি যাচ্ছি।“, পরদিন সকালে এই কথা তুহিন ওর মাকে বলে ওর বার হয়ে যায়।
      তুহিনের কথা শুনে অভিষেক বাবু ওকে আটশো টাকা দিলেন।
      “স্যার, এ টাকা আমি আপনাকে কবে ফেরত দেব আমি জানি না।“,ব্যথাতুর কন্ঠে বলে ওঠে তুহিন।
        স্যার বললেন, “বাবা,  এ টাকা তোমাকে ফেরত দিতে হবে না।“
        উফ্, কি দৃশ্য শুধু ইশ্বর জানেন!
        এই অভিষেক স্যারই আজও তুহিনের জীবনের আদর্শ।
        যাইহোক, তুহিন কলেজে ভর্তির টাকা জমা দিল।
        এদিকে ওর বাবা প্রবীণের জীবন সেই পথেই কেটে চলেছে। তুহিন আর ওর মা অনেক চেষ্টা করেছে ওকে বাড়িতে রাখতে। এমনকি চিকিৎসা করাতেও চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বাড়িতে প্রবীণ থাকতে চায় না। ওষুধ তো খেতেই চায় না। বাইরের জীবনেই যেন প্রবীণের সুখ।
     তুহিনের মা সুমিতা কলকাতার কিছু বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা এইসব কাজ করে। এইসব করে কোনোমতে সংসারটা চলে যায়।
      সামনে পূজো। সবাই নতুন জামাকাপড় কিনছে। তুহিনের ওসবে কোনো মন নেই। ও জানে উৎসব আনন্দ ওসব তো বড়োলোকেদের, ওর জন্য না। ওকে আগে বড়ো হতে হবে।
তারপর আনন্দ উৎসব করার জন্য জীবন পড়ে আছে। তুহিন খুব বুঝদার ছেলে। কি করবে? গরিবের ছেলে, বুঝতে তো হবেই।
     পূজোয় সবাই যখন ঘোরে, বেড়ায়, ওর তখন সময় কাটে চাঊমিন, রোল এইসব বানাতে। পূজোয় না এদিক ওদিক ঘুরে যদি একটা চাঊয়ের দোকান দিয়ে যদি দুটো পয়সা আসে সে তো অনেক ভালো, এই মনে করে তুহিন।
    অভিষেক স্যার স্কুলে যখন ক্লাস নিতেন, তুহিন তখন মুগ্ধচিত্তে স্যারের কথা শুনত, আর ভাবত — ইস্, যদি স্যারের মতো হতে পারতাম; একটা স্কুলে পড়াতাম, আমার মতো ছাত্ররা সব আমার দিকে তাকিয়ে একমনে আমার কথা শুনত। তাছাড়া অনেক মাইনে পেতাম। মা'টাকে আর লোকের বাড়িতে অত কষ্ট করে কাজ করতে যেতে হত না। আহা, যদি অভিষেক স্যারের মত হতে পারি!
    ও কেবল ভেবে চলে, স্বপ্ন দেখে চলে।
    স্বপ্ন কি সত্যি হবে না? কেন হবে না। পরিশ্রম করতে হবে তার জন্য। নিজেকে বোঝায় তুহিন। তাই তো এত কষ্ট করা। কিন্তু হায়! এ কি হল!
    এ তো হবার কথা ছিল না। এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল তুহিনের জীবনের বালুচরে।
 .  ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাক্তার দেখিয়ে ক্যান্সার ধরা পড়ল। তুহিন শক্ত মনের ছেলে। তবে দুঃখ যে পায়নি তা নয়। কান্না করার চেয়ে কিভাবে মাকে সুস্থ করে তোলা যায় সেই চেষ্টাই করতে হবে সেই কথাই ভেবেছিল ও।
    ও ডাক্তারকে বলে, “ডাক্তার বাবু, উপায় কি?”
    ডাক্তার বাবু বললেন, “প্রাইমারি স্টেজ। চিকিৎসা করলে সেরে উঠবেন। চিন্তিত হবার কিছু নেই।“
    কিন্তু সংসার চলবে কি করে! মা তো আর কাজে যেতে পারবে না। তাছাড়া মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকারও তো দরকার — ভাবতে থাকে তুহিন।
    ও চাকরির জন্য এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সবজায়গায় একই কথা — “এখন লোক নেওয়া হচ্ছে না”।
    অবশেষে একটা কোম্পানিতে যোগাযোগ হল, যেখানে ও অফিস বয়ের কাজ পেল। বেতন মাসে মাত্র আড়াই হাজার টাকা। ও কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে কলেজ যাওয়া বন্ধ করল, শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষাগুলো দেবে।
    এইভাবে সাত মাস সংসার চালাল। মাকে সুস্থ করে তুলল। ওর কলেজের পাঠ শেষ করল। তারপর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এম এ তে ভর্তি হল। ওর মা আবার কাজে যেতে লাগল।
    ওর বাবার সেই একই জীবন। এই ক’দিন আগে তুহিন ওর বাবাকে একটা নতুন জামা কিনে দিয়েছিল। কিন্তু প্রবীণ সেটা দুদিন পরে কোথায় ফেলে দিয়েছে কে জানে! কোথায় ঘুমোয়, কোথায় খায়, কি খায় কে জানে! বড়ো দুঃখ পায় তুহিন ছেলেটা।
     জীবনমরুতে একবিন্দু জলের দেখা ও কোনোদিনও পেল না। হায় বিধাতা! সুখের মুখ কি ওরা কোনওদিনও দেখবে না? ভেবে চলে তুহিন। নাহ্, ভেঙে পড়লে হবে না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বড়ো ওকে হতেই হবে।
     মায়ের দুঃখ যে তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যন্ত্রণার কালনাগ যেন ওকে দংশনে দংশনে ওর দেহটাকে কঙ্কালের জীর্ণতা দিয়ে জীবনযুদ্ধে ওকে ধরাশায়ী করতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। আর দুর্ভাগ্যের সাথে পাঞ্জা লড়াইয়ে ওর হাতটার যেন পড়ো পড়ো অবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু এ যুদ্ধে হেরে গেলে তো সব শেষ। তাই প্রাণ গেলেও হাল ছাড়া চলবে না।
     দুর্ভাগ্যের সাথে তাই লড়াই জারি থাকবে। এ যুদ্ধ জারি থাকবে যতদিন ওর শরীরে স্পন্দিত হবে প্রাণের ক্ষীণতম ধ্বনিটুকু।
     ও চাকরি ছেড়ে দিল। ইউনিভার্সিটিতে যেতে লাগল। অনার্সে সাতান্ন শতাংশ নম্বর পেয়েছে। মাস্টার'স ডিগ্রিটা ভালো করে করতে হবে। ওর মা শহরের বাবুদের বাড়ি কাজ করে যে টাকা আয় করে তাই দিয়ে খেয়ে-পরে কোনোমতে দিন পার করে দিচ্ছে ওরা। কিন্তু প্রতিটি দিন যে করুণ ছায়ার ছাপ ফেলে যাচ্ছে তার দাগ কি কোনোদিনও মুছবে — বারে বারে জিজ্ঞাসা জাগে তুহিনের মা সুমিতার মনে।
     এভাবে এম এ —এর পার্ট ওয়ান শেষ হল। পঞ্চান্ন শতাংশ মার্কস পেল। ওর মা খুশি হল। কিন্তু এ হল প্রস্তুতি সময়। সুখের পাখিটা ঘরের চালে এসে বসবে সে যে এখনও অনেক অপেক্ষার পরে।
   অনেক ঘাত—প্রতিঘাতে, কষ্টে কেটে গেল আরো একটি বছর। এম এ শেষ হল। তুহিন এখন নেট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিন আর রাত কখন আসছে কখন যাচ্ছে সে বোধ যেন কোন সুদূর অতীতে ওকে বিদায় জানিয়েছে সে স্মৃতি ওর কাছে নেই।
   এরমধ্যে ওর বাইসাইকেলটা বাজার থেকে চুরি হয়ে গেল। এখন ও কিভাবে কলকাতায় স্যারের কাছে পড়তে যাবে? বাড়ি থেকে তো স্টেশন অবধি এখন পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। একে তো বাড়িতে নানা ঝামেলা লেগেই আছে। তার ওপর আবার এই ধরনের একটা অঘটন। উফ্! আর সওয়া যে ওর সাধ্যের বাইরে হয়ে যাচ্ছে। — ভাবতে থাকে তুহিন।
    যাইহোক আর কি হবে, ওর মায়ের কিছু জমানো টাকা ছিল, তাই দিয়ে ও একটা নতুন বাইসাইকেল কিনল। আবার শুরু সেই আগের জীবন; যেমন চলছিল আর কি।
     দিনকয়েক পর তুহিন হাটে সব্জি কিনতে গেছে, এমনসময় ওর দ্বিতীয় নতুন বাইসাইকেলটা আবার চুরি হয়ে গেল।
      কে যে এভাবে পিছনে লেগেছে — ভাগ্য নাকি মানুষ, ও কিছুই বুঝতে পারে না। বিহ্বল হয়ে পড়ে ও। নিজেকে শেষ করে দেবার কথা মাথায় উঁকি দেয়।
      ও নিশুতি রাতে বেরিয়ে পড়ে রেললাইনের উদ্দেশ্য। এক পা এক পা করে এগোয় আর ভাবে — কি হবে এভাবে বেঁচে থেকে, নিয়তি যখন বিরূপ! রেললাইনের কাছে চলে আসে। লাইনের অপর উঠে যায় ও।
      “তুহি ই ই ই ই ই ন! এ কাজ করিস না বাপ আমার।“, কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল। অবিকল ওর মায়ের কন্ঠস্বর।
      ও এদিকে ওদিকে তাকায়। কই কেউ তো নেই। তাহলে?
      দূর এসব মনের ভুল। মরতে আমাকে হবেই। এই ভেবে ও রেললাইনের ওপর চেপে বসে।
       হুইসিল দিয়ে ট্রেন আসতে থাকে। হঠাৎ ও শুনতে পায় সেই কন্ঠ —
       “তুহি ই ই ই ই ই ন..............!”
       ও পাগল হয়ে যায়। লাইন থেকে নেমে পড়ে। ট্রেন চলে যায়।
      আজ দুই বছর অতিক্রান্ত। সকাল থেকে থেকে প্রবীণ অর্থাৎ তুহিনের বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকায় ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
       হঠাৎ ইটখোলার পাশের আম বাগানের পুকুরপাড়ে ওর প্রাণহীন দেহটা পাওয়া যায়।
       তুহিন কাঁদছে, তুহিনের মা'ও কাঁদছে। অঝোর নয়নে কাঁদছে। পাগল হোক, যাই হোক, চোখের দেখা তো ওরা দেখতে পেত। সেটুকুও আর বাকি রইল না।
       পাড়ার সবাই প্রবীণের মরদেহ সৎকার করল।
       পরদিন তুহিন, তুহিনের মা চুপ করে দাওয়ায় বসে আছে। এমনসময় পোস্ট অফিসের পিওন এসে নাম ধরে ডাকে — “তুহিন দাস”। তুহিন চিঠিখানা নিল। নিয়ে খুলে দেখল — নেট এক্সামের ইন্টারভিউয়ে ও সিলেক্টেড হয়েছে।
        তিক্ত বেদনার বালুচরে কে যেন এক শান্তির মধুর প্রলেপ দেওয়া বাতাস এই মা ও ছেলের বুকের ভেতর দিয়ে সুখের আবেশ লাগিয়ে বইয়ে দিতে লাগল। এই কিগো সেই স্বপ্নের মুহূর্ত যার জন্য ওরা এতদিন অপেক্ষা করেছিল..........!
        মন গেয়ে ওঠে — “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, বাঁচিবারে চাহি!”


                                     সমাপ্ত
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.